ঢাকা শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

প্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের দায়বদ্ধতা

জুয়েল হাসান
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫, ০১:৩২ পিএম

জনগণের আস্থার প্রতীক একজন জনপ্রতিনিধি। তিনি যে সমাজের কণ্ঠস্বর, সেই সমাজের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করবেন। তাই, একজন জনপ্রতিনিধিকে হতে হবে দক্ষ, দায়িত্ববোধস¤পন্ন এবং সেবক। প্রতিনিধির কাছে বিভিন্ন দক্ষতা থাকা জরুরি। তাকে জনগণের সমস্যা বুঝতে, সমাধান খুঁজতে এবং তা বাস্তবায়নে সক্ষম হতে হবে। 

আবার, আইন-কানুন, অর্থনীতি, রাজনীতি সম্পর্কে তার যথেষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিনিধি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে কাজ করবেন। তিনি নিজের স্বার্থের চেয়ে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন এটাই প্রত্যাশা। তাদের কথা শুনবেন, তাদের সমস্যা সমাধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। জনসেবা হচ্ছে প্রতিনিধির প্রধান কাজ। তাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন। 

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে তার ভূমিকা অপরিহার্য। একজন প্রতিনিধি সব সময় স্বচ্ছ থাকবেন। তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন। তিনি কী করছেন, কেন করছেন, তা জনগণকে জানাবেন। প্রতিনিধি হিসেবে তাকে সমাজের ছোট বড় সর্বস্তরের মানুষের কথা ভাবতে হবে, তাদের সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে। একজন প্রতিনিধি হিসেবে তাকে জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হবে, তাদেরকে একত্রিত করে কাজ করতে হবে, জনগণের সুখ-দুঃখ বুঝতে হবে।

 জনগণের সমস্যা সমাধানে সহানুভূতিশীল হবেন জনপ্রতিনিধি এটাই স্বাভাবিক। তিনি হবেন সত্যবাদী। জনগণকে কখনো বিভ্রান্ত করবেন না। সঠিক কাজ করার জন্য সাহসী হবেন। জনপ্রিয়তার ভয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন না তিনি। এই গুণাবলি থাকলে একজন মানুষ জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবেন এবং তাদের জন্য কাজ করতে পারবেন। 

একজন জনপ্রতিনিধি যে কোনো সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার দায়িত্ব হলো, জনগণের মতামতকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। এই দায়িত্ব সফলভাবে পালন করার জন্য তাকে যথেষ্ট শিক্ষিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। 

শিক্ষা একজন জনপ্রতিনিধিকে বিভিন্ন দিক থেকে সমৃদ্ধ করে। প্রথমত, শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিনিধি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। তিনি রাজনীতি-অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখবেন। এই জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারবেন। শিক্ষা একজন মানুষকে যুক্তিবাদী এবং বিশ্লেষণাত্মক করে তোলে। 

তিনি বিভিন্ন সমস্যার কারণ এবং সমাধান খুঁজে বের করতে পারেন। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তা জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন। শিক্ষা একজন প্রতিনিধিকে ভালো বক্তা করে তোলে। তিনি জনগণের সামনে তার মতামত স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। এই ক্ষমতা একজন প্রতিনিধিকে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে এবং তাদের সমর্থন অর্জন করতে সাহায্য করে। শিক্ষা একজন প্রতিনিধিকে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে তোলে। তিনি জনসেবার প্রতি নিষ্ঠাবান হন এবং স্বার্থপরতা থেকে দূরে থাকেন।

শিক্ষা একজন জনপ্রতিনিধিকে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করে। তিনি নতুন প্রযুক্তি এবং পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। একজন প্রতিনিধি হলেন জনগণের কণ্ঠস্বর। তার ওপর দেশের উন্নয়নের বোঝা থাকে। তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকার দায়িত্ব বহন করবেন। 

বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি দেশের বিভিন্ন স্তরে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি। তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন এবং দেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে কাজ করার দায়িত্ব পালন করেন। জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন নির্ধারিত সময় অন্তর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। ভোটাররা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেন। একটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হলো তার জনপ্রতিনিধি। তারা জনগণের আকাক্সক্ষা ও চাহিদা অনুযায়ী নীতিনির্ধারণ ও কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু, যদি জনপ্রতিনিধি যোগ্যতা ও শিক্ষার দিক দিয়ে যথাযথ না হন, তাহলে তার প্রভাব সমাজের ওপর বিরূপ হতে বাধ্য।

অশিক্ষিত-মূর্খ জনপ্রতিনিধি সাধারণত জটিল সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হন এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও সীমিত হয়। তারা আধুনিক বিশ্বের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না এবং ফলে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে পুরোপুরি অংশ নিতে পারেন না।

অসৎ জনপ্রতিনিধিরা প্রায়শই ব্যক্তিগত স্বার্থকে রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তারা জনগণের সেবা করার পরিবর্তে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে। ফলে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি বৃদ্ধি পায় এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হয়। সুতরাং, জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময় যোগ্য ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। 

বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন একটি জটিল বিষয়; যা দেশের জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করেছে। এই আইনটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিদের কার্যকলাপ এবং অধিকারগুলো বিভিন্ন আইন ও বিধান দিয়ে নির্ধারিত।

বাংলাদেশের সংবিধানে জনপ্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে, বিশেষ করে ৬৬নং অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য কী কী যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।

এর মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত থাকা, কোনো রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত হওয়া বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া, নির্দিষ্ট কোনো অপরাধে দণ্ডিত না হওয়া, বিদেশি রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান হতে অনুদান গ্রহণ না করা ইত্যাদি। একইসঙ্গে এই অনুচ্ছেদে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন সে সম্পর্কেও উল্লেখ আছে। জনপ্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের মতামতকে প্রতিফলিত করে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে।

জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন স্তরে হতে পারে, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ সদস্য পর্যন্ত। এসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন দুর্নীতি করে তখন সমাজে সৃষ্টি হয় জটিল সমস্যা, বিশেষ করে যখন এটি সরকারের উচ্চপর্যায়ে ঘটে। বাংলাদেশের অসাধু জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতির প্রভাব সরাসরি জনগণের জীবনে পড়ে। দুর্নীতিবাজরা প্রায়ই জনগণের জন্য বরাদ্দ তহবিল আত্মসাৎ করে, ফলে স্বাস্থ্য-শিক্ষা, অবকাঠামো ইত্যাদির মতো সেবা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতির ফলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হতে পারে এবং দারিদ্র্য বাড়তে পারে। 

দুর্নীতিবাজরা অর্থ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ফলে সমাজে অসাম্য বৃদ্ধি পায়। দুর্নীতির কারণে জনগণের সরকারের প্রতি বিশ্বাস হারাতে পারে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এসব দুর্নীতি দেশের উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করে এবং দেশকে পিছিয়ে রাখে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন হলো একটি গণতান্ত্রিক মাধ্যম দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের প্রতিনিধিদের বেছে নিই, যারা আমাদের পক্ষে সরকার চালাবে এবং আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করবে। 

তাই এই নির্বাচনে ভোট দেওয়া আমাদের শুধু অধিকারই নয়, দায়িত্বও বটে। আমরা যে প্রতিনিধিকে বেছে নেব, তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই জনপ্রতিনিধিকে ভালোভাবে বুঝে বেছে নিতে হবে। আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে এমন প্রার্থীকে পছন্দ করতে হবে। প্রার্থী কারা, তাদের অতীত কী, তারা কী কী কাজ করেছেন, সমাজে তার কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা আছে, তারা আমাদের জন্য কী করতে পারবেন, এসব বিষয়ে জানা প্রয়োজন। 

প্রতিটি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে কী আছে, তারা কী করার অঙ্গীকার দিয়েছে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের জেনেবুঝে ভোট দিতে হবে যাতে আমাদের জন্য সঠিক প্রতিনিধিকে বেছে নিতে পারি।


লেখক: প্রকৌশলী, কলাম লেখক