ভাষা একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বাহক। মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ভাষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাতৃভাষা মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি ও সৃজনশীলতার প্রধান মাধ্যম। ভাষার মধ্য দিয়েই ব্যক্তি ও জাতির পরিচিতি গড়ে ওঠে।
কিন্তু বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির প্রসার ও নানা সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে বহু ভাষা বিপন্নতার মুখে পড়েছে। ভাষার সংরক্ষণ, চর্চা, বিকাশ ও গবেষণা তাই এক অনিবার্য দায়িত্ব হয়ে উঠেছে। বিশেষত বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে, যার জন্য একদল বীরসন্তান রক্ত দিয়েছেন, তার যথাযথ সংরক্ষণ ও বিকাশ আমাদের জাতীয় কর্তব্য।
মাতৃভাষাচর্চা: ভাষার জীবনীশক্তির আধার
ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার দৈনন্দিন চর্চা। মাতৃভাষার চর্চা যদি পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে না হয়, তবে ভাষাটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে কিছু দিক চর্চার গুরুত্ব রয়েছে-
পারিবারিকচর্চা: শিশুর ভাষা শেখার প্রথম স্থান পরিবার। যদি অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলেন, গল্প বলেন, কবিতা বা ছড়া শেখান, তবে শিশুদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ গড়ে উঠবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষার গুরুত্ব: প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহার করলে শিশুদের শিখন-প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর হয়। অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে শিশুদের সৃজনশীলতা ও বোধগম্যতা বাড়ে।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভাষাচর্চা: সাহিত্যের মাধ্যমে ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহ অব্যাহত থাকে। বাংলা সাহিত্য, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষার শুদ্ধচর্চা হয়।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মাধ্যমে মাতৃভাষার ব্যবহার: বর্তমান যুগ প্রযুক্তির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওয়েবসাইট, অনলাইন পাঠাগার, ই-বুক ও ডিজিটাল কনটেন্টে মাতৃভাষার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহী হয়।
ভাষার সংরক্ষণ: জাতির অস্তিত্ব রক্ষার শপথ
ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির সংস্কৃতির ধারক। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর ভাষা গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিবছর বহু ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। ভাষা সংরক্ষণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে-
ভাষার নথিবদ্ধকরণ: বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার, ব্যাকরণ, আঞ্চলিক ভাষার শব্দ ও ধ্বনিগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষার শব্দ ও উচ্চারণ সংরক্ষণ করা জরুরি।
ভাষার ডিজিটাল সংরক্ষণ: প্রযুক্তির ব্যবহার করে ভাষার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা যেতে পারে। বাংলা ভাষার ই-আর্কাইভ, ডিজিটাল অভিধান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক ভাষাগত গবেষণা বাড়াতে হবে।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ: ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতি জড়িত। লোকগান, লোককথা, প্রবাদ-প্রবচন, পালাগান, বাউল গান ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভাষার শিকড় সম্পর্কে সচেতন হয়।
নতুন প্রজন্মকে ভাষাপ্রেমী করে তোলা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্যোগে ভাষার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে শিশুদের ভাষার মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।
ভাষার বিকাশ: নতুন চেতনার জন্ম
ভাষা যদি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারে, তবে সেটি দুর্বল হয়ে পড়ে। ভাষার স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে-
নতুন শব্দ ও পরিভাষা সংযোজন: বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও বিশ্বায়নের ফলে প্রতিনিয়ত নতুন শব্দের প্রয়োজন হয়। বাংলা ভাষায় নতুন প্রযুক্তিগত পরিভাষা তৈরি করতে হবে, যাতে বিদেশি শব্দের আধিপত্য কমে।
অভিধান ও ব্যাকরণ আধুনিকায়ন: ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করতে বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণ সময়োপযোগী করা প্রয়োজন।
প্রযুক্তির সঙ্গে ভাষার সমন্বয়: বাংলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভাষা অনুবাদ, স্বর ও পাঠ্য রূপান্তর প্রযুক্তি উন্নত করতে হবে, যাতে বাংলা ভাষা ডিজিটাল বিশ্বে প্রতিযোগিতার উপযুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলার প্রসার: জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্বে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বেড়েছে। এখন এর কার্যকারিতা বাড়াতে হবে।
ভাষা গবেষণা: জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোপান
ভাষার সঠিক চর্চা, সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণা ছাড়া ভাষার প্রগতি সম্ভব নয়। ভাষা গবেষণায় নিম্নবর্ণিত দিকগুলোতে মনোযোগ দেওয়া উচিত-
বাংলা ভাষার ইতিহাস ও বিবর্তন: ভাষার উৎস ও পরিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ ভাষানীতি নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও ভাষাবিজ্ঞান: ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব, ধ্বনিবিজ্ঞান, ভাষার সামাজিক ব্যবহার ও রূপান্তর নিয়ে গভীর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
প্রযুক্তিতে বাংলার ভূমিকা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং ও ভাষা প্রক্রিয়াকরণে বাংলা ভাষার উন্নয়ন করা জরুরি।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক বিশ্লেষণ: বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধের আধুনিক বিশ্লেষণ করতে হবে, যাতে ভাষার নতুন মাত্রা প্রকাশ পায়।
অন্তবাণী
ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি জাতির পরিচয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক। মাতৃভাষাচর্চা, সংরক্ষণ, বিকাশ ও গবেষণা একদিনের কাজ নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বাংলা ভাষা এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারী। আমাদের ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রক্ষায় বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষার আধুনিকায়ন করতে হবে, পাশাপাশি ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সচেতনতা গড়ে তুললেই আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্বসভায় সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারব।
লেখক: প্রাবন্ধিক, অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার