ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

কোনদিকে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি

রেজাউল করিম খোকন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ০৯:০৪ এএম

কোনদিকে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি

বর্ধিত ঋণসুবিধা (ইসিএফ) নামের সেই ঋণের শর্তপূরণের অংশ হিসেবেই কিছুদিন পরপর জ্বালানি তেল, পানি ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এমনকি ২০১৩ সালে বিশ্ববাজারে যে জ্বালানি তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ১১০ ডলার, দুই বছরের মধ্যেই তা নেমে এসেছিল মাত্র ২৭ ডলারে। 

কিন্তু সরকার তেলের দাম কমায়নি। সাধারণ মানুষকে ভোটার হিসেবে গণ্য করেনি বলেই তাদের স্বস্তি দেওয়ার বিষয়ে তখন সরকারের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ১২ বার ঋণ নিয়ে অসংখ্য শর্ত পূরণ করলেও কোনো অর্থমন্ত্রী বা সরকার কখনোই তা স্বীকার করেনি। এমনকি কোনো বাজেট বক্তৃতাতেও এর কোনো উল্লেখ নেই। 

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন ২০২২ সালের ২৪ জুলাই। আর একলাফে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছিল পরের মাসেই, ৫ আগস্ট। পরপরই ৫ শতাংশ বাড়ানো হয় পানির দাম। 

আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির নীতিগত অনুমোদন দেয় একই বছরের নভেম্বরে, আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় পরের বছরের ৩০ জুন। এ ঋণেরই অন্যতম শর্ত ছিল নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন পাস ও কার্যকর করা। 

শর্তপূরণের অংশ হিসেবে ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর নতুন ভ্যাট আইন জাতীয় সংসদে পাস হলেও ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইনটি কার্যকর করা পিছিয়ে দেয়। এতে আইএমএফ ঋণের অর্থ আটকে দিলে সরকার জানিয়ে দেয় যে আইনটি কার্যকর করা হবে ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে, ২০১৪ সালের ভোটের পর। 

এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরই আইএমএফ ঋণের শেষ দুই কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করেছিল। সেই আইন কার্যকর হয় ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পরে, অর্থাৎ ভোটের পরেই ভ্যাট আইন। 

নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হলেও সব মহলকে খুশি করতে মূল আইনের অনেক কিছুই বাদ দেওয়া হয়। মূল আইনে ভ্যাটের একক হার ছিল ১৫ শতাংশ, নতুন আইনে তা ভেঙে আটটি করা হয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সে সময় নতুন আইনকে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ বলেছিলেন। সেই ভ্যাট আইন দেশের রাজস্ব আয় বাড়াতে তেমন কোনো ভূমিকাও রাখেনি। 

আইএমএফের ঋণ পেতে সেই ভ্যাট আইনকেই এক দফা সংশোধন করল বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার। ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্যের ওপর শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। এ সময় অনেকগুলো পণ্য ও সেবা খাতে একক ভ্যাট হারও মূল্য আইন অনুযায়ী আবার ফিরিয়ে আনা হয়। 

এটা ঠিক যে আইএমএফের ঋণ ও ঋণের শর্ত উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। পাশাপাশি সরকার আইএমএফের কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। এ জন্য আইএমএফের এক প্রতিনিধিদল গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এসে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৬ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর শর্ত দেয়। সেই শর্তপূরণের অংশ হিসেবেই বাড়ানো হয়েছে শতাধিক পণ্যের শুল্ক-কর। 

যদিও সরকার এখন পর্যন্ত আইএমএফের শর্তের কথা স্বীকার করেনি। এমনকি এর ফলে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে না, এমন কথাও নীতিনির্ধারকরা বলছেন। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। ৫৪ বছর ধরেই কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটি। সুতরাং রাজস্ব আয় বাড়াতেই হবে। একটা সময় ছিল, যখন আমদানি শুল্ক ছিল রাজস্ব আয়ের বড় উৎস। 

এখন সেই স্থান দখল করেছে ভ্যাট। ভ্যাট পরোক্ষ কর, এর দায় চাপে ভোক্তার ওপর। আর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য আদর্শ পথ হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর। বাংলাদেশের সমস্যা এখানেই।

ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারে না বলেই পরোক্ষ কর আদায়ের সহজ পথ বেছে নেয় সরকার। একই পথ অবলম্বন করল অন্তর্র্বর্তী সরকারও। রাজস্ব খাতসংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি সরকারকে একটি বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন।

 আমাদের একটি সংস্কারের ধারায় যেতে হবে। এমন কোনো প্রস্তাব করা হবে না, যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এটা ঠিক, বৈপ্লবিক কিছু করা যাবে না। আমাদের সমাজে সেই অবস্থা নেই। তবে তারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো তৈরি করেছেন।

 সবার মধ্যে সংস্কার নিয়ে একধরনের চেতনা তৈরি হোক, আমরা এটাই চাই। আগেই বলেছি, উত্তরাধিকার সূত্রেই একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে সরকার। এই অর্থনীতি রাতারাতি ঠিক করা সহজ কাজ নয়। 

তবে অর্থনীতিকে সঠিক পথে নিতে সরকার কী করছে, সেই চিত্র জানাটা জরুরি। জানা প্রয়োজন সরকারের অগ্রাধিকারগুলো কী কী। এটা ঠিক যে গত পাঁচ মাসে সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেকগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

তবে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের ওপর যদি সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকে, তাহলে কখনোই মূল্যস্ফীতি কমবে না, বিনিয়োগও বাড়বে না। এটা পরিষ্কার যে একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ানো,  এ পথে অন্তত মানুষের আস্থা ফিরবে না।

অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট, চলতি অর্থবছর শুরুর মাত্র এক মাস সাত দিন পর। সুতরাং চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের সময় প্রায় পুরোটাই পাচ্ছে সরকার। তবে যে অর্থনীতি সরকার পেয়েছে, তাতে এই বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন কাজ। 

সুতরাং অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল, অর্থ মন্ত্রণালয় অন্তত ডিসেম্বর শেষে দেশের অর্থনীতির, বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতির একটি পর্যালোচনা করে তা জনগণকে জানাবে।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও অর্থনীতির মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনার সুপারিশ করেছেন। তাতে অন্তত জানা গেছে, অর্থনীতির বর্তমান চিত্রটা কেমন, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এর প্রভাব কতটা পড়ছে এবং অর্থবছরের বাকি সময়ে কী করতে হবে।

সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল অর্থনীতির চরম অব্যবস্থাপনা এবং খেয়াল-খুশিমতো অর্থনীতি পরিচালনা করা। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শের কোনো কাঠামোই ছিল না। 

আশা করা হয়েছিল, অর্থনীতি নিয়ে বর্তমান সরকার অন্তত বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি পরামর্শ গ্রুপ গঠন করবেন। যারা আগের সরকারের সময় এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করতেন, তারাই তো এখন দায়িত্বে। 

সুতরাং রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট বাড়ানো সঠিক পথ নাকি অন্য কোনো উপায় আছে; মহার্ঘ ভাতার অর্থ কোথা থেকে আসবে; আইএমএফের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ভ্যাট বাড়ানো ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না; সুদহারনীতি কেমন হওয়া উচিত; যারা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন, তাদের পুনর্বাসন কী হবে- এসব বিষয় আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলেই বরং সরকারের কাজের স্বচ্ছতা বাড়ত। মানুষও জানতে পারত সরকারের লক্ষ্য কী।  

সবাই জানি স্বচ্ছতার সঙ্গেই আস্থার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। নির্বাচনের রূপরেখা বা সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির একটি রূপরেখা জানাও জরুরি। অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কী, সেটা জানা দরকার। কেননা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে, কর্মসংস্থান ও আয় না বাড়ে, তাহলে সংস্কার নিয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে না।


লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা
কলাম লেখক
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!