হঠাৎ করেই একটা বিষয় খুব আলোচনায় এসেছে। আর তা হচ্ছে, অক্সিলারি (সহযোগী) পুলিশ ফোর্স। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার এ উদ্যোগের কথা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে পুলিশকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে ডিএমপিতে এই লোকবল নিয়োগ দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, এর সংখ্যা ৫শ’ হতে পারে। এই মর্মে বিবিসি নিউজ বাংলা তাদের নিজস্ব নিউজ সাইটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনটিতে প্রকাশ করা হয়, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শপিংমলসহ আবাসিক এলাকার নিরাপত্তায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে বেসরকারি কর্মীদের ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে জানানো হয়নি কোনো কোনো বেসরকারি সংস্থা থেকে এই বৃহৎ লোকবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে?
তাদের কী কী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে? তাদের কাজের পরিধি কতটা বিস্তৃত থাকবে? তাদের জবাবদিহি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? তাদের পদমর্যাদা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে? তাদের বয়স কত হবে? তাদের কর্মঘণ্টা কত হবে? যাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তারা কি শুধুই সংশ্লিষ্ট বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে?
যেমন পুলিশ সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যতিরেকে কাউকে তল্লাশি করতে পারে না। যদিও পুলিশ কোনো আসামিকে আটক কিংবা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কিছু আইনি নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। তাদের কাজে সহায়তার নামে ‘সোর্স’ এর সহায়তা নিয়ে থাকে। যদিও সেই সোর্সের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাধারণের ভোগান্তির কথা কমবেশি সবারই জানা।
আমরা প্রায়শই দেখতে পাই যাত্রীবাহী বাসে পুলিশ গাড়ি থামানোর সংকেত দিলে কিছু লোক কখনো পুলিশ, কখনো পুলিশের লোক আবার কখনো সোর্স বলে পরিচয় দিয়ে যাত্রীদের হেনস্তা করে থাকে। যা ভুক্তভোগীদের নিকট থেকে জানা যায়। তাহলে, যদি পুলিশের কাজে গতিশীলতা আনতে অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দেওয়া হয়, যাদের থাকবে আটক কিংবা গ্রেপ্তারের ক্ষমতা!
সেই ক্ষমতা পেলে অপব্যবহার হওয়ার কথা বলছেন বিশিষ্টজনেরা। এই অক্সিলারি ফোর্স সুনির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য দায়িত্বশীল থাকবেন বলে জানানো হয়েছে। এও জানানো হয়েছে, তাদের ‘সনদপত্র’ দেওয়া হবে। যদিও বলা হয়নি সেই সনদপত্র এই ফোর্সের সদস্যরা ঠিক কোথায় ব্যবহার করতে পারবে।
আমরা অতীতে দেখেছি বিভিন্ন সুপার শপ কিংবা বিপণি বিতানগুলোতে ‘গ্রুপ ফোর সিকিউরিটি’ বা ‘এলিট ফোর্স’ বা নামি বেনামি অনেক সিকিউরিটি কোম্পানি এসব লোকবল নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। যদিও কতটুকু করতে পেরেছে তা প্রশ্নাতীত নয়। আর বেনামি সিকিউরিটি কোম্পানি এমন এমন লোক নিয়োগ দিয়েছে যা অনেকটুকু দায়সারা।
এর অর্থ হচ্ছে তাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা! তাহলে সেসব লোক কি অন্যের নিরাপত্তা বিধান করবে? তারা নিজেই চলতে ফিরতে পারে না। আবার অনেক সময় দেখা যায় ব্যাংকের বুথে দায়িত্বে নিয়োজিত নিরাপত্তা প্রহরীও অপরাধী চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার খবর পাওয়া যায় অহরহ। যা সম্প্রতি বনানীতে একটি বাসায় নিয়োজিত নৈশপ্রহরীর ডাকাতদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার খবরে মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে।
ডিএমপির এই অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যরা তদন্ত কাজে থাকবে মর্মেও জানানো হয়েছে। কিন্তু একবার যদি পুলিশ তথা এই বাহিনীর নাম নিজের সঙ্গে জড়াতে পারে তাদের কার্যকলাপ কি হতে পারে, সে বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করেছেন।
ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি তালেবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে আরও বলেন, ‘অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। নিয়োগ পাওয়ার পর তারা পুলিশের সঙ্গে থেকেই কাজ করবে।’
একা দায়িত্ব পালন করার সময় তারা পুলিশের মতো আটক কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারবে বলেও জানান তিনি। কিন্তু সেই গ্রেপ্তারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কতটুকু থাকছে এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিকরাও নির্বিকার থাকছেন না। তাহলে শুধু নিয়োগ দেওয়াই শেষ না হয়ে মানুষের জানমালের হেফাজতে নতুন এই বাহিনী কতটুকু সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
আর এক্ষেত্রে ক্ষমতা বা আইনের অপব্যবহার রোধে এই ফোর্স নিয়োগে যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা। তার মানে দাঁড়ায় একেবারে লাগামহীন যাতে না হয় বাহিনীটি সে বিষয়েও কঠিন নজরদারি করতে হবে। তবে সাধারণ মানুষ এতে কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন বলে পরিলক্ষিত হতেও দেখা গেছে।
যদিও সবচেয়ে মোক্ষম কথাটি বলেছেন, পুলিশের সাবেক এক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, ‘এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা নিরপেক্ষ লোক নিবে বলে আশা করছি। তারা যেন কোনো পলিটিক্যাল বায়াসড লোক না নেয়।’ আর যদি নিয়োগকৃত লোকজন রাজনৈতিকভাবে বায়াসড হন, সেক্ষেত্রে শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। আর নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা আইনি দায়িত্ব পালনেও যথাযথ না-ও হতে পারে।
যদিও এর আগে বাংলাদেশ আনসার বাহিনীকে পুলিশের ক্ষমতা প্রদান করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এমন সহযোগী নিয়োগ দেওয়ার নজির নেই বলেও জানিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তারা। এ থেকেও একটি বিষয় পরিষ্কার যদি পুলিশে লোক প্রয়োজন পড়েও তাহলে আনসার কিংবা ক্যাডেট কোর থেকেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে যা সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য হতে পারে।
যতদিন পর্যন্ত পুলিশ পুরো উদ্যমী হয়ে কাজে না ফিরতে পারে। এতকিছুর পরও জনমনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, পুলিশ কি আদৌ জনবান্ধব হবে? নাকি আগের মতোই দমন-পীড়নেই ব্যবহৃত হতে থাকবে? কথায় আছে, ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’! আমরা এর ব্যতিক্রম দেখে অভ্যস্ত হতে চাই।
অক্সিলারি ফোর্স নিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘অক্সিলারি ফোর্স বলতে বোঝায় পুরো ফোর্স না, তবে আধা সরকারি ফোর্স, পুলিশকে সহযোগিতার জন্য এ ধরনের ফোর্স ব্যবহার করার বিষয়টি পুলিশ আইনেই আছে।’
এ সংক্রান্তে তিনি যুক্তরাজ্যে এমন বাহিনী ব্যবহারের নজির আছে উল্লেখ করে বলেন, ‘অল্প সময়ের জন্য এই ধরনের সহযোগী ফোর্স ব্যবহার করার নজির আছে। এটা খরচও যেমন বাঁচায়, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকরীও।’ কিন্তু একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের অতীত বর্তমান প্রেক্ষাপট আর যুক্তরাজ্যের প্রেক্ষাপট এক করে দেখার সুযোগ নেই। তবে পুলিশের সাবেক আইজিপি আরেকটু এগিয়ে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যমান আইনে স্পেশাল পুলিশ ব্যবহার করা যায়। পুলিশ নিজের কাজের সুবিধার জন্য এটি ব্যবহার করে থাকে।’
যদি দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আনা হয়, সেক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে আর বিকল্প আর কিই বা হতে পারে? প্রতিনিয়ত হত্যা, গুম, ধর্ষণ, চুরি ছিনতাই, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ মব ভায়োলেন্স নামক আতংক থেকে মানুষ কীভাবে রেহাই পেতে পারে?
ডিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন, ‘এই ফোর্সের হাতে একটি ব্যান্ড থাকবে, যাতে লেখা থাকবে সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা। আইন অনুযায়ী তারা দায়িত্ব পালন ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন।’ যদিও আলোচনার শুরুতেই জিজ্ঞাস্য ছিল, এই ধরনের সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তার বেতন-ভাতা সংস্থান ঠিকভাবে হবে? তারা সরকারি কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা হবেন? এ বিষয়ে পরিষ্কার করা হয়নি, তাদের কি পরে আবার নিয়োগ কিংবা নিয়মিত করা হবে কি না? আবার যদি নিয়োগপ্রাপ্তরা নিজেদের সংশ্লিষ্ট বাহিনীতে একীভূত করার দাবি তোলে সেক্ষেত্রে কী হবে?
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ডে-ভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। আবার মাস্টার রোল কর্মচারীও যেমন রয়েছে তেমনি করে উন্নয়ন খাত ও রাজস্ব খাতের কর্মচারীও রয়েছে। এই ফোর্সের সদস্যরা কি রাজস্ব খাতের না-কি উন্নয়ন খাতের বিবেচিত হবে?
মাঠে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ আর এই বাহিনীটির কাজে কী কী পার্থক্য রয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, পুলিশ বাহিনীর মতো প্রশিক্ষণ, দক্ষতা কিংবা দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো থাকবে না এই ‘সহযোগী ফোর্সের’ কাছে।
এমনকি তাদেরকে কোনো ধরনের অস্ত্র সহযোগিতা দেওয়া হবে কি-না সেটি নিয়েও আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। কিন্তু তাদের পেশাদার পোশাক কি হবে? কোন বাহিনীর আদলে ডিজাইন করে সরবরাহ করা হবে কি-না তা জানা যায়নি। এই সহযোগী বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি কোনো অন্যায় করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?
যে কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেসরকারি এই নিরাপত্তাকর্মীরা মূলত ‘অক্সিলারি পুলিশ ফোর্স’ হিসেবে কাজ করবেন। এই যে বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী বলা হচ্ছে, তারা তো বেশিরভাগ বিভিন্ন বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক বা সিপাহি। এক্ষেত্রে কি তাদের পুলিশ বাহিনীতে পরবর্তী সময়ে একীভূত করার সুযোগ থাকছে?
যেমন, একদিকে পূর্বতন প্রতিষ্ঠান থেকে পেনশন ভোগ করছেন। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আবার যদি পুলিশ বাহিনীর স্থায়ী সুবিধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে পারে। তাই যা কিছু করা হোক না কেন জেনে-বুঝে করাই সমীচীন। তবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া লোকগুলো কোনো সুনির্দিষ্ট দল কিংবা মতাদর্শের কি-না তা-ও যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দিতে পারলে প্রশ্ন কম উত্থাপিত হবে।
পরিশেষে বলা যায়। সব আইনই প্রণয়ন করা হয়ে থাকে মানুষের কল্যাণে। কিন্তু তা শেষমেশ হয়তো আর হয় না। ঘটতে থাকে অপপ্রয়োগ। হয়ে ওঠে অত্যাচারী শাসকের হাতিয়ারস্বরূপ।
তথাপিও যেকোনো নতুন কিছু মানুষ খুব একটা ধাতস্থ না হওয়া পর্যন্ত সহজেই গ্রহণ করতে চায় না। দিনশেষে মানুষ চায় জানমালের নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত আমরা উদ্বিগ্ন থাকতে থাকতে এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে দায়িত্বশীলদের চাপমুক্ত করতে শিখেছি। তারপরও কতটুকু পেরেছি? আদতে পেরেছি কি-না সেই বিতর্ক করার সময় এখনই নয়। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এটুকু প্রত্যাশা করি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।
লেখক: অ্যাডভোকেট, কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক