প্রথম ভালোবাসার নাম হোক বই

মোমিন মেহেদী

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৫, ০৯:১১ এএম

প্রথম ভালোবাসার নাম হোক বই

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ মেলা লেখক-পাঠক এবং প্রকাশকদের প্রাণের মেলা। মেলাকে ঘিরে বাংলা একাডেমির মহাব্যস্ততা, নানান দিক সামলাতে হয়। বছরের ৯০ শতাংশ বই প্রকাশিত হয় মেলাকে উপলক্ষ্য করে। 

ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে হাজার হাজার নতুন বই আসছে মেলায়, যার অধিকাংশই নতুন লেখকদের। নতুন লেখকদের মাঝে দেখা যাচ্ছে প্রথম প্রেমে পড়ার মতো এক ধরনের চাপা উত্তেজনা। কিন্তু তবুও দিন শেষে বই বিক্রি বাড়ে না; বাড়ে উত্তেজনার পর উত্তেজনা।

লেখক থেকে প্রকাশক হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক বিষয়টি একটু কম করেই দেখি। বেশিরভাগ বইয়ের ক্ষেত্রে বাণিজ্য করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের গুটিকয়েক লেখকের বইয়ে একটু বাণিজ্য হয়। বাকি লেখকদের মধ্যে যেমন ধরা যাক, ৭০ জনের বই প্রকাশ হচ্ছে ৭০টি। 

সেখানে ৬০টি বই বাণিজ্যের বাইরে থাকবে। মাত্র ১০ লেখকের বই থেকে বাণিজ্য যা হওয়ার হবে। এখন আপনি বলতে পারেন, তা হলে আমরা এত বই প্রকাশ করি কেন! এর কারণ হচ্ছে, আমরা যদি ওইসব লেখকের বই প্রকাশ না করি, তা হলে কীভাবে জানব কে ভালো লেখেন এবং কীভাবে তারা ভালো লেখক হবেন। 

তাই ভালো লেখক তৈরি করার জন্য আমাদের এসব লেখকের বই প্রকাশ করতে হয়। এ জন্যই আপনারা দেখছেন প্রতিবছর মেলা থেকে কেউ না কেউ জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। আর জনপ্রিয় হতে তো সময় লাগবে! প্রথম দিনেই তো কেউ জনপ্রিয় হয় না। হুমায়ূন আহমেদ তো একদিনে জনপ্রিয় লেখক হয় ওঠেননি। 

ফলে নতুনদের সুযোগ করে দিতে হবে। ওই সুযোগ না পেলে কীভাবে জনপ্রিয় হবেন তারা। এ ছাড়া পাঠক ভালো লেখকের বই কম পড়েন। পাঠক একটু চকচকে বই পছন্দ করেন। এই মানসিকতা থেকে বের হওয়াটা খুব বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। 

কেননা, পাশ্চাত্যের ৯০ ভাগ বই-ই লেখার মান বিবেচনায় প্রকাশিত হয়, ঝকঝকে তকতকে পৃষ্ঠা বা প্রচ্ছদকে মাথায় রেখে নয়। সেই সঙ্গে বলতে চাই- সারা দেশে সহিংসতা যখন বাড়ছে, তখন কেবলই মনে হচ্ছে যে, জাতি ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছে। অথচ ভালোবাসা হলো এক ধরনের অদৃশ্য সম্পর্ক যা মানুষের হৃদয়ে গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। 

এটি শুধু রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমেও ভালোবাসা ফুটে ওঠে। ভালোবাসা এমন এক শক্তি যা মানুষকে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে, সাহায্য করতে, এবং মন্দের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনুপ্রাণিত করে। 

ভালোবাসা কখনো কখনো বিনিময়হীন, নির্দ্বিধায় এবং নিঃস্বার্থ হয়। এটি একে অপরকে বোঝা, সঙ্গ দেওয়া এবং অন্যের জন্য চিন্তা করার অনুভূতি নিয়ে গঠিত। তাই, ভালোবাসা কেবল একটি অনুভূতি নয়, বরং এটি একধরনের আত্মদান, শ্রদ্ধা এবং সামগ্রিক মানবিকতা। 

মনে রাখা দরকার, ভালোবাসা আর বই মানুষের অন্যতম সেরা বন্ধু। জ্ঞান অর্জন, কল্পনার বিকাশ, মনের খোরাক এবং আত্ম-উন্নয়নের জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। যুগ যুগ ধরে বই আমাদের সভ্যতার অন্যতম প্রধান বাহক হিসেবে কাজ করেছে। মানুষ তার চিন্তা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং জ্ঞানের ভান্ডার বইয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করেছে। 

বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা কেবল বিনোদন নয়, এটি এক গভীর আবেগ ও আত্মিক সম্পর্কের প্রতিফলন। এই লেখায় বইয়ের প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব, তার প্রভাব এবং কীভাবে বই আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে  সেদিকে একটু আলোকপাত করা হবে।

স্বজন, প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি বইয়ের প্রতি ভালোবাসার অনেক কারণ রয়েছে। এটি শুধু জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং আত্ম-উন্নয়ন, কল্পনাশক্তির বিকাশ এবং মানসিক প্রশান্তিরও উৎস বই আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ করে দেয়। 

ইতিহাস-বিজ্ঞান, সাহিত্য-দর্শন, ধর্ম- প্রত্যেকটি বিষয়ে অসংখ্য বই রয়েছে যা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। একটি ভালো গল্প বা উপন্যাস পাঠকের কল্পনার দুয়ার খুলে দেয়। বই পড়লে আমরা গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে আত্মিকভাবে যুক্ত হতে পারি এবং তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারি। 

ব্যস্তজীবনের ক্লান্তি দূর করতে বই পড়া দারুণ উপকারী। একটি ভালো বই মানুষের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং প্রশান্তি এনে দেয়। আত্ম-উন্নয়নমূলক বই আমাদের চিন্তাধারা গঠন করে, ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে এবং আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। 

অবসর সময়কে সৃজনশীলভাবে কাজে লাগানোর জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। এটি সময়কে অর্থবহ করে তোলে। যারা বই পড়ার প্রতি আসক্ত নন, কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে চান, তাদের জন্য কিছু কথা শেয়ার করা যেতে পারে:
যদি কেউ বই পড়ায় নতুন হন, তবে ছোট গল্পের বই বা সহজ ভাষার উপন্যাস দিয়ে শুরু করা উচিত। প্রতিদিন ৩০ মিনিট বই পড়ার জন্য বরাদ্দ রাখলে ধীরে ধীরে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠবে। 

সব বই সবার ভালো লাগবে না, তাই নিজের পছন্দের বিষয়বস্তুর বই পড়লে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বন্ধু বা বইপ্রেমী সংগঠনের সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা করলে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। নিরিবিলি পরিবেশে মনোযোগ দিয়ে বই পড়া সম্ভব, যা পাঠের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়।

বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের ফলে বই পড়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ই-বুক এবং অডিওবুক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বই মানে জ্ঞানের ধারাপাত। তাই বইকে সবার আগে রাখুন, প্রিয়তমাকে বই দিন, সন্তানকে বই দিন, মা-বাবা বা অভিভাককেও বই উপহার দিন। 

এতে করে আবারও প্রমাণিত হবে- বই শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। জ্ঞানার্জন, কল্পনার বিকাশ, আত্ম-উন্নয়ন, এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রযুক্তির যুগে বই পড়ার অভ্যাস কিছুটা পরিবর্তিত হলেও, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কখনো কমবে না। 

তাই, নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোন। এই আলোয় সফল হবে ভালোবাসার স্বচ্ছ পথচলা। সেই সঙ্গে অনুরোধ ভালো বই পড়ার পাশাপাশি সুন্দরের পথে হাঁটুন, সব অসুন্দরকে ‘না’ বলুন নিমগ্ন ভালোবাসায়। বিভিন্ন ধরনের লেখককে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। 

মেলাবিন্যাস শুধু মেলার মধ্যে করলেই হবে না। মেলাটিকে আরও সুন্দর করতে হলে এর সঙ্গে কিছু উপসর্গের প্রয়োজন আছে। যেমন ধরুন, মেলায় গাড়ি পার্কিংয়ের একটি ব্যবস্থা রাখার দরকার। মেলায় প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন। কিন্তু সবাই বই কেনেন না। মেলায় আসা ১০০ জনে ১০ জনের কাছে বই বিক্রির আশা করাই যায়।

বতর্মানে পাঠক বইবিমুখ, কেউ বই কিনতে চায় না। তবু কিছু সভ্য মানুষ পাঠক হয়ে ওঠেন প্রতিদিন। এই বনেদি পাঠক এখনো বই পড়ে তবে তারা আস্থা রাখে স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের উপরই। কারণ অনেক পাঠক চোখ ধাঁধানো মলাটের ভেতর তেমন কোনো মসলা খুঁজে পাননি, তাই তারা নতুন লেখকদের বই কিনতে চান না এ কথা মানতেই হবে। 

তবে নতুনদের ভেতর অনেক লেখক আছেন প্রতিশ্রুতিশীল। বতর্মান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকষর্তার এ যুগে মানুষ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক, অনেক বেশি ব্যস্ত তাই প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগে মানুষের অবসর কাটত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, গল্প করে কিংবা বই পড়ে বা গান শুনে, এখন সময় কাটায় নেটে ঢুকে, স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে গেমস খেলে, এজন্য স্বাভাবিকভাবেই বই পড়ায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। 

আবার যারা বইপ্রেমী তারা নেট থেকে বিভিন্ন বই ডাউনলোড করে সহজেই পড়ে নিচ্ছে, যার কারণে বইয়ের কপি কম বিক্রি হচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে যে, তরুণ সমাজ এখন বইয়ের প্রতি মন দিচ্ছে। তাদের প্রতিদিনের যাপিতজীবনের একঘেয়েমি দূর করতে আবার ফিরে আসছে বইয়ের পাতায়। 

নিজে থেকে খুঁজে নিচ্ছে প্রগতিশীল লেখকদের বই। অন্যদিকে শুধু নাম, যশ, খ্যাতির মোহে আকৃষ্ট হয়ে নামের পাশে কবি, সাহিত্যিক বিশেষণ ব্যবহারের লোভে পড়ে, নিজেকে সেভাবে তৈরি না করেই অনেকে গাঁটের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করে থাকেন। তারপর মানহীনতার কারণে বা পরিচিতির অভাবে বই রয়ে যায় অবিক্রীত। হতাশ হয়ে পড়েন লেখক। 

দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে মেধা খাটিয়ে একটি বই লিখে যখন আবার নিজের টাকায় প্রকাশ করার পরও এক কপি বিক্রি হয় না এর চেয়ে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে? কথা হচ্ছে লেখকরা লিখে যাবেন, প্রকাশকরা তাদের প্রয়োজনেই ভালোমানের লেখক খুঁজে বের করে বই প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবেন। 

কিন্তু না, হচ্ছে তার উল্টো। লেখকরা বরং ধরনা দিচ্ছেন প্রকাশকের কাছে, আর সুযোগটা ভালোভাবেই নিচ্ছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রকাশনীগুলো স্বাভাবিকভাবেই কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়, আর তা যদি হয় নতুন লেখক তবে তো কোনো কথা-ই নেই। এখন যা হচ্ছে একজন লেখকের সারাবছর মেধা এবং শ্রমের পাশাপাশি হাজার হাজার টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সৃজনশীল সবসময়। আর সেই সৃজনশীলতার পথ ধরে সহিংসতা-মব-অন্ধতা রুখে দিতে শুদ্ধ মানুষ তৈরিতে বই তথা সাহিত্যের বিকল্প কিছুই নেই। আর এ সাহিত্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে লেখক এবং প্রকাশক উভয়কেই সততার পরিচয় দিতে হবে। 

লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক কারো থেকে কারো গুরুত্ব কম নয়। পাঠকের প্রতি লেখকের যেমন দায়বদ্ধতা রয়েছে, প্রকাশকেরও উচিত ভালো লেখক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে পথচলা লোভ-মোহহীন নিরন্তর। 

পাঠকেরও উচিত দর্শক নয়; প্রকৃত পাঠক হয়ে বেশি বেশি বই ক্রয় করা। সেই সঙ্গে বইমেলায় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্ম হোক তা চাই না, চাই না অলেখক-কুলেখকরা লেখক-প্রকাশকদের সঙ্গে কোনোরকম বাজে আচরণ করুক।

ভুল, অন্যায়-অপরাধের ঊর্ধ্বে কোনো মানুষ বর্তমানে নেই। অতএব, অপরাধী হলে বিচারের আওতায় আনা হোক কোনোভাবেই যেন অপমান-অপদস্ত করা না হয়। 

আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে সবাইকে- হরহামেশা কাউকে আস্তিক-নাস্তিক বলার মধ্য দিয়ে মবকে যেন অন্তত বইমেলায় কেউ উসকে না দেয়; এ বিষয়ে প্রকৃত মানুষ-সচেতন মানুষদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি।


লেখক: প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক-কলাম লেখক

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!