গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো জনগণের ভোটের অধিকার। এই অধিকারের মাধ্যমেই জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ করে। ভোট কেবল একটি অধিকারই নয়, এটি একটি পবিত্র দায়িত্বও বটে। প্রতিটি নাগরিকের উচিত তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে দেশ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
এজন্যই ভোট গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূলভিত্তি। এটি নাগরিক তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করার ক্ষমতা দেয়। তাই ভোটকে নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়।
ব্যালট প্রতীকে প্রথম ভোট চালু হয় অস্ট্রেলিয়ায়। ১৮৫৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যে প্রথম ব্যালট প্রতীকে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের পর দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলসেও ব্যালট প্রতীকে ভোট গ্রহণ চালু হয়।
১৯ শতকের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়ার বাকি রাজ্যগুলোতেও ব্যালট প্রতীকে ভোট হয়। ১৯০২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথমবারের মতো ফেডারেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেও ব্যালট প্রতীকে ভোট গ্রহণ করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ব্যালট প্রতীকে ভোট গ্রহণ সাফল্যের পর বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই পদ্ধতি চালু হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ ব্যালটে ভোট হয়। এই দিনটিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনে ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন।
বাংলাদেশের প্রথম ভোট বলতে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বোঝায়। এই নির্বাচনটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এর মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণ তাদের প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচন করার সুযোগ পায় ভোটের মাধ্যমে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এই সংবিধানের অধীনেই ৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। এই নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ওই ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়।
আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে সপ্তদশ শতক থেকে নির্বাচন একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া হিসেবে প্রচলিত হতে শুরু করে। তবে প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও নির্বাচনের মাধ্যমে শাসক নির্বাচনের প্রচলন ছিল। তবে আধুনিক গণতন্ত্রে প্রতিনিধি বাছাইয়ের সর্বজনীন ব্যবহার শুরু হয়েছে সপ্তদশ শতক থেকে।
বাংলাদেশের সংবিধানও দেশের জনগণের জন্য সে সুযোগ রেখেছে, সংবিধানের ১১৮-১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচনসংক্রান্ত বিধানাবলি রয়েছে পরিষ্কারভাবে। এই অনুচ্ছেদগুলোতে নির্বাচন কমিশন গঠন, এর ক্ষমতা ও দায়িত্ব, নির্বাচন পরিচালনা এবং নির্বাচনসংক্রান্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে বিস্তÍারিত উল্লেখ আছে।
ইউরোপীয় দেশ এস্তোনিয়া সর্বপ্রথম অনলাইনে ভোট চালু করে। ২০০৫ সালে এস্তোনিয়ার স্থানীয় নির্বাচনে সর্বপ্রথম অনলাইনে ভোট গ্রহণ করা হয়। এস্তোনিয়া ভোটারদের ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে আই-ভোট অথবা প্রচলিত ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেয়।
সে বিবেচনায় বাংলাদেশের ভোটার ব্যবস্থা একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূল অংশ, যা নাগরিক তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেয়। এ দেশে ভোটার হওয়ার যোগ্যতা বলতে: বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি, মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে, কোনো আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হলে হবে না।
আবার ভোট প্রদানের জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। এসব মাধ্যমগুলোর মধ্যে: ভোটাররা তাদের নির্ধারিত ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপারে বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট দেন, এটি হচ্ছে সরাসরি ভোটদান। কিছু দেশে, ভোটাররা ডাকযোগে তাদের ব্যালট পেপার জমা দিতে পারেন। এটি সাধারণত যারা ভোটকেন্দ্রে যেতে অক্ষম বা দূরে থাকেন তাদের জন্য প্রযোজ্য।
নির্বাচনের দিনের আগে নির্দিষ্ট সময়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকে। এটি ভোটারদের সুবিধামতো সময়ে ভোট দিতে সাহায্য করে এই পদ্ধতি হচ্ছে অগ্রিম ভোটদান।
অনলাইন ভোটদান কিছু দেশে বা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর মাধ্যমে ভোট কতটা স্বচ্ছ তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে।
ইভিএম সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। যদি কোনো কারণে মেশিন বিকল হয়ে যায়, তাহলে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। বিদ্যুৎবিভ্রাট ঘটলে বা ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইভিএম হ্যাক করা সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। যদি হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করা হয়, তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
অনেকের মতে, ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। কারণ, ভোটাররা তাদের ভোট সঠিকভাবে পড়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেন না। অনেক সময় ভোটারদের আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে ভোট প্রদান করা সম্ভব হয় না।
তবে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গণনা দ্রুত হয়, ফলে ফলাফল দ্রুত পাওয়া যায়, ইভিএমে ভোট গণনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়, ফলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, ইভিএম ব্যবহারে ব্যালট পেপার ছাপানো এবং সংরক্ষণের ঝামেলা নেই।
জনগণের প্রতিবাদের বড় হাতিয়ার হচ্ছে ভোট, আর একটি দেশের ভোট যদি কারচুপি হয় তাহলে গণতন্ত্র পড়ে হুমকির মুখে। ভোটে কারচুপি হলে জনগণের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়। মানুষ মনে করে তাদের ভোটের কোনো মূল্য নেই, যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির পরিপন্থি। কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে বৈধতা হারায়।
ফলে সরকারের গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্তের প্রতি জনগণের সমর্থন থাকে না। ভোট কারচুপি হলে বিরোধী দল ও জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, যা বিক্ষোভ, সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে, পুরো দেশ অচল হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। শেষমেশ জনগণের তোপের মুখে ভোট কারচুপি করে নির্বচিত সরকার তল্পিতল্পা নিয়ে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয় এমন নজিরও আছে।
অনৈতিক এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে মানুষের আস্থা কমে যায়। ভোট কারচুপি প্রায়শই মানুষের ভোটাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। একটি দেশে ভোট কারচুপির ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক মহলে সেই দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ভোট কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে না। ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধি পায়, জনগণের ওপর অমানবিক দমন নিপীড়ন করতে থাকে, যা সুশাসনের অভাব তৈরি করে। সংক্ষেপে, ভোট কারচুপি গণতন্ত্রের মূল নীতিগুলোর পরিপন্থি এবং এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
সুষ্ঠু ভোটার ব্যবস্থা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। এটি নিশ্চিত করে যে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে। একটি সুষ্ঠু ভোটার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তাদের ওপর কোনো রাজনৈতিক প্রভাব থাকা উচিত নয়।
ভোটার তালিকা নির্ভুল এবং হালনাগাদ হওয়া প্রয়োজন। সব যোগ্য নাগরিকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর সমান সুযোগ থাকা উচিত। কোনো ধরনের সহিংসতা বা বিদ্বেষমূলক প্রচারণা সহ্য করা উচিত নয়।
ভোট গ্রহণ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে, ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভোট গণনা নির্ভুল ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে হবে। সব প্রার্থীর প্রতিনিধি ভোট গণনার সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন। নির্বাচনী আইন ও বিধিগুলো স্পষ্ট এবং নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন, কোনো ধরনের ত্রুটি বা অস্পষ্টতা থাকলে তা সংশোধন করতে হবে।
একটি সুষ্ঠু ভোটার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। জনগণকে তাদের ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং নির্ভয়ে ভোট দিতে হবে।
এ ছাড়াও, তাদের উচিত নির্বাচন কমিশনের কাজে সহযোগিতা করা এবং কোনো ধরনের অনিয়ম দেখলে তা জানানো। একটি সুষ্ঠু ভোটার ব্যবস্থার শেষ কথা হলো জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা তখনই সফল হয় যখন ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন এবং নির্বাচনের ফলাফলকে বিশ্বাস করেন।
লেখক: কলাম লেখক, প্রকৌশলী