শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না যৌন নিপীড়নের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে। নারীদের অবাধ বিচরণ হলেও তারা বিভিন্ন স্থানে যেমন- বাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, ফুটপাত কিংবা জনসমাগম হয় এমন স্থানগুলোতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়, তাদের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ পরিস্থিতি। প্রতিবাদ করলে উল্টো হামলার শিকার হতে হয়- এমন ঘটনা আজকাল ঘটছে।
অনেক নিরুপায় অভিভাবক বখাটেদের ভয়ে সন্তানের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে গৃহবন্দি করে রাখে। বখাটেদের উৎপাতে শৈশব-কৈশোর গৃহবন্দি অবস্থায় কাটায় অনেক মেয়ে।
একইভাবে কর্মস্থলে যৌন হয়রানির কারণে অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয় এবং অনেক অভিভাবক মেয়েদের চাকরি করাতে চায় না। সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানা ভয়ে এ ধরনের হয়রানির বিষয়টি গোপন রাখে নারী। বিচারহীনতার প্রবণতায় যৌন হয়রানির মতো মারাত্মক অপরাধ বেড়েই চলেছে দিন দিন।
কন্যা এবং ছেলে শিশুরা খুব সহজেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। ছোট হওয়ার কারণে তারা সহজে যৌন উৎপীড়ককে বাধা দিতে পারে না। তাই ছোট শিশুরা তাদের আশপাশের আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নিগৃহীত হয়।
আমাদের পরিবারে এমন কিছু সদস্য থাকে, যাদের কখনোই আমাদের সন্তানদের জন্য ক্ষতিকর মনে করি না। কিন্তু এসব আত্মীয়স্বজন দ্বারা শিশুরা বেশি নির্যাতিত হয়। অনেক সময় শিশুরা এদের বিরুদ্ধে কিছু বললেও অনভিজ্ঞতার কারণে আমরা তাদের কথা এড়িয়ে যাই।
আর ছেলে শিশুরা এভাবে আক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজে ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিশুদের সঙ্গে নারীদেরও একটি বৃহৎ অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হন।
বিশেষ করে যেসব নারীর নিজস্ব প্রকৃত স্বাধীনতা নেই, যারা কোনো না কোনোভাবে অন্যের ইচ্ছার অধীনস্থ তারাই বেশি আক্রান্ত হন। সেসঙ্গে নারীদের কর্মস্থলেও দুর্বলতার সুযোগে একটি অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও উচ্চ শ্রেণির নারীরাও যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কারণেও কিশোরী, নারী ও শিশুরাও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে যেকোনো দুর্বলতা নিয়ে নারীদের ব্ল্যাকমেইলের কারণেও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফাঁদে ফেলে যৌন নিপীড়ন করা হয় নারীদের।
পরিবার ঘিরে কিছু সদস্য থাকে, যারা বিকৃত চরিত্রের অধিকারী। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থেকে ছোট ছোট শিশুদের টার্গেট করেন। তাদের বিকৃত রুচির অভিলাষ পূরণ করেন। এসব আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজন শিশুদের প্রলোভন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক যৌন নিপীড়ন করেন।
পরিবারে কিছু সদস্য থাকেন, যাদের সঙ্গে হাসিঠাট্টার সম্পর্ক। এসব ভগ্নিপতি (দুলাভাই) বা দাদা সম্পর্কীয় সদস্যরাও অনেক ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন করার সুযোগ নেন। যা আমরা হাসি-তামাশার ছলে এড়িয়ে যাই। সেইসঙ্গে আদর-স্নেহ দেওয়ার ছলেও অনেক চাচা, জ্যাঠা, মামা, খালু, ফুফা ইত্যাদি থাকে। যারা আদর করার নামে কৌশলে শিশুদের নিজের যৌন লিপ্সা পূরণে ব্যবহার করেন।
ছেলে শিশুরা বেশিরভাগ শিক্ষক এবং আশপাশের মধ্যবয়স্কদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ছেলেরাও যে যৌন হয়রানির শিকার হয়, তা আমরা অনেকেই জানি না। দুর্বল নারীরা ঘরে এবং কর্মক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দ্বারা আক্রান্ত হন। প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় গণপরিবহনেও নারী ও শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হন। মেয়েরা স্কুল-কলেজে আশপাশের বখাটের দ্বারা নিগৃহীত হয়।
সামাজিক মাধ্যমে কিছু কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তি দ্বারাও নারী ও শিশুরা ভার্চুয়াল যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সেইসঙ্গে মিডিয়াতে কাজ করতে আসা উঠতি মডেল বা তারকারাও তাদেরই পেশাজীবীদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
যৌন নিপীড়ন থেকে শিশু ও নারীদের বাঁচাতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। শিশুদের যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই যেটা জরুরি, সেটা হচ্ছে সচেতনতা। প্রতিটি পরিবারকে শিশুদের যৌন বিষয়ক নিরাপত্তার শিক্ষা দিতে হবে। যাতে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হলে তা পরিবারকে জানাতে পারে।
এই বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকে বুঝতেই পারে না তাদের যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। সুতরাং পরিবারের প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে শিশুদের যৌন বিষয়ে সচেতন করা।
কোনো শিশুকেই কারো সঙ্গে একাকী যেতে না দেওয়া বা ঘরে কখনোই একা না রাখা। শিশুরা কারো সঙ্গে একাকী সময় দিচ্ছে কি না তা খেয়াল রাখা। স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রতি শিশুদের অনীহা সৃষ্টি হলে তার কারণ অনুসন্ধান করা।
সেসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা কোনো প্রকার নির্যাতনের শিকার বা তাদের কোনো প্রকার বুলিং করা হচ্ছে কিনা তা জানার চেষ্টা করা।
নারীদের স্বাবলম্বী এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সহায়সম্বলহীন নারীদেরই বেশিরভাগ সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে দুর্বল নারীদের আশপাশের যৌনপিপাসু মানুষেরা অতিমাত্রায় নির্যাতন করার সুযোগ নেয়। সেসঙ্গে সংসারে দুর্বল হওয়ার কারণে অনেক স্ত্রীকেও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
নারী যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে তারা যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে। যারা যৌন নির্যাতন করে, তাদের চোখে চোখ রেখে এর প্রতিবাদ করতে জানতে হবে।
এই আত্মবিশ্বাসটা শিশুরা পরিবার থেকেই অর্জন করে। তাই পরিবারের উচিত শিশুদের আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী হতে সাহায্য করা। যাতে তাদের সঙ্গে কেউ অন্যায় কিছু করতে চাইলে তারা যেন এর প্রতিবাদ করতে এবং সবাইকে জানাতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে অভিভাবকদের সুন্দর, সাবলীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক করা উচিত। যাতে তারা স্কুল-কলেজে তার সঙ্গে কে কী করছে তা সহজে জানা যায়। পারিবারিক সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে অসংখ্য কিশোর-কিশোরী এবং মেয়েরা তাদের সঙ্গে হওয়া নিপীড়নের কথা পরিবারকে জানাতে পারে না।
ফলে এসব কোমলমতি শিশু, কিশোর-কিশোরীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে এক ধরনের মানসিক অবসাদগ্রস্ততে ভোগে। যা পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগ এবং আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়।
কিশোর-কিশোরীদের কখনোই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স না হওয়ার আগ পর্যন্ত ভার্চুয়াল জগৎ থেকে কিশোর-কিশোরীদের দূরে রাখতে পারলে যৌন নিপীড়ন থেকে অনেকাংশে দূরে রাখা যাবে।
যেসব ছেলেরা যৌন নিপীড়ন করে, তারা অবাধ ইন্টারনেট থেকে যৌন আসক্তি অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে তারাই যৌন নিপীড়ন শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই ভার্চুয়াল জগতে ব্ল্যাকমেইল করেও যৌন নিপীড়ন করে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যারা যৌন নিপীড়নের শিকার হন, তাদের পরবর্তী সময়ে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। যা কখনোই উচিত নয়। যৌন নিপীড়নের শিকার কিছু কিছু সাহসী ছেলে-মেয়ের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের পরিবার থেকে থামিয়ে দেওয়া হয়।
সেসঙ্গে তাদের সামাজিকভাবে কটুদৃষ্টিতে দেখা হয়। যা অন্যজনকে সাহসী হতে বাধা দেয়। তাই কারো সঙ্গে কোনো প্রকার যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে তা যেন আমরা নেতিবাচকভাবে না নেওয়া হয়।
আমরা যেন যৌন নিপীড়িত ছেলে-মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেই। যাতে সমাজে আর কেউ এই জাতীয় কুকর্ম করার সাহস না করে।
যৌন নিপীড়ন একটি গুরুতর বিষয়, যা অবশ্যই প্রকাশ্যে আনতে হবে। এ সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। কারণ, এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রায়ই কথা বলা হয় না এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।
২০০৩ সালের আইনে অসৎ উদ্দেশ্যে নারীর যেকোনো অঙ্গ স্পর্শ করাই যৌন নিপীড়ন। এমনকি অশালীন মন্তব্য, নারীর পোশাক ধরে ঢান দেওয়া, ধাক্কা দেওয়াও যৌন নিপীড়নের মধ্যে পড়ে। এই অপরাধে নিপীড়ককে চিহ্নিত করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট এবং আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হব।
ধর্ষণের শিকার নারীকে দায়ী না করে তার প্রতি সংবেদনশীল হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। ভুক্তভোগীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সরকারি এবং ব্যক্তিগত ভাবে যৌন হয়রানি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
যৌন হয়রানি নির্মূলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তাই সমাজ থেকে যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা নির্মূল করতে হলে অবশ্যই সবচেয়ে বেশি জরুরি সচেতনতা।
আমরা পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারব, তত বেশি যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা থেকে মুক্তি পাব। সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনও যৌন নিপীড়ন থেকে সমাজকে পবিত্র রাখে। আসুন প্রত্যেকে নিজ নিজ অঙ্গন থেকে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :