(গতকালের পর শেষাংশ)
৩.
বর্তমানে নোবেলবিজয়ী শান্তিবাদী ড. ইউনূসের নানাবিধ উদ্যোগের কারণে ৬ বছর পর এখন বিশ্ববাসী রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারকে চাপে রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ভূমিকা অগ্রগণ্য। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১৪ জুন ২০২২ পঞ্চম জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেছে। প্রকৃত রোহিঙ্গাদের দ্রুত যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করা, তাদের নিরাপত্তা, জীবিকা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। ১৯ জুন ২০২২ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচির আয়োজন করে।
সমাবেশ, বিক্ষোভ ও প্রচারণার পাশাপাশি এ ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা বিশ্ববাসীর কাছে ১৭ দফা দাবি তুলে ধরেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রোহিঙ্গা স্বীকৃতি প্রদান, অবিলম্বে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, আরটুপির অধীন আরাকানে আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থানকাল কমানো এবং প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ উল্লেখযোগ্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা পালন।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) গুরুত্ববহ ভূমিকা রয়েছে। কারণ ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের গণহত্যার বিপদ থেকে সুরক্ষায় নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) সর্বসম্মতভাবে মিয়ানমারের প্রতি চার দফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে- ক. গণহত্যা সনদের বিধি ২ অনুযায়ী মিয়ানমারকে তার সীমানার মধ্যে রোহিঙ্গাদের হত্যা, জখম বা মানসিকভাবে আঘাত করা, পুরো জনগোষ্ঠী বা তার অংশবিশেষকে নিশ্চিহ্ন করা এবং তাদের জন্মদান বন্ধের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত থাকতে হবে।
খ. মিয়ানমারকে অবশ্যই তার সীমানার মধ্যে সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো অনিয়মিত সশস্ত্র ইউনিট বা তাদের সমর্থনে অন্য কেউ যাতে গণহত্যা সংঘটন, গণহত্যার ষড়যন্ত্র, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে গণহত্যার জন্য উসকানি দেওয়া, গণহত্যার চেষ্টা করা বা গণহত্যার সহযোগী হতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
গ. গণহত্যা সনদের বিধি ২-এর আলোকে গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সাক্ষ্যপ্রমাণ রক্ষা এবং তার ধ্বংস সাধনের চেষ্টা প্রতিরোধ করতে হবে।
ঘ. এই আদেশ জারির দিন থেকে চার মাসের মধ্যে আদালতের আদেশ অনুযায়ী মিয়ানমার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আদালতকে জানাতে হবে। এরপর থেকে আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস পরপর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে। এগুলো মেনে চলা মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক।
তারা আইসিজের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে না। তবে ওই আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার। সে দেশের সরকার ব্যবস্থা বলতে কিছুই নেই, সবই এখন সামরিক জান্তার আদেশনামা।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘ কয়েক দশকের জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং ২০১৭ সালের সেনা অভিযানের পটভূমিতে গাম্বিয়া আইসিজেতে সুরক্ষার আবেদন করে।
পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশ গাম্বিয়া ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে নেদারল্যান্ডসে হেগের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে ওই মামলার প্রথম শুনানি শুরু হয়, চলে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শুনানির জন্য ওই সময় আদালতে হাজির হন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। বিচারে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ আন্তর্জাতিক সালিশির কতখানি পরিপন্থি সেটা যাচাই-বাছাইয়ের লক্ষ্যে ‘আইসিজে’ বিচারিক আদালতে বাদী-বিবাদী মুখোমুখি হয়।
গাম্বিয়া বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী কোনো রাষ্ট্র নয়। কিন্তু প্রতিবেশী ভারত ও চীন যে মানবতার দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি তা ‘ওআইসি’র সমর্থনে একটি ক্ষুদ্র দেশ দেখিয়ে দিয়েছে। গাম্বিয়া বাদী হয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা যেমন মনুষ্যত্বের অপার শক্তির প্রকাশ তেমনি অত্যাচার আর সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিবাদ হিসেবে তাৎপর্যবহ।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব রোহিঙ্গাদের মানবতা বিবর্জিত দুর্দশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও মিয়ানমার নির্বিকার ও নিরুদ্বেগ। কোনো মতে এমন অত্যাচার আর বর্বরোচিত জঘন্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র সুরাহার মনোবৃত্তি নেই। শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ছিলেন নির্বিকার, ভাবলেশহীন।
অবশ্য আমাদের মনে রাখতে হবে, গাম্বিয়ার অভিযোগ উত্থাপনের আগে বাংলাদেশকেই মিয়ানমারের অমার্জনীয় অপরাধের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিশ্বসভায় অভিযোগ করতে হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক দায়বদ্ধতায় আশ্রয় প্রদান থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মো. শামসুদ্দীন রচিত দু’টি গ্রন্থ- ১. ‘মিয়ানমার: প্রতিবেশী দেশ এবং চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা’ এবং ২. ‘মিয়ানমার : দেশ, মানুষ এবং সংঘাত’ আর তার লেখা বিভিন্ন কলামের সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের নিরিখে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের উদ্যোগগুলোর কথা বলা যায়।
২০২২ সালের জুন মাসে রুয়ান্ডার কিগালিতে কমনওয়েলথের অনুষ্ঠান চলাকালীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিজাবেথ ট্রাসকে ১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যুক্তরাজ্যে পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাজ্য আসিয়ান ও জি-৭ জোটের মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন বলে জানান।
৪৮তম ইসলামি সহযোগী সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে। এশিয়ার ভবিষ্যৎ বিষয়ক ২৭তম আন্তর্জাতিক নিক্কেই সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে এশিয়ার দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয় ও এই সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা খুঁজে পেতে অবদান রাখতে এবং বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য এশিয়ার দেশগুলোর নেতাদের অনুরোধ করা হয়।
৪.
রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে রাজি করাতে দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তাও কামনা করেছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। আসিয়ানের সভাপতিত্ব গ্রহণ এবং মিয়ানমারে আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কম্বোডিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী প্রাক সোখোন, রোহিঙ্গা ইস্যুর টেকসই সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক মহাসচিবের বিশেষ দূত ড. নোলিন হাইজারকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাখাইনে কর্মসূচি বাড়াতে অনুরোধ জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রেখেছে এবং ত্রিপক্ষীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে তবে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
৬ আগস্ট ২০২২, বাংলাদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজতে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চীনের আরও জোরালো ভূমিকা ও প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য চীনের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করে।
মূলত ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘ এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হলেও নানা কারণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ৫ আগস্টের (২০২৪) পর সরকার প্রধান ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতির কারণে আজ বিষয়টি সুরাহা করতে বিশ্বসম্প্রদায় নিজেরাই তৎপর হয়েছে।
ড. ইউনূস চলতি গত ২৬ জানুয়ারি তারিখে ট্রাম্প প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘সাত বছর ধরে রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে যে অবস্থান করছে তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি দিয়েছে। আমরা আশা করছি তাদের কন্ট্রিবিউশন চলমান থাকবে ।
এতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না। এটা ৯০ দিনের জন্য করা হয়েছে।’ সব কিছু বিবেচনায় রেখে বলা যায়, এখন সকল প্রচেষ্টার ফল হিসেবে প্রত্যাবাসনের মধ্য দিয়ে নিজ দেশে শান্তিতে বসতি স্থাপন করতে পারলে রোহিঙ্গা সংকটের আপাতত সমাধান হয়েছে বলে আমরা মনে করব।
লেখক: গবেষক-অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :