ঢাকা রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

রোহিঙ্গা সমাধানে ড. ইউনূসই আশার আলো

মিল্টন বিশ্বাস
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ০৩:৪০ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জাতিসংঘ দিবস গত ২৪ অক্টোবর (২০২৪) উপলক্ষে এক বাণীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ‘নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ’ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনসহ রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি ‘জরুরি মনোযোগ’ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

 তিনি একটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সব মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে জাতিসংঘকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও প্রতিক্রিয়াশীল করতে এর সংস্কারের আহ্বান জানান। তার আগে ২৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এক সভায় মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন। 

সেগুলো হলো-১. জাতিসংঘের মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে সব স্টেকহোল্ডারকে সম্মেলন আহ্বান করতে পারেন। সম্মেলনের সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা উচিত এবং উদ্ভাবনী ও অগ্রসর উপায়ে পরামর্শ দেওয়া উচিত। 

২. ইউএন সিস্টেম ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান, শক্তিশালী করা দরকার। স্লাইডিং ফান্ডিং পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রিসোর্স বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে আরও রাজনৈতিক চাপ দিতে হবে। 

৩. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যামূলক অপরাধ মোকাবিলায় ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির ব্যবস্থাকে গুরুত্বসহকারে সমর্থন করা। আমি আইসিসিতে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রসিকিউটর করিম খানের কাছ থেকে শুনানির অপেক্ষায় আছি। সামরিক জান্তা দ্বারা সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিকার মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তার চাবিকাঠি।’

ড. ইউনূসের এ প্রত্যাশা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা নিয়ে জাতিসংঘের ভুল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারিতে (২০২৫)। ফলে বাংলাদেশ সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি (২০২৫) বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইসকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের অসন্তোষের কথা জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনটি কীসের ভিত্তিতে করা হয়েছে- তারও ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। 

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মিয়ানমার অফিস একটি প্রতিবেদনে জানায়, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি (অং সান সুচির সরকারকে হটিয়ে সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে) থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ৭১ হাজার ৩০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ত্যাগ করেছে। কিন্তু তারা সবাই ভারতের মনিপুর ও মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশ করেছে। 

অর্থাৎ জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে কেউ প্রবেশ করেনি। আবার একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে থাইল্যান্ডে যারা অবস্থান করছে, তারা অস্থায়ীভাবে (টেমপোরারি শেল্টার ফর ডিসপ্লেসড পিপল ফ্রম মিয়ানমার) সেখানে অবস্থান করছে। 

মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে যারা অবস্থান করছে, প্রতিবেদনে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- তারা উদ্বাস্তু এবং পরিকল্পিতভাবে (রিফিউজি, প্ল্যানড সেটেলমেন্ট) বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকার করে না। 

বরং তাদের মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। অর্থাৎ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কোনো মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। 

কিন্তু জাতিসংঘ বাংলাদেশ অফিস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, শুধু গত অক্টোবরেই প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আসলে জাতিসংঘের এক দেশের তথ্যের সঙ্গে অন্য দেশের প্রতিবেদনের কোনো মিল নেই। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে বলে মনে হয়। যাহোক রোহিঙ্গা ইস্যু যে ড. ইউনূস সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- এটি স্পষ্ট।
২.
গত বছর (২০২৪) ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকটের ছয় বছর পূর্ণ হলো। ১১ লাখ শরণার্থীর দায় আর কত দিন বয়ে বেড়াতে হবে বাংলাদেশকে? ২০১৭ সালের ওই দিন সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন স্টেট থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা নিরাশ্রয় মানুষের নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয় এ দেশ। 

আর  মানবতাবাদকে রক্ষার জন্য বিপদাপন্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় বাংলাদেশ সামর্থ্য অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। 

১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছিলেন, এ দেশের ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া ও খাওয়ানো কোনো কঠিন কাজ নয়। আর  সেই ক্যাম্পের আশ্রয় ব্যবস্থাপনা দেখতে এ দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা সেখানে গিয়েছিলেন পরের দিন, ১৩ তারিখে। 

সে সময় সবাই মিয়ানমারকে ওই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ ও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে চাপ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। 

তারা আরও বলেছিলেন, ‘মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দিচ্ছি আমরা। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের জন্য এখানে সাময়িকভাবে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করা হবে। আমরা আছি আর্তমানবতার সেবায়।’ 

১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ থেকে আবার জানানো হয়, বাংলাদেশ ধনী দেশ নয়। কিন্তু যদি আমরা ১৬ কোটি জনগণকে খাওয়াতে পারি, তবে আরও ৭ লাখ (পরে ১১ লাখ হয়েছে) মানুষকেও খাওয়াতে পারব।’

অর্থাৎ প্রথম থেকেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ফলে একদিকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য এ দেশ নানা সম্মানসূচক বিশেষণে ভূষিত হয়েছে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শরণার্থীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে সংকট মোচনে নিজেদের অভিমত তুলে ধরেছে এ দেশের এনজিও কর্মীরা। 

২০১৭ সালে জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং ৫ দফা দাবি পেশ করা হয়।

২০১৮ সালেও শান্তির অন্বেষণে শরণার্থী সমস্যার সমাধানে নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে দেশের রাজনীতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। তারা এখন বিশ্বের জন্য হুমকি। রোহিঙ্গাদের যদি দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া না হয় এ সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে। 

বিভিন্ন দেশ এ সমস্যা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব সত্ত্বেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে না দিয়ে তাদের ওপর মানসিক নির্যাতন করছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের নিরাপত্তা আজ ঝুঁকিতে। 

বাংলাদেশের নীতি হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো। ২০১৭ সালে জাতিসংঘে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। 

তার মধ্যে অন্যতম দুটি প্রস্তাব হলো- 

ক. রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। 

খ. কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। অবশ্য জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সমালোচনার প্রেক্ষাপটে শরণার্থীদের যাচাই সাপেক্ষে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অং সান সু চি।

 ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পরে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা ‘আসিয়ান’ কর্তৃক চিহ্নিত হয়েছে ‘অভ্যন্তরীণ জাতিগত সহিংসতা’ রূপে। 

আসলে বিশিষ্ট জনদের মতামত এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কথা থেকে বলা যায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সবচেয়ে ভালো পথ। ফেরত পাঠানো না হলে সমস্যার বোঝা বাংলাদেশের জনগণকে বহন করতে হবে ভবিষ্যতে। ভাসানচরে তাদের জীবন আপাত শান্তিময় হলেও এ দেশের জনজীবনে রোহিঙ্গারা বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
লেখক : গবেষক-অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়