ঢাকা সোমবার, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

যুক্তরাজ্যে বাংলাচর্চা ও ঐতিহ্যধারণের স্রোতধারা

শাহ মনসুর আলী নোমান
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫, ০১:৪০ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বহুজাতিক, বহুভাষিক ও বহুসাংস্কৃতিক বিশ্বনগরী হিসেবে সুপরিচিত ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন শহর। প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সাহিত্য, সংস্কৃতিসমৃদ্ধ লন্ডন শহরটি টেমস নদীর তীরে অবস্থিত। দীর্ঘকাল থেকেই  বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস লন্ডন শহরে। পূর্ব লন্ডনের ‘ব্রিকলেন-বাংলাটাউন’ ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা লেখা শোভা পাচ্ছে।

হুমায়ুন আজাদের ভাষায়- “হাজার বছর আগে জন্ম হয়েছিল বাঙলা ভাষার। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা মানুষের মুখেমুখে রূপান্তরিত হয়ে বঙ্গীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিল এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী প্রাকৃত। তার নাম বাঙলা। তাকে কখনো বলা হয়েছে ‘প্রাকৃত’, কখনো বলা হয়েছে ‘গৌড়ীয় ভাষা’। কখনো বলা হয়েছে ‘বাঙ্গালা’, কখনো ‘বাঙ্গলা’। এখন বলি ‘বাঙলা বা ‘বাংলা।”  ইংল্যান্ডে বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির সরব উপস্থিতি বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের জন্য গৌরবের এবং বাংলা ভাষার হাজার বছরের সেই ঐতিহ্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ব্রিকলেন-বাংলাটাউন বাংলাদেশি মানুষের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দোকান, রেস্টুরেন্ট এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ড, বিজ্ঞাপন এবং নানা ধরনের লেখা শুধু আমাদের জন্য অহংকার নয়, বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মর্যাদার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইউরোপ মহাদেশের একটি অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ ইংল্যান্ডে ইংরেজি ভাষার এই আধিপত্যের মধ্যে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার এই দৃশ্যমানতা ও জয় জয়কার। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের জন্য এটা অনেক গৌরব ও অহংকারের প্রতীক। এর ফলে বিশ্ববাসীর কাছে  বাংলা ভাষা জানান দেয় এর সমৃদ্ধি হাজার বছরের ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা ভবিষ্যতেও প্রাসঙ্গিক। বাংলা টাউনে বাংলাদেশিদের উজ্জীবিত হওয়া ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলা ভাষার এক আলোকিত বৈশিষ্ট্যের কথা। লন্ডন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির এক বিরাট  প্রাণকেন্দ্র। লন্ডনে বিশ্বের একশ’রও বেশি বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর অবস্থিত। বিশ্বের দর্শনীয়, সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় শহরগুলোর মধ্যে লন্ডন শহরের স্বতন্ত্র ও আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন লন্ডনের বিভিন্ন দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক জায়গা দেখতে যান। তখনই  বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বাংলাটাউন এবং বাংলা ভাষা সংস্কৃতি- ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশি খাবার উপভোগ করতে বাংলাটাউনে ভিড় জমান। পাশেই আলতাব আলী পার্ক, শহীদ মিনার, ইস্ট লন্ডন মসজিদ, ব্রিকলেন মসজিদ, বাংলাদেশি খাবারের দোকান ও ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি, এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।

সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, মানবীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নয়নে গড়ে ওঠে গণমাধ্যমের ইতিহাস। মানবজীবনে সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে গণমাধ্যমের ইতিহাস গভীরভাবে জড়িত। খ্রিস্টপূর্ব ৫০ অব্দে জুলিয়াস সিজারের শাসন আমলে রোমে ‘Acta-Diurna’ নামক হাতে লিখিত দিনলিপি বা দেয়াললিখন থেকে জনগণ প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিত। বর্তমান সময়ের গণমাধ্যমের মতো  ‘Acta-Diurna’-এর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি রয়েছে কি না এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও ‘Acta-Diurna’ কে গণমাধ্যমের প্রাচীন রূপ হিসেবে ধারণা করা হয়। ১৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বে  ‘Book of the Dead’ নামক গ্রন্থটি মিশরীয় সভ্যতায় প্যাপিরাস দিয়ে লেখা।

১৪৫০ সালে মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার মুদ্রণ গণমাধ্যমের ইতিহাসে এক নব দিগন্তের সূচনা হয় এবং ১৮৮০ সালে ক্যামেরা আবিষ্কারের ফলে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ঘটে। প্রথম বেতার (রেডিও)  সম্প্রচার হয় ১৯১০ সালে এবং ১৯২৬ সালে টেলিভিশন আবিষ্কারের পর তা গণমাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের উদ্ভাবন গণমাধ্যমসহ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ইত্যাদি প্রথাগত গণমাধ্যমকে প্রধান গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হতো ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। স্মার্ট মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং বিকাশের ফলে ডিজিটাল গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওয়েবসাইট, ব্লগ ইত্যাদি নতুন গণমাধ্যম।

প্রতিদিন দুটো করে সূর্য ওঠে। একটি সকালের আলোকিত সূর্য, অন্যটি সংবাদপত্র-সূর্য। সকালের সূর্যের আলোতে পৃথিবী হয় আলোকিত। তেমনি সংবাদপত্র-সূর্য বা সাংবাদিকতার কল্যাণে সারা বিশ্বের প্রতিটি ঘটনা সূর্যের আলোর মতো আমরা স্পষ্টভাবে জানতে পারি। আমেরিকান কথাসাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের উল্লিখিত উক্তি যথার্থভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। গণমাধ্যম যেমন- সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং পথপরিক্রমা পাড়ি দিয়ে আজকের এই অবস্থানে মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত, তেমনি যুক্তরাজ্যেও রয়েছে বাংলা গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকতার শতাধিক বছরের ইতিহাস। যুক্তরাজ্যে বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের রয়েছে শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পরে পূর্ব লন্ডনের  ‘ব্রিকলেন, বাংলা টাউন’ ও এর  পার্র্শ্ববর্তী এলাকা ‘তৃতীয় বাংলা’ হিসেবে খুব সুনাম অর্জন করেছে। বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে বাংলাদেশি অভিবাসী ও গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রাজ্ঞ মহলের অভিমত, যুক্তরাজ্যে ১৯১৬ সালে পাক্ষিক ‘সত্যবাণী’ পত্রিকা প্রথম বাংলা সংবাদপত্র। এরপর থেকে এখানে বাংলা সংবাদপত্র, বাংলা ভাষার চর্চা বিকশিত হতে থাকে। যুক্তরাজ্যে বাংলা গণমাধ্যম, বাংলা ভাষার চর্চা ও সাংবাদিকতার প্রসার ও বিকাশ আমাদের জন্য বাংলাদেশি হিসেবে অনেক গৌরব এবং আনন্দের।

ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশের ফলে  যুক্তরাজ্যের মাটিতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস- ঐতিহ্য বহির্বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তৃতীয় বাংলায় বর্তমানে বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও সাংবাদিকতা একটি প্রতিষ্ঠিত আসনে। এখানে রয়েছে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স, অনলাইন, ডিজিটাল গণমাধ্যম  এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, চ্যানেল এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। বাংলাদেশের জাতীয় এবং স্থানীয় সংবাদপত্রে রয়েছে যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি।  এখানে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীরা  প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষা সংস্কৃতির বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকতার মান উন্নয়ন, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন, বর্তমান ও পরবর্তী ব্রিটিশ বাংলাদেশি প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও চেতনা সৃষ্টি করা, নাগরিক ও সাংবাদিক সম্মাননা, শিক্ষা-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মানবকল্যাণ, বাংলাদেশের সুনাম ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন বাংলা গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক, কলাম লেখক ও গবেষকদের নিয়ে ২০১৭ সালের ৫ জুলাই প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘ইউকে বাংলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

যুক্তরাজ্যে বাংলা গণমাধ্যমের শতবর্ষের গর্বের ইতিহাস ও ধারা অব্যাহত থাকুক বাংলাদেশের গণমানুষের কল্যাণে, দেশের স্বার্থে। বিশ্ববাসীর কাছে এভাবেই বাংলা ভাষা- সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য হাজার বছরের পরোনো, বিভিন্ন  সংস্কৃতি এবং সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। বাংলা ভাষার মূল ভিত্তি এখনো অবিকল। বাংলা ভাষা হাজার বছর পরেও বেঁচে থাকবে নিজ মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে। কবি হুমায়ুন আজাদের ভাষায়- “আমি বাঙলা ভাষার রূপে আর শোভায় আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ। আমার মায়ের মুখের মতো সে শান্ত। তার অশ্রুর মতো সে কোমলকাতর। আমার মায়ের দীর্ঘশ্বাসের মতোই নরম আমার মাতৃভাষা। কখনো সে অন্য রূপ নেয়, শোভা ছড়িয়ে দেয়। মুগ্ধ করে আমাকে অন্যভাবে। তাকে দেখে আমার চাঁদের কিরণের কথা মনে পড়ে; জ্যোৎস্নায় ছেয়ে যায় চারদিক। তার শরীর থেকে দ্যুতি ঠিকরে পড়ে। ঝলমল করে ওঠে চিত্ত। যখন বাঙলা ভাষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন আমার চণ্ডীদাসের নাম মনে পড়ে। তার উল্লাসে আমার মনে পড়ে মধুসূদনের মুখ। তার থরোথরো ভালোবাসার নাম আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ। তার বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ। তার বিদ্রোহের নাম নজরুল। বাঙলা আমার ভাষা। এ-ভাষা ছাড়া আমি নেই।”