বাকস্বাধীনতার স্বরূপ ও গতি-প্রকৃতি

জুয়েল হাসান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৫, ১১:৪৭ এএম

বাকস্বাধীনতার স্বরূপ ও গতি-প্রকৃতি

স্বাধীনতা শব্দটি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নানা অর্থ বহন ও ব্যক্ত করতে পারে। যেমন আমরা যদি বলি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা: নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার অধিকার, নিজের চিন্তা প্রকাশ করার অধিকার, নিজের জীবনধারা বেছে নেওয়ার অধিকার। তেমনি আর একটি স্বাধীনতা হচ্ছে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা: একটি দেশকে অন্য দেশের শাসন থেকে মুক্তি, নিজের দেশের সরকারের নির্বাচন করার অধিকার। 

নিজের দেশের আইন নিজে তৈরি করা, এ ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা হলো একটি দেশের নাগরিকদের অধিকার এবং সুযোগ, যার মাধ্যমে তারা তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করতে পারে। 

এটি গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যেখানে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং নিজেদের শাসন ব্যবস্থায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে; এরপরে আমরা যদি বলি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা: নিজের পরিশ্রমের ফল ভোগ করার অধিকার,  ব্যবসা করার অধিকার, সম্পত্তি অর্জনের অধিকার। এসব কথার মূলে হলো বাকস্বাধীনতা: নিজের মতামত প্রকাশ করার অধিকার যা নিয়ে জীবনভর মানুষ আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। 

এই বাকস্বাধীনতা নিয়ে বিখ্যাত দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল তার অন লিবার্টি গ্রন্থে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। শাসনচক্র বা সরকারব্যবস্থা অবশ্যই সীমাহীন স্বাধীনতার ওপর স্থাপন হতে পারে না, বরং সরকার যত কম পরিমাণে জনগণের চিন্তা কাজে হস্তক্ষেপ করবে ততই মঙ্গল। 

এমনিক ভুল মতামত তা প্রচারের সুযোগ পেলেও বিতর্কের কারণে ভুল চিন্তাধারা সংশোধনের সুযোগ থাকে এবং যদি মতামত বা চিন্তা সঠিকও হয় তবে তা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। তিনি এমনকি এও বলছেন, সঠিক একটি মত তা নিয়ে বিতর্ক বা আলোচনা না হলে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

তিনি বলছেন, সরকার তখনই কারো ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে যখন দেখা যাবে যে, ওই ব্যক্তিগত অধিকারচর্চার কারণে কারোর চরম ক্ষতি হচ্ছে, তার আগে নয়। তিনি দর্শন, জ্ঞানতত্ত্ব, অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতি, নৈতিকতা, ধর্ম, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে তুখোড় লেখা লিখেছেন।

আসলে মানুষ যখন নিজেদের চিন্তা প্রকাশ করতে পারে, তখন তাদের মননশীলতার বিকাশ ঘটে। মননশীলতা মানুষকে তথ্য ও ঘটনা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে এবং সেগুলোর পেছনের কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। 

এর মাধ্যমে জনগণ সমাজের বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং সেগুলোর সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। মননশীলতা নতুন ধারণা ও চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়। এই সৃজনশীলতা দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষ অন্যের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়।

বাকস্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। বাকস্বাধীনতা না থাকলে সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারবে না। এতে সরকারের ভুল করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা যায়। 

বাকস্বাধীনতা সমাজকে আরও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাকস্বাধীনতা সরকারের কাজকর্মের ওপর নজর রাখে এবং তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। নিজের বাকস্বাধীনতা প্রয়োগ করার সময় অন্যের অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। 

এমন কিছু বলা বা করা উচিত নয়, যাতে অন্যের সম্মান ক্ষণ্ন্ন হয় বা তাদের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। বাকস্বাধীনতা অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকে প্রয়োগ করতে হবে। এমন কিছু করা উচিত নয় যা আইন বিরোধী। বাকস্বাধীনতা আমাদের সবার অধিকার। এই অধিকারকে সম্মান করা এবং এর সঠিক প্রয়োগ করা আমাদের দায়িত্ব।

বাকস্বাধীনতা মানে এই নয় যে, যা খুশি তাই বলা যাবে। প্রত্যেক সমাজের কিছু নিয়ম-কানুন থাকে যা বাকস্বাধীনতার সীমা নির্ধারণ করে। অন্যের সম্মানহানি, ঘৃণা ছড়ানো, বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন কিছু বলা বা প্রকাশ করা বাকস্বাধীনতার আওতায় পড়ে না। 

বিভিন্ন দেশে বাকস্বাধীনতার সীমা বিভিন্ন রকম হয়। কিছু দেশে এর পরিধি বেশ বিস্তৃত, আবার কিছু দেশে এটি কিছুটা সীমিত। এই অধিকারের চর্চা সবসময় দায়িত্বের সঙ্গে করতে হয়। বাকস্বাধীনতা যেমন নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার দেয়, তেমনি অন্যের মতামতকে সম্মান করারও শিক্ষা দেয়। একটি সুস্থ সমাজে বিভিন্ন মতের সহাবস্থান জরুরি, এবং বাকস্বাধীনতা সেই সহাবস্থানকে সম্ভব করে তোলে। 

উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বাকস্বাধীনতা বিষয়টাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকারগুলোর অন্যতম। সেসব দেশে যেমন ধর্মপালনের স্বাধীনতা রয়েছে তেমনি রয়েছে ধর্মকে অস্বীকার করার অধিকার। 

জাতি হিসেবে উন্নতি করতে হলে নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং আজকের উন্নত দেশগুলো ব্যাপারটা ভালো করে বোঝে, অথচ আমরা এই কনসেপ্টটাই এখনো বুঝি না। জাতি হিসেবে উন্নতি করতে হলে আমাদের পরমতসহিষ্ণুতা অর্জন করতে হবে। অন্তত অপরের কথাকে, সেটা যে কথাই হোক না কেন সহ্য করার মানসিকতা তৈরি করা আমাদের জরুরি দরকার।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছে। 

তবে, সংবিধানের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে কিছু যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। 

তবে, এখানে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, যেমন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বিষয়টি। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪১-এ ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালন, প্রচার ও প্রসারের অধিকার রয়েছে। 

বাকস্বাধীনতার মূল কথা হলো- প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব মতামত এবং চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার অধিকার। এর মধ্যে রয়েছে নিজের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি বিনাবাধায় জানানোর স্বাধীনতা। বাকস্বাধীনতা একটি মৌলিক মানবাধিকার, যা গণতন্ত্র ও সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য। 

একটি দেশের সংবিধানে যদি বাকস্বাধীনতার মৌলিক অধিকার স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে, তাহলে তা জনগণের জন্য একটি শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করে। 

এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি এবং ঘোষণাপত্রগুলোতেও বাকস্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এসব চুক্তি এবং ঘোষণাপত্রগুলোতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর সরকারের দায়িত্ব হলো, জনগণের বাকস্বাধীনতা রক্ষা করা। আসলে বাকস্বাধীনতা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এর জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।
লেখক: প্রকৌশলী, কলাম লেখক
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!