ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

দেশে নারীর ক্ষমতায়নে দীপ্তিময় অভিযাত্রা

হাসানাত লোকমান
প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২৫, ০৯:৪৮ পিএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের ইতিহাস এক দীর্ঘ ও সংগ্রামী পথের ফল। অতীতের নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজকের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এই অভিযাত্রার পেছনে রয়েছে সমাজ সংস্কারকদের নিরলস প্রচেষ্টা, সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ, এবং সর্বোপরি নারীদের নিজস্ব আত্মপ্রত্যয় ও সংগ্রাম।

প্রাচীন শিকল ভাঙার সূচনা 
ব্রিটিশ শাসনামলে বাঙালি মুসলিম নারীরা শিক্ষা ও সামাজিক অগ্রগতির সুযোগ থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিলেন। নারীর স্বাধীন বিকাশে সমাজের বাধা ও কুসংস্কার ছিল প্রকট। তবে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো দূরদর্শী সমাজ সংস্কারকরা নারী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তার প্রচেষ্টার ফলে নারী শিক্ষার আন্দোলন শক্তি পায় এবং নারীরা ধীরে ধীরে শিক্ষার সুযোগ লাভ করতে শুরু করেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী অগ্রযাত্রা

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিশেষ করে গত দুই দশকে নারীদের অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

শিক্ষার প্রসার 
শিক্ষা হলো ক্ষমতায়নের মূল ভিত্তি, আর এই খাতেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের জন্য সরকারি বৃত্তি ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০০৯ সালে যেখানে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল ৬০ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ শতাংশে।

স্বাস্থ্যসেবায় উন্নয়ন 
নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান সূচক হলো স্বাস্থ্যসেবা। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির ফলে প্রসূতি মৃত্যুহার কমেছে। ১৯৯০ সালে প্রতি ১,০০,০০০ জীবিত জন্মে যেখানে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৫৭৪, ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭৩-এ। 

পরিবার পরিকল্পনা, পুষ্টি ও মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নারীদের স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।

অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ 
নারীর ক্ষমতায়নের আরেকটি বড় দিক হলো- অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। বাংলাদেশে নারীরা এখন শুধু গৃহকেন্দ্রিক নয়, বরং উৎপাদনশীল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে ৩০ লাখ নারীশ্রমিক কাজ করতেন, ২০২৩ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ লাখে পৌঁছেছে।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, এসএমই খাত, ওনারশিপ প্রোগ্রামের মতো উদ্যোগের ফলে নারীরা নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন এবং স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন 
নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অগ্রগামী দেশ। ১৯৯১ সাল থেকে নারীরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করছেন, যা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় সরকারে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ দেওয়ার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।

২০০৯ সালে যেখানে স্থানীয় সরকারে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ২৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে।

চ্যালেঞ্জ ও আগামী দিনের সম্ভাবনা

নারীদের ক্ষমতায়নের পথে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে, তবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে-
কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও অসম বেতন কাঠামো, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও নিরাপত্তার অভাব; গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক ও ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির সীমাবদ্ধতা।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নারীদের আরও এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন এবং নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সমানাধিকারভিত্তিক নীতিমালা বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশের নারীশক্তি একদিন কেবল দেশের উন্নয়নের অংশীদারই হবে না, বরং বিশ্বদরবারে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। 

লেখক: প্রাবন্ধিক, অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার