ঢাকা মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ, ২০২৫

প্রযুক্তির প্রভাবে যান্ত্রিক জীবন

হীরেন পণ্ডিত
প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৫, ০৯:৪২ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

প্রযুক্তির অগ্রগতির বিপরীতে মানুষের জীবনে মানবিক সম্পর্কে এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এক সময় যখন পরিবার, বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সময় কাটানো ছিল জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ; আজ তা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল বাস্তবতায় ঢাকা পড়েছে। 

প্রযুক্তি মানুষকে কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু একই সঙ্গে অন্তরের দূরত্ব বাড়িয়েছে। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় যে পরিবর্তনগুলো ঘটেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সম্পর্কের সরলতা হারিয়ে যাওয়া। এক সময় মানুষ সামনা-সামনি দেখা করে, কথা বলে এবং সময় কাটিয়ে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করত। 

সম্পর্কের মধ্যে ছিল আন্তরিকতা ও আবেগের গভীরতা। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তি সেই সরলতাকে প্রতিস্থাপন করেছে বার্তা, ইমোজি বা ভিডিও কলের মাধ্যমে। আবেগের স্পর্শ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া দিন দিন সীমিত হয়ে পড়ছে ভার্চুয়াল যোগাযোগের ফ্রেমে।

 এ পরিবর্তন সহজতার আড়ালে সম্পর্ককে যান্ত্রিক করে তুলছে, যেখানে মানসিক সংযোগের জায়গায় তৈরি হচ্ছে এক ধরনের ফাঁকা অনুভূতি। এক সময় পরিবারের সবাই একত্রে বসে খাবার খেত, পারিবারিক গল্প শুনত এবং নিজেদের মধ্যে স্নেহ ও মমতার আদান-প্রদান করত। 

কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরতা এ সংস্কৃতিকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। পরিবারের সদস্যরা এখন এক ছাদের নিচে থেকেও একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন। টিভি, স্মার্টফোন এবং অনলাইন গেমস পারিবারিক মুহূর্তগুলোকে দখল করে নিয়েছে। এর ফলে পরিবারের ভেতর স্নেহ, মমতা এবং সহমর্মিতার মতো মানবিক গুণাবলির চর্চা হ্রাস পাচ্ছে। 

প্রযুক্তি বন্ধুত্বের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে। আগেকার দিনে বন্ধুরা একত্রে আড্ডা দিত, খেলত, বা ভ্রমণে বের হতো। সেই আন্তরিক সম্পর্কগুলো আজ সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট, লাইক এবং চ্যাটে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। 

ভার্চুয়াল যোগাযোগের এ সহজলভ্যতা বন্ধুত্বের গভীরতা এবং আন্তরিকতাকে ক্রমশ কমিয়ে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এ কৃত্রিম যোগাযোগ মানুষকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও এ প্রভাব স্পষ্ট। আগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যা জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করত। এখন অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুম শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে। এতে করে শিক্ষার মানবিক দিকটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা অনেক সময় অনুপ্রাণিত হতে পারছে না। 

প্রযুক্তির এই নেতিবাচক প্রভাব রোধে আমাদের সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের জীবনে প্রযুক্তি এবং সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিদিন একত্রে খাওয়া, গল্প করা, কিংবা কোনো সাধারণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা যেতে পারে। 

প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল সম্পর্ক কখনোই সশরীরে সাক্ষাতের উষ্ণতা এবং আন্তরিকতার বিকল্প নয়। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। প্রযুক্তিকে আমরা কাজে লাগাতে পারি, কিন্তু তা যেন আমাদের সম্পর্কের প্রকৃত গুণগত মান কমিয়ে না দেয়। 

আমাদের উচিত তরুণ প্রজন্মকে মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করা। তাদের শেখাতে হবে যে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও তা কখনোই মানবিক মূল্যবোধের স্থান নিতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পর্কের মূল্যবোধ এবং সহমর্মিতার চর্চা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। 

এভাবেই আমরা প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগিয়ে সম্পর্কের উষ্ণতা এবং মানবিকতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারব। মানবিক সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রযুক্তি যতই আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠুক না কেন, প্রকৃত মানবিক সম্পর্কই জীবনের প্রকৃত রসদ। তাই মানবিক সম্পর্কের শিকড়কে শক্তিশালী করে আমরা সমাজকে আরও সংবেদনশীল এবং মানবিক করে তুলতে পারি। 

বাংলাদেশ বিভিন্ন কর্মযোগের যান্ত্রিক কলাকৌশল আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ বিভিন্ন কর্মযোগের যান্ত্রিক কলাকৌশলের অভিগমন সময়ের বিশেষ চাহিদা। শুধু বাংলাদেশ কেন আধুনিক বিশ্বায়নের দুরন্ত যাত্রাপথেও শিল্প প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের মধ্যে কর্মোদ্দীপনা থেকে সময়ের বিবেচনায় যে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে, তাও কাজের দক্ষতা-সক্ষমতার যেন নির্ণায়ক।

সমসংখ্যক নারীও তেমন প্রযুক্তি সহায়তায় সম্পৃক্ত হতে জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামনির্ভর বাংলাদেশ ও উন্নত যন্ত্র ব্যবহার থেকে কিছুমাত্র দূরে থাকছে না। সেখানে সমানভাবে নারীর অংশগ্রহণ সত্যিই চমক দেওয়ার মতো। বিশেষ করে গ্রামীণ নারী নিরক্ষর কিংবা সামান্য লেখাপড়া জানার কারণে মুঠোফোন ব্যবহারে এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। 

ছোট যন্ত্রটির বিভিন্ন কলাকৌশল আয়ত্তেও নিয়ে আসে। বর্তমানে  তা আরও ব্যাপক হারে গ্রামীণ নারীদের মধ্যে কর্ম আর নিত্য জীবনের ব্যবহারে উপযোগী হয়ে উঠছে। এখন শুধু ফোনের মাধ্যমে কারো সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও দৈনন্দিন অনেক দরকারও মেটাতে পারদর্শী হচ্ছেন। সেখানে দৃশ্যমান হচ্ছে ছোট মুঠোফোনে তথ্য-উপাত্ত খোঁজা ছাড়াও ভিডিও দেখার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে, যা তাদের অনেক বেশি সক্ষমও করে তুলছে।

পল্লিবালার বঙ্গরমণীরা একা নয় সম্মিলিতভাবে বৈঠকে বসে প্রযুক্তি সহায়তাকে অবারিত আর নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাচ্ছেন। আর এটা মূলত করা হচ্ছে ফোনের ছোট্ট প্রযুক্তির সাহায্যে। কাজ করতে গিয়ে গ্রামের মহিলারা অবাক বিস্ময়ে চমকপ্রদ হওয়ার অবস্থা। 

সমস্বরে আওয়াজ উঠে আসছে ক্ষুদ্র এই মুঠো যন্ত্রটি কীভাবে যেন আমাদের হরেক কাজে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। শিখে সক্ষমতা অর্জন করলে তথ্য-উপাত্ত বের করা সহজসাধ্য বলেও বক্তব্য প্রকাশ করছে। আগে যা স্বপ্ন-কল্পনাতেও আসেনি। যা আজ বাস্তবসম্মত কাজে তাদের নিত্য সহায়তা করে যাচ্ছে।

আগে অতি অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ফোনের ব্যবহারে প্রাসঙ্গিক কলাকৌশলও রপ্ত করতে হয়েছে। শিক্ষাপদ্ধতি আর অভিজ্ঞতার মিলন  দ্যোতনায় সমৃদ্ধ হয়ে প্রযুক্তি হাতে মুঠোয় আনা বিশ্বসভায় নিজের সরব উপস্থিতি যেন জানান দেওয়া। প্রযুক্তি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কত প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম তাও গ্রামীণ নারীদের কাছে এক অজানা বিস্ময়। 

তথ্য-প্রযুক্তির সমৃদ্ধ বলয় সারা দুনিয়াকে আজ হাতের নাগালে এনে দিয়ে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তেমন অবারিত আঙিনা আজ বিশ্বায়নকেও যেন সর্বমানুষের দরজায় কড়া নাড়িয়ে দিচ্ছে।

অতি আবশ্যক এক মাধ্যম যা কি না সময় অপচয় রোধ করে কয়েক মিনিটের মধ্যে দুনিয়া জোড়া সংবাদের নিকটবর্তী করতে মানুষকে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায়। আর গ্রামীণ নারীদের জন্য তা যেন এক পরম আশীর্বাদ। কারো স্বামী বিদেশে থাকেন। 

অনেকের সন্তান নিভৃত পল্লির এলাকা ছেড়ে শহরের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। প্রতিদিন ছোট্ট এক ফোনের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে কোনো ভাবনাতেই আর পড়তে হচ্ছে না।

তা ছাড়া গ্রামীণ নারীদের ভিন্ন মাত্রার আর এক আগ্রহ রন্ধন শিল্পে বাহারি খাবারের আয়োজন। বিশেষ করে মিষ্টি জাতীয় খাবার সেখানে কেকের প্রাধান্য বেশি। জন্মদিন, বিয়ে বার্ষিকীর নিয়মিত আনন্দ জৌলুস তো থাকেই। 

যেখানে আলপনা করা মিষ্টি কেকের যে বর্ণাঢ্য আয়োজন তাও ইউটিউব চ্যানেল থেকে অতি সহজেই আয়ত্তে এনে সরবরাহ করা ও গ্রামীণ নারীদের ব্যবসা বাণিজ্যের অভিনব যোগসাজশ বলাই যায়। একদিকে আর্থিক সাফল্য, অন্যদিকে প্রযুক্তির আঙিনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কম বড় বিষয় নয় কিন্তু।

পালা করে বিভিন্ন সময় যেকোনো উঠানে এমন বৈঠকে গ্রামীণ নারীরা এক সঙ্গে যুক্ত হয়ে শুধু যে প্রযুক্তির আঙিনায় বিচরণ করেছে তা কিন্তু নয়। বরং পারিবারিক অনেক বিষয়-আশয় কলহ বিবাদ থেকে সালিশি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এই উঠান আলোচনা সভায়। 

অংশগ্রহণ করা নারীরা এমন বৈঠককে স্বাগত জানিয়ে তাকে আরও সম্প্রসারিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে তথ্যভিত্তিক ভিডিও যেমন আনন্দদায়ক দৃষ্টিনন্দন পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খবর, ভিন্ন মাত্রার সংগীত পরিবেশন এবং নারী-সংক্রান্ত হরেক সংবাদ পাওয়া অন্য রকম পরিবেশ।

যা এক সঙ্গে বসে নারীরা উপভোগ করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করেন। পল্লিবালার নিভৃত সবুজ সমারোহে নিজেদের সম্পৃক্ত করা গ্রাম-বাংলার নারী সমাজ আজ শহর, নগর এবং সারা দুনিয়ার খবরের সঙ্গে পরিচয় হতে পেরে উৎফুল্ল, খুশিতে ভরপুর। প্রযুক্তির আঙিনায় সার্চ অপশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে গ্রামীণ নারীদের পরিচয়, সংযুক্ত হওয়া আধুনিক বাংলাদেশকে যেন বিশ্বদরবারে হাজির করে দিচ্ছে। আগে মুঠোফোনে কথা বলা কিংবা সার্চ করতে পারা এক অবাক অজানা বিষয় ছিল।

সার্চ অপশনে গিয়ে কত কিছু যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নারীরা বিস্মিত, আনন্দিত। আগে স্বামী-সন্তানের ওপর নির্ভর করতে হতো মোবাইল ফোন চালানোর সময়। কত সময় বিরক্ত বোধ করতেন তারা। 

আবার মাঝে মাঝে এখন না পরে বলে ধমক দিতেও কসুর করেননি। এখন অবশ্য তেমন কোনো সমস্যাই নেই। নিজের সময়মতো দূরে থাকা স্বামী-সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন রাখতে স্ত্রী বা মায়েদের আর কারোর কাছে যেতে হয় না।

নিজেরাই দক্ষ আর পারদর্শী হয়ে প্রযুক্তির বলয়ে এখন স্বাচ্ছন্দ্য আর অবারিত। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সময় গ্রামীণ নারীরা শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর সার্চ করে ইউটিউব থেকে দেওয়ার চেষ্টা করে যা তাদের আয়ত্তে ইতোমধ্যে এসে গেছে। 

এমন সব শিক্ষা-প্রশিক্ষণে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারলে শুধু সক্ষমতা প্রদর্শন নয়, পুরস্কার অর্জনও অভাবনীয় সফলতা। এভাবেই প্রযুক্তির সেবায় গ্রামীণ নারীরা বিশ্বকে হাতের নাগালে নিয়ে আসছে।    
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ