আন্তর্জাতিক নারী দিবস ‘নহি সামান্যা নারী’

শ্যামা সরকার

প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৫, ০১:৫৮ পিএম

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ‘নহি সামান্যা নারী’

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

নারী। সৃষ্টির গৌরব। অবস্থা ও অবস্থানে রয়েছে পরিবর্তনের ছাপ। কর্মে-চেতনায় স্বতন্ত্র। দক্ষতা ও সাহসিকতায় শীর্ষে। ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সমকালীন বিশ্বে নারী নেতৃত্ব বা নারীর চিন্তাধারা অনেকটাই সুপ্রতিষ্ঠিত। যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রশংসার ঝড় বিশ্বজুড়ে। 

আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী ৮ মার্চ এ দিবসটি পালন করা হয়। বিশেষ করে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের স্বীকৃতি, ভালোবাসা প্রকাশের মধ্য দিয়ে পালন করা হয় দিবসটি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। নারীর ওপর হওয়া বৈষম্য, নির্যাতনের বিরুদ্ধে করা প্রতিবাদে নারীদের জাগ্রত করাই নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

নারী দিবসের প্রতীক বেগুনি রং। নারী দিবস মূলত বেগুনির সঙ্গে সাদার মিশেল কিংবা শুধু বেগুনি। নারী দিবসের বেগুনি রং ভেনাসের। যা কিনা নারীরও প্রতীক। কারণ বেগুনি নির্দেশ করে সুবিচার ও মর্যাদার। যা দৃঢ়ভাবে নারীর সমতায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম শেষে বেগুনি রং এখন নারীবাদীদের প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ছাড়া প্রতিটি দিবসে আলাদা রঙের প্রতীক হওয়ার পেছনেও আছে ভিন্ন ইতিহাস। যেমন- বিশ্ব ‘শান্তি দিবস’ সবুজাভ নীল, বিশ্ব ‘শ্রম দিবস বা মে দিবসে’ লাল, পরিবেশ দিবসে ‘সবুজ রং’ ইত্যাদি।

জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগান ‘For ALL women and girls : Rights, Equality, Empowerment’.  এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে: ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন’।

এ প্রতিপাদ্যটি সময়োপযোগী। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ১৭, ১৯, ২৭, ২৮ এবং ২৯ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার ও ক্ষমতায়ন এবং নারী ও শিশুর সুরক্ষার মাধ্যমে মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে।  

১৯৭২ সালে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড’। ১৯৭৪ সালে এ বোর্ডকে ‘বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এ রূপান্তর করা হয়, যা পরবর্তীকালে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে উন্নীত হয়। 

এ ছাড়া, কিশোরীদের নেতৃত্ব বিকাশ, দেশপ্রেম ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ‘গার্ল গাইড অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ প্রণয়নের আগেই ১৯৭৪ সালে শিশু আইন পাসের মাধ্যমে শিশুর অধিকার ও সার্বিক সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। (সূত্র : মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর)। এরই ধারাবাহিকতায় নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে একটি সমতাপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল সৃষ্টি করেছে। 

তবে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স-২০২৪ এর সমীক্ষায় উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতা সূচকে বড় পতন হয়েছে বাংলাদেশের।

বার্ষিক এই সূচকে গত বছরের তুলনায় ৪০ ধাপ পিছিয়ে ১৪৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ৯৯তম। অবশ্য, দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের অবস্থা আরও নাজুক। এ অঞ্চলে বাংলাদেশ এবারও সবচেয়ে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে, যেখানে পাকিস্তান সবার নিচে। 

দীর্ঘ পথচলায় পিছিয়ে নেই নারীরা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, সেনা, নৌ, পুলিশ, বিজিবি, সাহিত্য-শিল্পসহ সর্বোচ্চ বিচারিক কাজেও নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্য এখন লক্ষণীয়। প্রথম নারী উপাচার্য, প্রথম নারী পর্বতারোহী, প্রথম বিজিএমইএ নারী সভাপতি, প্রথম নারী মেজর, প্রথম নারী স্পিকার, প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নারী উপদেষ্টাসহ সব ক্ষেত্রেই তাদের অবস্থান ক্রমশই উজ্জ্বল।

কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে নারীদের যেমন জীবনের ঝুঁকি আছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও আছে। আর এই চ্যালেঞ্জই নারীর শক্তি, কাজের প্রেরণা। পরিবারেও একজন নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবারে নারীর বিভিন্ন রূপ। কখনো কন্যা, কখনো স্ত্রী, কখনো জননী। আর এসব ক্ষেত্রেও নারীর ভূমিকা বৈচিত্র্যপূর্ণ।

যেখানে নারীর নিজের সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার নেই, সেখানে হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় বাংলাদেশের সব মাকে স্বস্তি দিয়েছে। 

বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রের সব ধরনের ফরমে এখন থেকে অভিভাবকের ঘরে বাবা ছাড়াও মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম উল্লেখ করা যাবে। আগে ফরমে শুধু পিতার নাম ব্যবহার করতে হতো। পরে সেখানে মায়ের নাম লেখাও বাধ্যতামূলক করা হয়। আর এখন যে রায় দেওয়া হলো তাতে অভিভাবক হিসেবে শুধু মায়ের নামও উল্লেখ করা যাবে।

এতকিছুর পরেও মর্যাদা ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে নারীকে অবহেলা ও অবমূল্যায়ন করা হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অবদানকে খাটো করে দেখা, কৃষিতে প্রচুর অবদান থাকা সত্ত্বেও মর্যাদা না দেওয়া, ঘরের কাজের আর্থিক মূল্যায়ন না করা, শিল্পক্ষেত্রের অবদানকে গুরুত্ব না দেওয়া, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার- এ অচলায়তন ভেঙে এখনো বের হওয়া সম্ভব হয়নি। বাড়ছে সহিংসতা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি। উত্তরণের উপায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

নারীর ইতিবাচক পরিবর্তন ও অর্জন- এসব কিছুই আমেরিকায় ঘটে যাওয়া আন্দোলনের স্বীকৃতি। প্রত্যেকটি মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান, অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেই প্রতিবাদ করতে চায়, রুখে দাঁড়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এই ন্যায্য অধিকার এবং সম্মানের দাবিতে নারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করেন। যা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।

নারী দিবস পালনের মূল কারণ হচ্ছে, এই দিনে আমেরিকায় ঘটে যাওয়া এক আন্দোলন। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতা কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন। 

বেতন বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর অমানবিক কর্মপরিবেশ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নারীরা একজোট হলে তাদের ওপর কারখানা মালিকরা এবং তাদের মদতপুষ্ট প্রশাসন দমন-পীড়নেই ক্ষান্ত হয়নি, নির্বিচারে চালিয়েছিল গুলি।

১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। 

এ সময় ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ সাল থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। 

এ প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ৮ মার্চকে নারী দিবস পালন করার আহ্বান জানান। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান করে।

বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করলেও সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পায়নি নারী। সে কারণে নারীর কর্মপরিধি বা সেবাদান সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অফিস ও ঘরের কাজসহ বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে, যা নারীদের শারীরিক ও মানসিক অবসাদগ্রস্ততার ঝুঁকিতে ফেলছে।

বাংলাদেশ জাতিসংঘ নির্দেশিত ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ (এমডিজি) অর্জনে ইতোমধ্যে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ‘রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (Sustainable Development Goals) অর্জনের অংশীদারিত্বের পারস্পরিক দায়িত্ব পড়েছে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সব সদস্য দেশের ওপর। 

এর উদ্দেশ্য হলো- বিশ্বের সর্বত্র ও সর্বজনীন কল্যাণ। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে হবে। 

এসডিজি-৫ অর্জনে জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বব্যাপী বেশকিছু সূচকে অগ্রগতি হলেও সার্বিকভাবে সূচকে আরও অনেক দূর অগ্রসর হতে হবে। জেন্ডার সমতার প্রান্তিক স্তরে কাঠামোগত বিষয়ে অগ্রগতি সামান্য। এসডিজি-৫ অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে অসমতা, অন্যায্য সামাজিক রীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং যৌনতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নারীর অংশগ্রহণ কম।

সব মহলে নারীকে নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন মানসিক অবস্থার পরিবর্তন। ঘুচবে বৈষম্য। সহজ হবে অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠার পথ। এক কথায়- নারীর ক্ষমতায়ন মানেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। অর্থাৎ, কোনো বাধা বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই তার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা। তাহলেই ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি। পুনরুদ্ধার হবে মর্যাদার আসন। 

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও প্রধান
কমিউনিকেশন, পাবলিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ,
উদ্দীপন। 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!