সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে, যা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষত ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ভূমিকম্পের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। গত ৩ জানুয়ারি সকালে রাজধানী ঢাকা ও উত্তর-পূর্বের সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫।
১৯ দিন আগে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রাতে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। ঘন ঘন ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা দিচ্ছে বলা যায়। দেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে নয়, বরং জনসংখ্যার ঘনত্ব, দুর্বল অবকাঠামো এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অভাবের কারণে আরও জটিল হয়ে উঠছে। ঘন ঘন ভূমিকম্পের অনুভবের পেছনে কারণ, বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা এবং আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্লেষণ জরুরি।
ভূমিকম্পের কারণ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তিনটি প্রধান টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত: ইন্ডিয়ান প্লেট, ইউরেশিয়ান প্লেট এবং বার্মা মাইক্রোপ্লেট। এই প্লেটগুলোর মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ ও গতি ভূমিকম্পের প্রধান কারণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতীয় প্লেট প্রতিবছর ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে ৫ সেন্টিমিটার অগ্রসর হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ায়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট মাত্রার হলেও এগুলো বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ৮.০ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষত সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এটি দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
৭.৮ মাত্রার মাত্র এক মিনিটের ভূমিকম্পেই লন্ডভন্ড তুরস্কেও পরিকল্পিত গাজিয়ানতেপ শহর। বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সেই ধাক্কা বাংলদেশ সামলাতে পারবে কি? ভূমিকম্প বিশ্লেষকরা তো বলছেন- কেবল ঢাকায় ধসে পড়বে কয়েক হাজার ভবন, মৃত্যু হবে অন্তত দুই থেকে তিন লাখ মানুষের। গত ১৫ বছরে ছোট-বড় ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ।
১০০ বছরের মধ্যে এদেশে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। ভূমিকম্প পর্যবেক্ষকরা বলেন- বড় ভূমিকম্পের শত বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস বলে শত বছর ঘনিয়ে এসেছে বাংলাদেশের। সে দিক থেকেও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কার কথাও শুনছি আমরা। আমাদের পত্রিকাগুলো এমন সংবাদই ছাপছে। তাতে করে ভূমিকম্প নিয়ে দেশে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে অনেক। বাংলাদেশে যদি ভূমিকম্প ৯ মাত্রার হয় তবে কী হবে ভাবা যায়? যে দেশটার ইট বালি রড সিমেন্ট সব কিছুই নিম্ন মানের সেখানে অপরিকল্পিত বিল্ডিংগুলোর কী হবে? কী হবে সাধারণ মানুষের? এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ মোটেও প্রস্তুত নয়।
ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের তেমন প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। এ বিষয়ে বাজেটেও থাকে দুর্বল বরাদ্দ। দেশের ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এ রকম হলে ঢাকা শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের ১৪ কোটি মানুষ। কোনো কোনো পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ জাতীয় ভূমিকম্পে ৬-২০ ফুট উপরে উঠে যাবে মাটি। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-তুরস্কে যে ভূমিকম্প হয়েছে, এর চেয়ে ছোট, অর্থাৎ, রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও শুধু ভবন ধস নয়, ঢাকার অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও গ্যাসলাইন এ নগরকে একটি অগ্নিকূপে পরিণত করতে পারে।
বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা এর চেয়েও উঁচু। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষাতেই বলা হয়েছে, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা তাদের গবেষণা থেকে বলেছেন, এখনই ভূমিকম্প হবে তা বলা যাবে না। পাঁচশ’ বছর পরেও হতে পারে। দেশে কোথায় কবে কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে কেউ আগেভাগে তা বলতে পারে না। সবই ধারণাপ্রসূত। হতেও পারে না-ও হতে পারে। ভূমিকম্প কখন হবে, কবে হবে এবং ভূমিকম্প যেহেতু প্রতিরোধ করা যাবে না, তাই এ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও আতঙ্কিত করার কোনো মানে হয় না।
ভূমিকম্পের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে উদ্ধারে প্রস্তুতি থাকতে হবে। জনমনে আতঙ্ক তৈরি না করে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। জাপানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। জাপান ভয়কে জয় করেছে। তাই তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম। আমাদের সরকার আমাদের জনগণ ভূমিকম্পের ব্যাপারে সচেতন নয়।
ঢাকা শহরে যতগুলো স্থাপনা থাকা দরকার তার চেয়ে ৫০ গুণ স্থাপনা তৈরি হলেও সরকারে এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। এখনো এ শহরে স্থাপনা নির্মাণ হরেদরে হচ্ছে। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বাণিজ্যিক কার্যালয়, সচিবালয়সহ অন্যান্য অফিস শহরের বাইরে করার পরিকল্পনা সেই বহু আগে নেওয়া হয়েছে কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোনোই লক্ষণ নেই। উল্লিখিত অফিস-আদালতগুলো শহরের বাইরে হলে ঢাকার চাপ অর্ধেক কমে যাবে। মানুষ আর ঢাকামুখী হবে না। ঢাকা শহরে লোকজনের বসবাস কমে যাবে। তাতে ঢাকার চাপ কমবে। তখন ভূমিকম্প হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিচে নেমে আসবে।
সরকারের তরফ থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়ার ন্যূনতম প্রস্তুতিও যে আমাদের নেই তা স্পষ্ট। ব্যাপক অভাব রয়েছে জনসচেতনতারও। ভূমিকম্পের ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কোনোটাই সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে। আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই।
বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ঘটনাগুলো, যেমন- নেপালের ভূমিকম্প এবং তুরস্ক-সিরিয়ার সাম্প্রতিক বিপর্যয়, আমাদের সতর্কতার বার্তা দেয়। এই বিপর্যয়গুলো দেখায় যে, ভূমিকম্প না শুধু অবকাঠামোগত ধ্বংস ডেকে আনে, বরং মানবিক সংকটও তৈরি করে।
ভূমিকম্পের সম্ভাব্য প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং দুর্বল ভবনের কারণে, ভূমিকম্প হলে প্রাণহানির সংখ্যা ব্যাপক হতে পারে। ঢাকাসহ প্রধান শহরের অবকাঠামো ধসে পড়লে শিল্পক্ষেত্রে বিশাল ক্ষতি হবে। ভূমিধস, নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং মাটির উর্বরতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যাপক আকারে দেখা দেবে। পানি, বিদ্যুৎ এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে মহামারিও দেখা দিতে পারে।
ভূমিকম্প একটি বিপর্যয়কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মানুষের জীবন, সম্পদ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ভূমিকম্পের কারণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সরাসরি এর তীব্রতা, ভূমিকেন্দ্রের গভীরতা এবং প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে। একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো যত দুর্বল, ভূমিকম্পের প্রভাব তত বেশি মারাত্মক।
বড় ভূমিকম্প হলে আমাদের কতটা প্রস্তুতি?
বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে ভূমিকম্পের জন্য আমরা এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নই। ভবনের স্থাপত্য দুর্বলতা: অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়। নগর পরিকল্পনার ব্যাপক অভাব রয়েছে। ঢাকার মতো শহরে ভবন ও রাস্তার ঘনত্ব উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস ও তথ্য বিশ্লেষণে উন্নত প্রযুক্তি নেই। জরুরি সেবার ঘাটতি ব্যাপক। উদ্ধারকাজ এবং চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী ও সরঞ্জাম নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (ডিএমএ) এবং অন্য সংস্থাগুলোকে আরও বেশি ভাবতে হবে। সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুল-কলেজে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চালাতে হবে। ভবনে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশার বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ভূমিকম্পের সম্ভাবনা মোকাবিলায় আমাদের একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন, যা অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে জনসচেতনতা পর্যন্ত বিস্তৃত।
নতুন ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা বাধ্যতামূলক করা। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলা কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংস্কার জরুরি। পুরোনো এবং দুর্বল ভবনগুলো চিহ্নিত করে মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করা না হলে ভূমিকম্পে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে। শহরে খোলা স্থান এবং জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ভিত্তি করতে হবে যা বাংলাদেশে অপ্রতুল। পূর্বাভাসের জন্য আধুনিক সিসমোগ্রাফ এবং মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করা জরুরি।
ভূমিকম্পের তথ্য ও সতর্কতা প্রচারের জন্য মোবাইল অ্যাপস এবং অন্য ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রম, স্কুল, কলেজ এবং কর্মস্থলে ভূমিকম্প পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাপক করতে হবে। গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং প্রস্তুতি নিয়ে প্রচারণা বাড়াতে হবে।
প্রশিক্ষিত কর্মী, দমকল বাহিনী, পুলিশ, এবং সেনাবাহিনীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমিক ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করা জরুরি। জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করতে হবে। যা এখনো অপ্রতুল বলা যায়। বাংলাদেশ প্রবল ভূমিকম্পের দেশ হলেও আমাদের এই ভাবনাটা অনেক বেশি আছে বলে মনে হয় না।
ভূমিকম্প-পরবর্তী সময় উদ্ধার কার্যক্রম যত দ্রুত সম্ভব জীবিতদের উদ্ধার করা। জরুরি চিকিৎসার মাধ্যমে আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা। গৃহহীনদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা। জরুরি খাদ্য, পানি, এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনঃস্থাপন করার পূর্ব প্রস্তুতি থাকতে হবে।
লেখক: গবেষক, কলাম লেখক। মহাসচিব: কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ
আপনার মতামত লিখুন :