নিজেকে এগিয়ে রাখে বই

রেজাউল করিম খোকন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫, ১০:৩৫ এএম

নিজেকে এগিয়ে রাখে বই

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দিন দিন কি পড়ার অভ্যাস কমছে? তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, মোবাইল আর এসএমএস কালচারে যতটা মগ্ন, সে তুলনায় তাদের বই পড়ার সময় যেন একেবারে কমে গেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরতা বাড়ছে। 

আর যুক্তিহীন বহু প্রযুক্তির ভিড়ে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তি-বুদ্ধির রসদ যোগানো বই পড়ার অভ্যাসটি। সোফায় কিংবা নিজের প্রিয় বিছানায় শুরু যেখানে অনায়াসে দু’আড়াই ঘণ্টার একটা জমজমাট মুভি দেখা যায়, যেখানে কানের মধ্যে দুুটো ইয়ারফোন গুঁজে দিয়েই নিমিষেই শুনে ফেলা যায় অনেক অনেক প্রিয় গান, সেখানে এ যুগে বই পড়ার কষ্ট আর কে করতে চায় বলুন। 

তা ছাড়া মুভি দেখে, গান শুনে আপনার বিনোদনের চাহিদা যেভাবে মিটছে, বন্ধুদের আড্ডায় যেখানে সাম্প্রতিক সব মুভি কিংবা গানের আলোচনায় সক্রিয় অংশ নেওয়া হচ্ছে সেখানে বই পড়ে লাভটাই বা কী? আজকাল তেমন চিন্তাভাবনা পোষণ করেন অনেকেই। 

আবার কারো মনে এমন ভাবনার জন্ম হতে পারে যে, বই পড়াটা আসলে ওল্ড ফ্যাশনের। আজকের সময় ব্যস্তবতার আলোকে এসব চিন্তাভাবনা হয়তো সঠিক মনে হতে পারে অনেকের ক্ষেত্রে। তাই বলে এসব অজুহাত দিয়ে বই পড়ব না বা বই পড়ার প্রয়োজন নেই এমন ভাবাও ঠিক নয়। 

ইউটিউব, এফএম রেডিও কিংবা ডিভিডি, ইন্টারনেট, ফেসবুকের এই যুগেও মননশীল বই, গল্প উপন্যাস নতুন কিছু সন্ধান দিতে পারে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন অমর একুশে বইমেলা বা ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সবাই মিলে বই পড়ার উপদেশ দেয় তাদের জন্যও বিষয়টা নতুন করে খানিকটা ভাবনার বৈকি। 

আপনার আশপাশে কেউ বই পড়ে না, কিংবা এখন ইউটিউবে মুভি দেখা, গান শোনা, ফেসবুকে ঢুঁ মারা মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা বিনোদন বা অবসর কাটানোর জন্য বেশি সহজলভ্য উপায় ইত্যাদি যুক্তিতে হয়তো আপনিও সেভাবে বই পড়ার চেষ্টাটা কখনো করে দেখেননি। কিন্তু অন্যের কথা না শুনে যদি বছরে অন্তত দু’একটা ভালো বইও পড়ে দেখতেন তাহলে হয়তো আজ এই লেখাপড়ার প্রয়োজন হতো না আপনার। 

তা ছাড়া অন্যের কথা শুনে বা অন্যরা করে না এই অজুহাতে বই পড়ার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করাটাও হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অনেকেই হয়তো যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারেন পড়াশোনায় টিকে থাকার প্রয়োজনে এমনিতেই অনেক অনেক পাঠ্য বইপত্র পড়তে হয় তাতেই আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত। 

তার উপর বাড়তি কোনো পড়ার ঝামেলায় নিজেকে জড়ানো মানেই বাড়তি সমস্যায় পড়া। তবে এসবই কিন্তু যারা বই পড়ে না তাদের খোঁড়া যুক্তি। নইলে প্রতিটি গল্প উপন্যাসের বই মনের জানালাটাকে যেভাবে প্রশস্ত করে সেই জানালা গলিয়ে পৃথিবীটাকে দেখা যায় ছোট পর্দায় চাইতেও বড় আঙ্গিকে। 

আবার আজ আপনার যে বন্ধুরা সবার আগে কোনো মুভি দেখে গরগর করে কাহিনির ‘টুইস্ট’ বলে বাহবা কুড়াচ্ছে তাদের সামনে একবার আপনার বই পড়ুয়া জ্ঞানটা জাহির করেই দেখুন না। নেহায়েত বোকা কিংবা অহঙ্কারী কেউ না হলে আপনার এই জ্ঞান বন্ধুদের মুগ্ধ করতে বাধ্য। 

আবার পড়ার অভ্যাসটা ভালো করে রপ্ত করতে পারলে সেটা আখেরে কাজ দেবে আপনার একাডেমিক পারফরমেন্সেও। এ কথা হয়তো ঠিক যে আজকালকার প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনের মাঝে বই সংগ্রহ করে বা বই কিনে পড়াটা মোটেও সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু একবার চেষ্টা করে হলেও নিজের রুচিমতো একটা বই যদি আপনি পড়তে পারেন তবে ‘বই পড়া’র প্রেমে না পড়ার কোনো কারণই নেই। 

এ ক্ষেত্রে আপনার পাল্টা যুক্তি থাকতে পারে, এতকিছু থাকতে বইয়ের প্রেমেই কেন জোর করে পড়তে হবে। উত্তরটা যদি একবাক্যে জানতে চান তাহলে বলব, একটা ভালো বই আপনাকে যেভাবে জীবন নিয়ে ভাবতে শেখাবে মুভি কিংবা ফেসবুকে ঢুঁ মেরে, হেডফোন লাগিয়ে এফএম রেডিও কিংবা এমপি থ্রি শুনে তা পারবেন না কোনোভাবেই সেগুলোর সে সাধ্য নেই বললেই চলে। 

টিএনএজ বয়সের হই হুল্লোড়ের মাঝে জীবন নিয়ে ভাববার প্রয়োজনও হয়তো আপনাদের নেই। কিন্তু বই পড়া মানেই মুখ গম্ভীর করে ইন্টেলেকচুয়াল ভাব নেওয়া কিন্তু নয়। বরং একটা অ্যাকশন মুভির পরিবর্তে ফেলুদা, জেমস বন্ড বা মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। 

একইভাবে এফএম রেডিওর গানের চাইতে কোনো অংশে কম রোমান্টিক নয়, আমাদের লেখকদের লেখা গল্প-উপন্যাগুলো। তা ছাড়া বই পড়তে গিয়ে টিভি, মুভি, গান, ফেসবুক ইত্যাদিকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে তারও কোনো যুক্তি নেই। বরং এসব কিছুর পাশাপাশিই বই পড়া চলতে পারে। 

যেখানে আপনার আর সব বন্ধু-বান্ধবীই মুভি আর গানের ভাবনায় আপনার চাইতে কোনো অংশে কম যায় না। সেখানে বই পড়া আপনাকে একটা দিকে হলেও এগিয়ে রাখতে পারে অন্য সবার চেয়ে আর বই কেন পড়বেন এ এগিয়ে যদি তার পরেও আপনার মনে দ্বিধা থাকে তাহলে দ্বিধা কাটাতে আপনি না হয় আপনার নিজের পছন্দের আর ভালোলাগার একটা ব্যতিক্রমধর্মী জায়গা তৈরি করতে বরং এসবের পাশাপাশি অন্য কোনো বই একবার পড়েই দেখুন না।

বই পড়ার অভ্যাস গড়বেন যেভাবে
এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হলো সেগুলোকে দয়া করে উপদেশ বলে মনে করবেন না। যারা মনে করে আমাদের লাইফস্টাইলে বই পড়ার অভ্যাসটি থাকা জরুরি অথচ বই পড়তে গেলেই আলসেমি লাগে, ঘুম পায় তাদের জন্য এখানে বেশ কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হলো।

প্রতিটি মানুষেরই একটা স্বতন্ত্র রুচিবোধ আছে। কাজেই আপনার বড় ভাই কিংবা আপনার বন্ধুর কাছে যে বইটি ভীষণ রকম ভালো লেগেছে সেটি আপনার কাছে এতটা ভালো না-ও লাগতে পারে। কাজেই কারও কাছে কোনো বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে সেই বইটি যদি আপনার ভালো না লাগে তাহলে বই পড়াটাকে মোটেও দোষারোপ করা যাবে না।

বই পড়া শুরু করার জন্য প্রথমেই নিজের রুচির দিকে খেয়াল রেখে বই কিনে তা পড়তে শুরু করুন। এক বসায় পড়া শেষ করতে হবে-বই পড়া বিষয়টাকে মোটেও এভাবে রুটিন হিসেবে নেওয়া চলবে না। বরং কোনো কাজের ক্ষতি না করে যখন যতটুকু পড়তে ভালো লাগে ততটুকু পড়ুন।

একটা দু’টো বই পড়ার পর যদি বিষয়টা আপনার মনে ধরে যায় তাহলে আপনার পড়া বইগুলোর নাম এবং লেখকের নাম একটা খাতায় টুকে রাখুন। চাইলে এ বইগুলো থেকে আপনার ভালো লাগা কিছু লাইনেও একটা খাতায় লিখে রাখতে পারেন।

পাঠ্যবই পড়ার সময় গান শোনা বা টিভি দেখা যেমন অপরাধ তেমনি এ সময়ে গল্প-উপন্যাস পড়াটাও বর্জনীয়। কাজেই বই পড়ার জন্য আপনার অবসর সময় বা ছুটির দিনগুলোকেই বেছে নিন।

একটা গল্প বা উপন্যাস পড়ে আপনার ভালো না লাগা মানেই কিন্তু এই নয় যে, বিশ্বের যাবতীয় বই-ই একই রকম একঘেঁয়ে। কাজেই বই পড়াকে অর্থহীন বলার আগে কয়েক রকম বই পড়ে দেখুন কোনটি আপনার কতটা ভালো এক উপলব্ধিতে জাগিয়ে তুলুন। মনে রাখবেন, বই আপনার মনের আকাশকে অনেক বড় করে তুলতে পারে। আপনাকে সত্যিকার ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে আমরা কত সমস্যার মুখোমুখি হই নিত্যদিন। সেই সব সমস্যা মোকাবিলায় নিজের মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার জন্য বই আপনাকে নানাভাবে শক্তি জোগাতে পারে। আত্ম উন্নয়নমূলক বই পড়ে আপনি নিজের মধ্যে সেই শক্তি জাগিয়ে তুলতে পারেন। 

বিভিন্ন বড় বড় লেখকদের গল্প-উপন্যাসের জীবনবোধ সম্পর্কে নিজস্ব চেতনা জাগানোর আলাদা উদ্দীপনা থাকে। যে চেতনায় আপনি হয়ে উঠতে পারেন অন্য একজন মানুষ। অতএব, বিভিন্ন লেখকের গল্প-উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করুন। নিজেকে অন্য সবার চেয়ে ভিন্ন করে এগিয়ে রাখতে পারে বই।
লেখক:  অবসরপ্রাপ্ত  ব্যাংকার, কলাম লেখক
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!