ঢাকা বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নই এখন জরুরি

গাজী তারেক আজিজ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৫, ০২:০২ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সরকার ও সংশ্লিষ্ট ছাড়া কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট। দেশের মানুষের মনে অসন্তোষের যথেষ্ট কারণ আছে। রাজধানী ঢাকার অলিগলি এখন সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানির মতো রোমহষর্ক ঘটনাবলি। তার ওপর আবার যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা জনমনে আতংক সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনাপ্রবাহ পাশ কাটিয়ে চলতে হচ্ছে মানুষজনকে। 

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দেশে কি আদৌ কোনো সরকার আছে? যদি থেকে থাকে তবে তার কাজই বা কী? আমাদের দেশের কিছু সুশীল বুদ্ধিজীবী সবসময় চিবিয়ে কথা বললেও এ সময়ে বেশ সাবলীল হয়ে বলছেন, বিপ্লবোত্তর যেকোনো দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা! 

তাহলে সেসব বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন রাখতে চাই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি তথা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে কি জনগণকেই আবার মাঠে নামতে হবে? আমার মনে হয় এবার বোধ করি এই ত্রাসের একচেটিয়া রাজত্বের এখনই লাগাম টানতে হবে। 

না হলে মানুষের মনে যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ আরও চরমভাবে ঘটতে পারে। কারণ যেকোনো কারণ ছাড়াই আক্রান্ত হবে, সেও নিশ্চয়ই তার নিজের নিরাপত্তার জন্য কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকে চেয়ে থাকার সংগত কোনো কারণও দেখছি না।

জানি না কীভাবে সরকার এতটা চুপ বা নির্বিকার থাকতে পারে! যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে! এই কথা কোনো সুস্থ বোধসম্পন্ন মানুষ বিশ্বাস করার যৌক্তিক কোনো কারণও দেখছি না। 

সারা দেশে চলমান অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ কার্যক্রমের মধ্যেই লাগাতার অপরাধ পরিক্রমা সাধারণ নাগরিকদের কতটা অসহায় করে তুলেছে সেটা বলে-কয়ে দিতে হয় না। রাস্তায় চলাচলরত মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট! আর সরকার দায়সারা বিবৃতি দিয়ে খালাস! এভাবে আর কত? আর কত প্রাণ ঝরলে বোধোদয় হবে আমাদের? আমরা কি মানুষ আছি?

অপারেশন ডেভিল হান্ট নামক সন্ত্রাস দমনেচ্ছু যৌথ বাহিনীর এই কাজও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ ঢাকায় রাত্রিকালীন ‘ক্রসফায়ার’ নামক সেই পুরোনো কাসুন্দিনির্ভর নরহত্যার বানোয়াট ও ভিত্তিহীন গল্প আর মানুষ গিলবে না। 

তবে অতীতেও যত অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল তাতেও বিনাবিচারে মানুষ হত্যার অভিযোগ উঠলেও অপারেশন ক্লিন হার্ট চলাকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা  কথিত অপরাধী ধরার পর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে বহু গল্প ফাঁদা হয়। শেষমেশ মানুষ বিশ্বাস করেনি। 

আর সেসব অপরাধ মনে করে তারা আইন করে দায়মুক্তি চেয়েছিল এবং পেয়েছিল। এবার অপারেশন ডেভিল হান্টে ততটা নির্যাতন ও মৃত্যুর খবর শোনা না গেলেও অপরাধ জগতের তথাকথিত রাঘববোয়ালদের থাবায় সাধারণ মানুষ এবং অপরাধীদের কেউ কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রাসী হওয়ার ফলে। দেশে আইন আছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বাহিনী মাঠে থেকেও জনমনে স্বস্তি ফেরাতে কেন সচেষ্ট হচ্ছে না?

গত রোববার মধ্যরাতে রামপুরার কাছে বনশ্রী এলাকায় একজন স্বর্ণব্যবসায়ী তারই বাসার সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন। সঙ্গে থাকা ২শ ভরি স্বর্ণ ও নগদ দেড় লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। 

যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা মিডিয়ায়। ফলে কী দাঁড়াল? আমরা দেখতে পেলাম অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্যে একজন ব্যবসায়ী নিঃস্ব তো হলেনই উপরন্তু জীবন বিসর্জনের পথে! রাত অনুমান ৩টার দিকে হাজারীবাগে ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে। 

এই পরিস্থিতি যেন গোটা দেশের চিত্র! কোনোটা আলোচনায় আসে, আর অন্যটা আসে না। বলেই ধামাচাপা পড়ে যায়। মানুষ মনে করছে সেনাবাহিনী পুরোদস্তুর মাঠে থাকলে হয়তো অপরাধী চক্রের বেআইনি দৌরাত্ম্য কমতেও পারে! কিন্তু একটা বিষয় মানুষকেও বুঝতে হবে সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়েই মাঠে আছে। 

এরই মধ্যে অনেকটা অপ্রত্যাশিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাংবাদিক সম্মেলন। যা রাত ৩টার পর অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি গতানুগতিক ধারায় তার ব্রিফিং করেছেন। আর তার পদত্যাগ চেয়ে মধ্যরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিছিলও দেখা গেছে। মিছিল থেকে তাকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে পরদিন দুপুর পর্যন্ত। 

যদিও এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারলে তো আর পদত্যাগের দরকার পড়ছে না’। সাধারণ নাগরিকরা কি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমনতর আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে? যদি আস্থার সংকট থেকে থাকে তবে সমাধান কোন পথে?

গত ৫ আগস্ট মানুষের জানমালের হেফাজতে আস্থা রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু তারপর থেকে আমরা যা দেখছি রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো অবস্থা। আমাদের এখনো বিশ্বাস করতে হচ্ছে দেশে আইন আছে। আইনের হেফাজতকারী আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তারা মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট!

এই যখন দেশের অবস্থা। একটা টালমাটাল পরিস্থিতি উৎরিয়ে আমরা আর কতদিনে স্বাভাবিক হবো?
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং জামায়াত ও বিচ্ছিন্ন কিছু দল নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় করে অবস্থান স্পষ্ট করলেও জট কিংবা নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।

 কারণ সবাই যেখানে সংস্কার দাবিতে সোচ্চার সেখানে বিএনপি নির্বাচন দাবিতে চাপ সৃষ্টি করে আসছে। দলটির দাবি দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। আর অন্যদিকে জামায়াতও তাদের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছে। 

যদিও দলটি এত তড়িঘড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে নয়! তারা সংস্কার দাবি যতটুকু করছে। আবার ক্ষণে ক্ষণে নির্বাচন দাবিও করে আসছে। দলটির একেক পর্যায়ের নেতৃত্ব থেকে একেক সময় একেক ধরনের দাবি চাউড় হতে শুরু করায় সাধারণ জনগণ কিছুটা হলেও দ্বিধান্বিত! 

তার ওপর দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান নিয়ে মাঠে বিএনপির সঙ্গে বেশ ভালোই টক্কর দিতে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে নিশ্চুপ! তারা চাইছে সরকার যেভাবে নির্দেশনা দিবে ঠিক সেভাবেই করতে চায়।

এদেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি কর্তৃক রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি আলোচনায় এলে বিএনপি তথাকথিত ‘কিংস পার্টি’ গঠনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছে সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন জনগণ ভালোভাবে নেবে না। এই বার্তার মধ্যে দিয়ে মূলত নিজেদের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। 

যেহেতু ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন অনেকটাই নিশ্চিত, সেহেতু নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব যখন চরমে, ঠিক তখনই ঘোষণা আসতে পারে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে প্রভাবশালী সদস্য নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে দলটির আহ্বায়ক হতে চলেছেন। আর সদস্যসচিব হিসেবে চার পাঁচজনের নাম শোনা যাচ্ছে। 

দেখা যাক মানুষকে প্রত্যাশা বাণী শুনিয়ে কতটুকু সফলকাম হতে পারেন নতুন রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব। সবকিছু সময়ের হাতেই তোলা থাকুক। এদিকে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি যতটা না রাজনীতি করে তার কমই বোঝে বলেও মনে করার কারণ অনুসন্ধান করা অতিশয় উক্তি হওয়ার কারণ নেই। 

যদিও তারা ধরে নিয়েছিল পটপরিবর্তন তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আদতে তেমন কোনো লক্ষণই পরিলক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে না। যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই দলটি বিচ্যুত হতে হতে মূল ট্র্যাক থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে বলেও বোদ্ধা মহলের ধারণা। দলটি মুখে যত যা-ই বলুক কার্যত স্বস্তিতে নেই তার নেতারা। 

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রত্যাশার মাত্রা অনুযায়ী চাপ সামলাতেও হিমশিম খেতে দেখা যাচ্ছে। কর্মীদের যে আশা দেখিয়ে রাজনীতিতে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো নিজেদের অনুগত করে রাখার প্রচেষ্টা এই মুহূর্তে ঠিক কোনো কাজেই আসছে বলেও মনে হচ্ছে না।

দলীয় হাইকমান্ড প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে ‘শৃঙ্খলা’ নামক শব্দটি মেনে চলতে। কিন্তু এক্ষেত্রে কর্মীদের মনোভাব অনেকটাই ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি’ এর মতো। তাদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু প্রতিফলন ঘটবে? সে প্রশ্নটিও তোলা রইল ভবিষ্যতের খাতায়। ক্ষমতায় কে আসবে তা নয়, জনগণ স্বস্তি চায়। 

নিজ জীবনের নিরাপত্তা চায়। তারপর যারা মামলাবাণিজ্য করে চলেছেন তাদের পরিণতি কী হতে পারে ভাবা যেতে পারে। যা ৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। যদি সেই পুরোনো পথের পথিক হয়ে থাকে দলটির কর্মীরা তাহলে আর যা-ই হোক সহসাই ক্ষমতার পালাবদলের রায় তাদের পক্ষে যাওয়ার কোনো কারণও দেখছি না। 

এমনও দেখা গেছে জাস্ট ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগতভাবে ঈর্ষান্বিত হয়ে মামলায় আসামি শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে বিজ্ঞ অ্যাডভোকেটদেরও। যেখানে একজন আইনজ্ঞ আইন পেশার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে থেকেও নিজেকে অনিরাপদ বোধ করার কারণ হয়েছেন সেই দলটি কিংবা তাদের মতো আর যে দলই আছে মানুষ তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত কি না সময় বলে দেবে। অর্থাৎ বাকিটা নিয়তি!

পরিশেষে সাধারণ মানুষ ওইসব রাজনৈতিক জটাজাল কিংবা ঘোরপ্যাঁচ  বোঝে না। বুঝতেও চায় না। নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়? আমরা ক্রমেই গুম-খুন, ডাকাতি-ছিনতাই, রাহাজানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা চাই না সরকার ব্যর্থ হোক। 


লেখক: অ্যাডভোকেট, কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক