সুষম উন্নয়ন (Equitable Development) ও সমাজ কল্যাণ (Social Welfare) পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত দুটি ধারণা। আধুনিক বিশ্বে উন্নয়নের সংজ্ঞা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি এমন একটি কাঠামো, যেখানে সমাজের প্রতিটি শ্রেণি, গোষ্ঠী ও অঞ্চল সমান সুযোগ ও সুবিধা লাভ করতে পারে। সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমাজে ন্যায়বিচার, সমতা ও মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
বর্তমানে, বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সামাজিক অসমতা, দারিদ্র্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বৈষম্য, এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বক্ষ্যমাণ লেখায় সুষম উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ এবং কীভাবে একটি ন্যায়সংগত ও কল্যাণমুখী সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব, তা অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হবে।
সুষম উন্নয়নের সংজ্ঞা ও প্রয়োজনীয়তা
সুষম উন্নয়ন হলো এমন একটি উন্নয়ন কৌশল, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের প্রতিটি স্তরে সমানভাবে বণ্টিত হয় এবং কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠী উন্নয়নের বাইরে থেকে যায় না। এর মূল লক্ষ্য হলো-
আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস: শহর ও গ্রামের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনা।
সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা: যাতে প্রতিটি নাগরিক সমান সুযোগ পায়।
নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন: সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবার সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
পরিবেশ সংরক্ষণ: টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করা।
বর্তমান বিশ্বে, উন্নয়নের মূল লক্ষ্য কেবলমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন নয়; বরং এটি হতে হবে মানবিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ভারসাম্যপূর্ণ। যদি উন্নয়ন শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য হয়, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা সমাজে বৈষম্য তৈরি করবে, যা অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
সমাজ কল্যাণে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু
সমাজ কল্যাণের ধারণা এমন একটি সমাজ গঠনের ওপর ভিত্তি করে, যেখানে প্রতিটি নাগরিক মৌলিক অধিকার ও সুযোগ লাভ করে। এটি শুধু দারিদ্র্য বিমোচন বা অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং একটি সমাজে ন্যায্যতা, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।
সমাজ কল্যাণের কয়েকটি প্রধান উপাদান
গুণগত শিক্ষা ব্যবস্থা: শিক্ষা হলো মানুষের ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি। মানসম্মত ও সমান সুযোগসম্পন্ন শিক্ষা সমাজের অসমতা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
স্বাস্থ্যসেবা: উন্নত স্বাস্থ্যসেবা একটি জাতির কর্মক্ষমতা ও সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক।
সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা: প্রবীণ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
সুশাসন ও ন্যায়বিচার: একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের জন্য প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন অপরিহার্য।
নিরাপদ বাসস্থান ও কর্মসংস্থান: মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত না হলে সমাজ কল্যাণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
সুষম উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণের পথে চ্যালেঞ্জসমূহ
যদিও আধুনিক বিশ্বে সুষম উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে, তবুও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান:
আর্থ-সামাজিক বৈষম্য: ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।
দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব: প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব সুষম উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
পরিবেশগত সংকট: উন্নয়নের ফলে পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সমাজ কল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রযুক্তিগত বৈষম্য: ডিজিটাল বৈষম্য নতুন ধরনের সামাজিক অসমতা তৈরি করছে।
সমাধান ও সুপারিশমালা
সুষম উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনা
সরকারকে এমন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা সমাজের প্রতিটি শ্রেণির কথা বিবেচনায় রাখে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন
মানসম্মত ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
তরুণদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন।
নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসন
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি করা।
দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, সবুজ শহর ও টেকসই কৃষির প্রচলন করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
সামাজিক সুরক্ষা জোরদার
বয়স্ক ভাতা, শিক্ষা বৃত্তি, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা বাড়ানো।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করা।
সুষম উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করা একটি দেশের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল জিডিপি বৃদ্ধি বা অবকাঠামো উন্নয়নই যথেষ্ট নয়; বরং একটি ন্যায়সংগত, মানবিক ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, এবং পরিবেশগত ভারসাম্য।
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে। এই যাত্রায় যদি সুষম উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া যায়, তবে এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজে পরিণত হতে পারবে। একমাত্র সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা সত্যিকারের সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
লেখক: অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, কলাম লেখক।
আপনার মতামত লিখুন :