বই ও বইমেলা জ্ঞান এবং আনন্দের সম্মিলন

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ০৬:৩০ পিএম

বই ও বইমেলা জ্ঞান এবং আনন্দের সম্মিলন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পৃথিবীতে যত রকমের মেলা হতে পারে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর মেলা হচ্ছে বইমেলা। আমার ধারণা পৃথিবীতে যত বইমেলা আছে তার মাঝে সবচেয়ে মধুর বইমেলা হচ্ছে আমাদের ফেব্রুয়ারির বইমেলা। 

কোনো কিছু না করে বইমেলার এক কোনায় চুপচাপ বসে থেকে শুধু মেলার মানুষজনকে দেখে আমি একটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব! মেলায় গুরুগম্ভীর বয়স্ক মানুষ যায়, কমবয়সি তরুণ-তরুণী যায়, বাবা-মায়ের হাত ধরে ছোট শিশুরা যায়, প্রত্যেকের ভাবভঙ্গি চালচলন আলাদা! কেউ বই কেনে, কেউ বই দেখে আবার কেউ শুধু ঘুরে বেড়ায়! 

আজকাল আমরা বইপড়া প্রায় ভুলে যেতে বসেছি। বই পড়ার দিকে আমাদের যতটা না মনোযোগ, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ ফেসবুকের প্রতি। ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেট আর মোবাইলের নেশায় আমরা প্রকৃত বইপড়ার আনন্দটাই ভুলে যেতে বসেছি।

বই হতে পারে উপহারের একটি উপকরণ। সেটাও যেন বিলীন হতে বসেছে। প্রিয়জনকে বেশি করে বই উপহার দিলে, নিজে বই কিনলে এবং নিয়মিত বই পড়লে, বইকে নিত্যসঙ্গী করতে পারলে যেমন নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, তেমনি সুস্থ, সুন্দর জীবনযাপন করা যায়। বই হলো প্রকৃত বন্ধু, বই হলো বিপদের বন্ধু- যাকে সবসময় কাছে পাওয়া যায়।

আজ সমাজে যত অপকর্ম, অন্যায়-অবিচার, ব্যভিচার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড- সবকিছুর মূল হলো জ্ঞানহীন, মূল্যবোধহীন সমাজব্যবস্থা। এর প্রধান কারণ হলো বই থেকে, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল বিনোদনের নামে আমাদের অনেক কর্মঘণ্টা কেড়ে নিচ্ছে। অথচ বিনোদনের এ আনন্দটুকু আমরা নির্ভেজালভাবে অনায়াসেই নিতে পারি বই পড়ার মাধ্যমে।

বইমেলা: ‘বইমেলা’ কিংবা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দু’টির যে কোনো একটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়।

মনুষ্যত্ব বিকাশের মাধ্যম : শিক্ষিত মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম রসদ হলো বই। বই হলো আয়নার মতো, যাতে আমাদের মনের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে। বইয়ের মতো অন্তরঙ্গ সহচর পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমাদের নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোকে বই ভরিয়ে তোলে। শিশু-কিশোরের কাছে বই দিকদর্শনের কাজ করে। তবে বইমেলা সাধারণভাবে অনুষ্ঠিত রথের মেলা, গাজন মেলা প্রভৃতি মেলাগুলো থেকে একটু স্বতন্ত্র। এটা বইপ্রেমী মানুষের মিলনতীর্থ।

মিলনমেলা : বইকে কেন্দ্র করে বইমেলা প্রাঙ্গণে এক হৃদ্য পরিবেশে সামাজিক মেলবন্ধন গড়ে উঠতে দেখা যায়। বইমেলায় প্রকাশক এবং পুস্তক বিক্রেতারা বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা বিষয়ের বই এনে বিভিন্ন রুচির মানুষের সামনে হাজির করেন। সাধ আছে সাধ্য নেই, এমন বইপ্রেমী মানুষ বইমেলায় এসে বিভিন্ন বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। 

বইমেলা জ্ঞানের অসীম ভান্ডারকে আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়। বইমেলার উপযোগিতা দ্বিবিধ। বইমেলায় পাঠক বিপুলসংখ্যক বইয়ের সান্নিধ্যে এসে যেমন আনন্দ পায়, তেমনি প্রকাশক ও বিক্রেতারা বাণিজ্য করার সুযোগে সামগ্রিকভাবে লাভবান হয়।

বই প্রিয় বন্ধু: মানব জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো বই। বই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ‘বন্ধু’ শব্দটি কতই মধুর! বন্ধুত্ব নৈকট্যের পরিচয়বাহী, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও হৃদ্যতা এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও মানসিক বন্ধনের প্রতীক। বন্ধুত্বের ফাটল বেদনাদায়ক হলেও অস্বাভাবিক নয়; যখন তখন লক্ষণীয়। 

অনেকে আজ বন্ধু কাল শত্রু। বন্ধু হয়ে বেঈমানি আর বিশ্বাসঘাতকতা কারো কাম্য নয়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হলেও অহরহ ঘটছে। শুধু বন্ধু কেন পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে বাবা-মা, ভাই-বোন, নিকট আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দূরত্ব। ছড়িয়ে পড়ছে হিংসা হানাহানি। 

পিপীলিকা যেমন বিপদে পানিতে পতিত গাছের পাতাকে বাঁচার অবলম্বন করে নেয়, তেমনি মানুষও বিপদ হতে বাঁচতে চায়, একটু আশ্রয় খোঁজে। প্রয়োজন হয় ভালো বন্ধুর। রক্ত মাংসে গড়া মানুষকে যেখানে বন্ধু হিসেবে ভেবেও সন্দেহ হয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল কাজ করে, সেখানে মানুষের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে বই। 

বই বিশ্বাসের অঙ্গ, জীবন যুদ্ধের হাতিয়ার। বই আমাদের অন্ধকার থেকে বের করে এনে আলোর দিকে নিয়ে আসে। বই অন্ধকার দূর করে সভ্যতার অগ্রগতি ঘটায়। তাই বই যেমন সভ্যতার রক্ষাকবচ তেমন সভ্যতার চাবিকাঠি। সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে বই অতীত ও বর্তমানের বহুমুখী জ্ঞান সম্পদকে বহন করে চলেছে।

পাঠাগার ভান্ডার: বই পড়া সব দেশের মানুষের কাছে একটি শখের বিষয়। বিভিন্ন রুচির মানুষ তাদের রুচিমাফিক বইয়ের পাতায় চোখ রেখে শখ চরিতার্থ করে। মানুষের পুরো মনটার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় সাহিত্যে। তাই আমাদের বই পড়তেই হবে। কারণ বই পড়া ছাড়া সাহিত্যপাঠ নেই। এই চর্চার জন্য একক গ্রন্থ সম্ভব নয় চাই লাইব্রেরি।

ধর্ম-দর্শন নীতি, বিজ্ঞানের চর্চা যথাক্রমে মন্দির, গুহা, ঘর এবং গবেষণাগারে করা গেলেও বিদ্যা সংগ্রহ ও চর্চার জন্য পাঠাগারই একমাত্র স্থান। 

বই আনন্দ ও মানসিক সুস্থতা: দেহের খাদ্য ভাত-রুটি, মনের খাদ্যের জোগান দেয় বই। মনের সুস্থতার ওপর অনেকাংশে দেহের সুস্থতা নির্ভর করে। মনকে সুস্থ রাখতে হলে ভালো বই পড়া দরকার। ভালো বই পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মানুষের মনে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে চেতনা জাগে।
তা ছাড়া আমরা দেখি যে, মানুষেরা বইকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে তাদের শত্রু কম। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের মন ভালো থাকে আমাদের মন প্রসন্নতায় ভরে যায়। তাই বই জ্ঞানের প্রতীক বই আনন্দের প্রতীক।

বই সংস্কার থেকে মুক্তি: মানুষ জীবনে তিনটি সহচর কামনা করে পুরুষ, স্ত্রী এবং বই। অবশ্য এই সহচর নির্বাচনে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। বইয়ের ক্ষেত্রে যার বই পড়তে ভালো লাগে তাকে সেই বই পড়তে দেওয়া উচিত। তাহলে তার কাছ থেকে নতুন চিন্তার ফসল পাওয়া সম্ভব। জীবনকে বুঝতে হলে অভ্যাসের সংস্কারের বেড়া ভাঙতে হলে বইয়ের সঙ্গ আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন। 

আমাদের সবার নিয়মিত বই পড়া উচিত। প্রতিটি পরিবারে একটি করে লাইব্রেরি থাকা দরকার। সেখানে থাকবে বিভিন্ন ধরনের বই। এর ফলে পরিবারের সদস্যরা সহজেই বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।

সবার হৃদয়ে জ্ঞানের আলো প্রবাহিত হবে। বই পড়ার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সব বিষয়ে কম-বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর বই যে জীবনের কত প্রশ্নের উত্তর জোগায়, তা বলে শেষ করার উপায় নেই। বই হচ্ছে মানুষের চিন্তার লিখিত ভাস্কর্য।

 বই ও বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের গর্বের অংশ। অধিক পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে সার্থক হয়ে উঠুক গ্রন্থমেলা। আমরা বই কিনব, বই পড়ব, প্রিয়জনকে বই উপহার দেব। বই হোক আমাদের নিত্যসঙ্গী। সার্থক হোক অমর একুশে বইমেলা।
লেখক: গবেষক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক 
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!