ভাষা এক বহমান নদীর মতো। মানুষ বেঁচে থাকলে ভাষার দরকার হয়। নদী যেমন চলতে চলতে যদি বাধা পায় তাহলে থেমে যায়। ভাষাও তেমন। চলতে চলতে বাধা পেলে থেমে যাওয়া ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। মা, মাতৃভাষা, দেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে থাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। থাকে দায়বদ্ধতা।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ভাষার স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে অনেক দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। সেই সময় থেকে মাতৃভাষা নিয়ে চর্চা, গবেষণা হচ্ছে। তবে আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। সর্বত্রই ভাষার ভুল বানান, শব্দের সঠিক প্রয়োগের অভাব এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা মিশিয়ে বাংলার শুদ্ধতা বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
বাংলা হলো একটি মধুরতম ভাষা। বিভিন্নভাবে ভাষার বিকৃতি হচ্ছে আমাদের দেশে। মোবাইলের ম্যাসেজে, ফেসবুকের স্ট্যাটাসে। দোকানে দোকানে ইংরেজি নাম দেখে মনে হয় ইংরেজি নামেই তারা বেশি স্বস্তি পায়! অথচ ইচ্ছা করলেই নামগুলো বাংলায় হতে পারত। আমরা আজ বাংলায় কথা বলছি সে তো গর্বের বিষয়। পরভাষা চাপিয়ে দিয়ে বাঙালির মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল পাকিস্তাান শাসকগোষ্ঠী।
প্রতিবাদে বাংলা মায়ের সাহসী ছেলেরা রাস্তায় নেমে, আন্দোলন করে, বুকের রক্ত দিয়ে নিজের ভাষা ছিনিয়ে এনেছিল। এরপরও ভাষা সঠিকভাবে চর্চায় এত অনীহা কেন থাকবে? একটি অবহেলায় ভুল শব্দ যে দৃষ্টিকটু তা বুঝতে হবে? এ ছাড়া আরও অনেকভাবেই ভাষার বিকৃতি হচ্ছে।
কিন্তু বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে আরও পদক্ষেপ ও সচেতনতা জরুরি। আামদের ভাষা প্রাপ্তির ইতিহাস রক্তের, আন্দোলনের। ফেব্রুয়ারি এলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের কথা। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোতে বাংলা ভাষা নিয়ে ফিচার ও টক শো অনুষ্ঠিত হয়। মনে হয় সব সমস্যার সমাধান হয়তো এ বছর করা হবে। কিন্তু হয় না।
স্বাধীন দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন করা হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। তবে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকেছে বরাবর। প্রতিবছর ঘুরে ফিরে ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষাচর্চা এবং সর্বস্তরে প্রয়োগের বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। তারপর সারা বছর আবার সেই একই অবস্থা।
দেশের শহরে বড় হওয়া প্রজন্মের কাছে বাংলা প্রাধান্য না পেয়ে ইংরেজিটাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। শিক্ষার্থীদের দেখি সকাল বিকেল ইংরেজি গণিত বিজ্ঞান নিয়ে প্রাইভেটের পর প্রাইভেট পড়ছে। তা পড়ুক। অন্য ভাষা বা অন্য বিষয়ে চর্চায় তো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। একটুখানি সময় মায়ের ভাষার পেছনে ব্যয় করা জরুরি।
কী মধুর যে এই ভাষা তা নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তা তো আর হয়ে ওঠে না। পৃথিবীর ২০ কোটিরও অধিক লোক বাংলায় কথা বলে। এটা ভাবতে ভালো লাগে। অন্য ভাষা রপ্ত করতে গেলেও নিজবুলিটা ভালোভাবে আয়ত্ত করা প্রয়োজন, সে কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। বাইরের দেশের ভাষা শেখার একটা গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু তা কখোনই মাতৃভাষাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। যদি তা হয় সেটা হবে আত্মঘাতী।
শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারা একজন বাঙালির দাম অনেক। কবি সেই কবেই মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করে গেছেন। প্রথম জীবনে পরভাষায় সাহিত্যচর্চাকারী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বুঝতে পেরেছিলেন শিকড় ছেড়ে যে কাণ্ডের খোঁজে ছুটেছিলেন তার কী যন্ত্রণা! দেশে ফেরার পর তো তার কলমের শুধু ইতিহাস।
মাতৃভাষার গুরুত্ব এত সাবলীলভাবে তার বিভিন্ন কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছেন। সনেট কবিতার জন্ম দিয়ে তিনি আলাদা একটা ধারার জন্ম দিলেন। নিজের ভাষা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে না পারলে ভিনদেশি ভাষা যে আয়ত্ত করা কঠিন, সে অতি খাঁটি কথা।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহিদদের সেই মহান আত্মত্যাগ, সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এসব বাংলাকে নিয়ে গর্ব করার মতো যথেষ্ট। এ ছাড়াও এ ভাষা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বলার অনেক কিছু আছে।
আমরা ভাষায় দরিদ্র নই বরং সমৃদ্ধ। দরকার শুধু মুখের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর দিয়ে লালন করার ক্ষমতা। একুশ এলেই ভাষা নিয়ে যে তোড়জোড় চোখে পড়ে তার কিছুটা যদি সারা বছর থাকত তাহলে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহারের ভ্রান্তি নিয়ে এত কথা হতো না। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নিয়ে এত কষ্ট করতে হতো না।
একুশে ফেব্রুয়ারি যত না পালনের তার চেয়ে বেশি আড়ম্বরের হয়ে যাচ্ছে। মানেটা হলো দিন শেষ তো সব শেষ। সারা বছর আবার সেই ভুল, আবার বিদেশি ভাষার প্রাধান্য। দিবস পালনের উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি নেই আমাদের। কিন্তু তার সঙ্গে ইতিহাসটাও জানতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক