আকার-ইঙ্গিতে নয়, প্রকাশ্যে যা বলার বলে দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। প্রথম জাতীয় শহিদ সেনা দিবসে ‘রাওয়া’ আয়োজিত স্মরণসভায় তার বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ-বাক্য ছিল বোল্ড, ক্লিয়ার অ্যান্ড লাউড। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের হত্যাকাণ্ডে নিহত সামরিক কর্মকর্তাদের স্মরণে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
মুখের ভাষার সঙ্গে শরীরের ভাষাও স্পষ্টতা যা গত ক’দিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে ব্যাপক ভাইরাল হয়ে। রাজনীতিকদের মতো ইনিয়েবিনিয়ে নয়, সোজাসিধা বলেছেন, আপনারা এগুলো (শহিদ সেনাদের বীভৎস ছবি) ছবিতে দেখেছেন, কিন্তু এগুলো আমার চাক্ষুষ দেখা। আমি চাক্ষুষ সাক্ষী এই সমস্ত বর্বরতার।
একটা জিনিস আমাদের পরিষ্কার মনে রাখতে হবে, এই সমস্ত বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য দ্বারা ঘটেনি, এ সমস্তটাই বিজিবি সদস্যদের দ্বারা ঘটেছে। ফুল স্টপ। এখানে কোনো ইফ বা বাট নেই; এখানে যদি ইফ বা বাট আনেন, তাহলে সঠিক বিচারের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পাবে না।
বক্তব্যের আরেক জায়গায় বলেছেন, আমার উপদেশ গ্রহণ করলে আপনারা লাভবান হবেন, এটা আমি আপনাদের নিশ্চিত করছি। আমরা নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি। আমরা নিজেরা ইউনাইটেড থাকি। আমাদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যম সমাধান করব।
এটার জন্য ডানে-বামে দৌড়ে কোনো লাভ হবে না। তা না হলে নিজের ক্ষতিই হবে। ২০০৯ সাল থেকে যারা শাস্তি পেয়েছেন, কেউ কেউ বলছেন তারা অযাচিতভাবে শাস্তি পেয়েছেন। এটার জন্য আমি একটা বোর্ড করে দিয়েছি। সেই বোর্ড প্রথম ফেইজে ৫১ জনের ব্যাপারে রিকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছে। আমি তা গ্রহণ করেছি।
নেভি এয়ারফোর্সও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমার স্ট্যান্ড পয়েন্ট হচ্ছে- যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, সেটার জন্য শাস্তি পেতেই হবে। কোনো ছাড় হবে না। বিন্দুমাত্র ছাড় নেই। আমি আপনাদের পরিষ্কার করে দিচ্ছি। ইট ইজ এ ডিসিপ্লিন ফোর্স। আপনারা আমার কথায় হয়তো খুশি হবেন না।
কিন্তু পরিষ্কার করে জেনে রাখুন, আমার অন্য কোনো আকাক্সক্ষা নেই। আমার একটাই আকাক্সক্ষা, দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি কাটানো। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে।
প্রথম কারণ, আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত, এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য। তারা জানে এ পরিস্থিতিতে অপরাধ করে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা যদি সংঘবদ্ধ থাকি। তাহলে এ সমস্যা মোকাবিলা করা সহজ হবে।
পুলিশ, র্যাব ও বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনী অপরাধ যেমন করেছে তেমনি দেশের স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু অপরাধ যারা করেছে, তাদের বিচার হবে। হতে হবেই। না হলে সেই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। প্রত্যেক দোষীকে বিচারের আওতায় আনতেই হবে।
ডক্টর ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশটাকে ইউনাইটেড করে রাখতে। উনাকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে, উনি যেন সফল হতে পারেন। আমরা একসঙ্গে ইনশাআল্লাহ কাজ করে যাব।
দশ কথার আরেক কথায় বলেছেন, আমরা নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি, হানাহানি বাদ দিয়ে একসঙ্গে ইউনাইটেড হয়ে কাজ করতে হবে। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন সতর্ক করা হয়নি! আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে না পারেন, কাটাকাটি, মারামারি করেন, তাহলে এ জাতি কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’ সতর্কতা-সাবধানতা, হুমকি বা হুঁশিয়ারি, যে যেভাবেই নেন জেনারেল ওয়াকার কিন্তু বলার আর বাকি রাখেননি। তার কঠিন সত্য উচ্চারণের মাঝে বুঝবানদের জন্য অনেক বার্তা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর কিছু ছাত্র সমন্বয়ক, রাজনৈতিক দল, সুশীল, বুদ্ধিজীবীসহ কিছু মহলে বোধ থাকতেও মাঝে মধ্যে বোধহীনতা স্পষ্ট। কথার খই ফোটানোরও একটি মহাধুম।
আগে সংস্কার না নির্বাচন, আগে জাতীয় না স্থানীয় নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনসহ কথামালা এবং তত্ত্ব আওড়ানোর হিড়িক। সেইসঙ্গে অঘটন তো আছেই। এরপরও জাতীয় ঐক্য নিয়ে তামাশা। এর মাঝেই তিতা ও কঠিন কথার অবতারণা সেনাপ্রধানের। যা এখন দেশটির রাজনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে কী বার্তা দিলেন, এ নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। সমানে নানা গুঞ্জনও। যে যার মতো নানা উপাদানও বের করছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাদা ছোড়াছুড়ি, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে হেয় করার বিষয় এবং এমনকি দেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সতর্ক করার সময় তার মুখায়ব এবং শারীরিক ভঙ্গির মাঝে অবাক হওয়ার মতো বিষয়ও ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের গত ৬ মাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেসব বক্তব্যের সঙ্গে সর্বশেষ বক্তব্যের তফাৎ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষের কাছেও ছিল দৃশ্যমান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার শাসনের পতনের দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর সেনাপ্রধান বক্তব্য দিয়েছিলেন।
তার সেই বক্তব্যেই জানা গিয়েছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয় এবং সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে। সেদিনের বক্তব্যে ভঙ্গি ও ভাষা এমন ছিল না। এ তফাৎ বিবেচনায় কেউ কেউ বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে চরম উদ্বেগ-শঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও বিভেদে জড়িয়েছে। সার্বিকভাবে এটিকে একটি নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি হিসেবে দেখছেন অনেকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গত ৬ মাসের কিছু ব্যর্থতা, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অযাচিত কাজকর্ম, জুলাই বিপ্লবী ছাত্র নেতাদের বাচন-বচনসহ কিছু কারণে জনমনে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সে কারণে সবাইকে সতর্ক করে বক্তব্য দিতে হয়েছে সেনাপ্রধানকে।
তাকে বলতে হয়েছে, নিজেরা কাদা-ছোড়াছুড়ি, মারামারি ও কাটাকাটি করলে দেশ ও জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। এমন এক সময় সেনাপ্রধান এ ধরনের বক্তব্য দিলেন, যখন রাজনৈতিক দলগুলোর বিভেদ প্রকাশ্যে এসেছে। আবার ছাত্রদের নতুন দলের অভিষেকও ঘটেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা তিনজন ছাত্র প্রতিনিধির একজন নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে নতুন দলের নেতৃত্বে এসেছেন। অন্য দুজন ছাত্র প্রতিনিধি আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম উপদেষ্টা হিসেবে রয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে মাহফুজ আলম নতুন করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
এই মন্ত্রণালয় ছিল নাহিদ ইসলামের হাতে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মধ্যে বাকযুদ্ধ চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সংস্কার, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এই দুই দলের মতবিরোধ অন্যান্য দলের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। এসব ইস্যুতে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান এখন দৃশ্যমান।
তাদের অনুসরণে অন্যান্য রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বিতর্ক, বিরোধ বা বিভেদের কারণে নানারকম সংকট তৈরি হচ্ছে। তারপরও দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বা মবের দৌরাত্ম্য চলছে। একই সঙ্গে ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি থামানো যাচ্ছে না।
অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, অপরাধীরা এখন যতটা সক্রিয়, পুলিশ ততটা নিষ্ক্রিয়। পেশাদার পুলিশিং হচ্ছে না বলেই এমনটি হচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা গণ-অভ্যুত্থানবিরোধী পুলিশ সদস্যদের গাফিলতির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘ব্যর্থ’ দাবি করে মধ্যরাতে বিক্ষোভ মিছিল করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগ চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে দেশের আরও বেশ কয়েক জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল করা হয়।
যার পরিপ্রেক্ষিতে রাত ৩টার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমার পদত্যাগের দাবি তো আজই প্রথম না। তারা যে কারণে আমার পদত্যাগ দাবি করে, আমি যদি সে বিষয়গুলো উন্নতি করে দিতে পারি, তাহলে তো আর পদত্যাগের প্রশ্ন থাকছে না। যারা তার পদত্যাগ চাইছেন, তারা মূলত চাইছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি।
আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থার সংকট বেড়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শাসনের সময় গুম, খুনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অপরাধের ব্যাপারে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই-এর অতীত ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনাও হয়েছে। এমনকি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান রাখা উচিত কি না- এই প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন।
আর এমন পটভূমিতেই প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই- এর ব্যাপারে সেনাপ্রধানের বক্তব্যে তার একটা অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে। সেনাপ্রধান গোটা পরিস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করলেন।
বক্তব্যে কয়েকবার ‘সতর্ক’ শব্দের ব্যবহার করেছেন তিনি। বিএনপির নেতাদের মধ্যে সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা আছে। তবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাদা-ছোড়াছুড়ি বন্ধ করা উচিত বলছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও। কিন্তু, বাস্তবে কাদা ছোড়াছুড়ি ঠিকই চলছে। এরমাঝেও দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আশাবাদ জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।
খোলাসা করে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। তার আগে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন, অবশ্যই সরকার এদিকে হেল্প করবে।’ এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে তিনি ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। সে প্রসঙ্গও টেনেছেন সর্বশেষ বক্তব্যে। তার আগের সেই বক্তব্যেই নির্বাচনের ব্যাপারে একটা সময়ের কথা জানা গিয়েছিল।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই বিএনপিসহ বিভিন্ন দল নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে আসছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের খোলাসা বক্তব্যের পর এখন আর আকার- ইঙ্গিতের তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। পরিস্থিতি অনেকটা পরিষ্কার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :