ঢাকা রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫

একটি ধর্ষণের খবরও শুনতে চাই না

গাজী তারেক আজিজ
প্রকাশিত: মার্চ ২০, ২০২৫, ০৯:২৯ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশিমাত্রায় অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই সময়ে। গুম-খুন, লুট-ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, মামলা-হামলা, অগ্নিসংযোগ, বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে মব ক্রিয়েট করে জ্যান্ত মেরে ফেলা, প্রকাশ্য রাস্তায় ছুরি-চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত করতে উপর্যুপরি আঘাত এবং গুলি করে টাকা স্বর্ণ লুটের ঘটনায় যখন রাষ্ট্রযন্ত্র খাবি খাচ্ছে ঠিক তখনই ঘটতে থাকল একের পর এক ধর্ষণের মতো ঘটনা। 

যার বীভৎসতা দেখলে শিউরে উঠবে যে কেউ! প্রশ্ন জাগবে যে কারো মনে, আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি! এই দেশ কি আমাদের? আমরা কি এমন দেশই চেয়েছি? প্রত্যাশা করেছি? যেখানে বিশ্বের মানুষ প্রযুক্তিজ্ঞান আহরণ করে শীর্ষে পৌঁছে গেছে রাতারাতি। আর আমরা পড়ে আছি প্রাগৈতিহাসিক যুগে কিংবা অনগ্রসর কালের কোনো এক গহীন অরণ্যে ঘেরা অন্ধকার দুনিয়ায়। 

যদি না-ই হবে তবে এত এত ধর্ষণ ঘটনা কেনই বা ঘটতে যাবে? যেসব ঘটনার অধিকাংশই পরিচিত আত্মীয়স্বজন তথা নিকটজনের দ্বারা! যা বিবেককে নির্বিকার করে দেয় রীতিমতো! আমরা হেরে যাই। এ কেমন মানসিক বিকারগ্রস্ত চিন্তা লালন করে চলেছি আমরা? আমরা কবে তাদের সেই বহুল কাক্সিক্ষত নিরাপদ পৃথিবী তথা এই পৃথিবীকে নিরাপদ করে বাসযোগ্য করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারব? তা নিশ্চিত করেই বলি আমাদের দ্বারা হয়তো সম্ভবপর না-ও হতে পারে!

সম্প্রতি মাগুরায় ধর্ষণের শিকার ৮ বছরের আছিয়া শিশুকন্যাটি ধর্ষণের শিকার হয়ে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিল। চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা আর দেশবাসীর ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে সমা-পৃথিবীর প্রতি একরাশ ঘৃণা ছুড়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গেল।

এরই মধ্যে সারা দেশে একের পর এক ঘটনা প্রকাশ ও প্রচার পেতে শুরু করায় মানুষ শিশুদের বেড়ে ওঠা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দাবি উঠতে শুরু করেছে, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কেউ কেউ প্রকাশ্য শাস্তির দাবিও করতে শুরু করেছেন। চলছে প্রতিবাদ, মিছিল। তাতেও কি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ছে!

এদিকে একশ্রেণির ইউটিউব কিংবা ফেসবুকসর্বস্ব সাংবাদিক সময়ের ওপর থেকে দায় সরাতে বুলি আওড়াতে শুরু করেছে, ধর্ষণ আগেও হয়েছে, তবে খবর চাপা দেওয়া হয়েছে। যা বর্তমানে হচ্ছে না। এই ধরনের উক্তি নির্ভরতা থেকে বোঝা যায়, তারা প্রকারান্তরে ধর্ষণকে হাল্কা করে উপলব্ধি করছেন। 

যদি না-ই হবে, তবে কেন এমন অগ্রহণযোগ্য কথা বলে অপরাধীকে অপরাধের পরিক্রমা থেকে পার পেতে সাহায্য করছেন। অতীতের যেকোনো কৃতকর্মের দায় যদি বিগত সরকারের হর্তাকর্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বর্তমান সরকারকে দায়মুক্ত করার কি সুযোগ থাকছে? নাকি এতে কাজের কাজ কিছু হবে? এই সিটিজেন জার্নালিজমের যুগে এখন আর মিডিয়ার ওপর নির্ভর করেও থাকতে হচ্ছে না, কোথাও কোনো ঘটনা ঘটতে দেরি মিডিয়ায় আসতে দেরি নেই। 

তবে, তথাকথিত মিডিয়াও ভিউ ব্যবসায়ের ঘেরাটোপে পড়ে কবেকার ঘটনা কখন প্রচার করে তার কোনো বাছবিচার ব্যতিরেকে শুরু হয় হৈ-হুল্লোড়! তথাকথিত সেইসব ইউটিউবার তথা ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের বিকৃত ইমেজকে ব্যবহার করে বিদেশে বসে দেশে দাঙ্গা লাগিয়ে গোঁফে তা দিয়ে হাসে। এই যদি হয় দেশের মানুষের বিবেকের বিবেচনাহীন উত্থান, তারে আর কি দিয়ে বধ করা যাবে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারো বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ মামলা করা হয় তবে তার বিচার হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধিতে প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। এই সংজ্ঞাটিই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গ্রহণ করা হয়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন নারীর প্রতি একজন পুরুষ যদি আইনে বর্ণিত পাঁচ অবস্থায় কোনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। 

এরমধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা। এরপরই রয়েছে, নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে কিংবা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতি আদায় করা। তবে কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে হয় তবে তার সম্মতি নেওয়া হোক বা না নেওয়া হোক, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। 

কোনো নারী যদি ভুল করে একজন পুরুষকে নিজের আইনসঙ্গত স্বামী ভেবে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দেন, এবং পুরুষটি জানেন যে তিনি তার স্বামী নন, আইনের দৃষ্টিতে এমন শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে।

তবে আইনটিতে কিছু ঘাটতি বেশ লক্ষণীয়। কারণ এই ধরনের অসম্পূর্ণতার কারণে একই ধরনের অপরাধের শিকার হয়েও বিচারবঞ্চিত থাকছে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী! প্রশ্ন উঠতে পারে কে বা কারা এই ধরনের জনগোষ্ঠী? আসা যাক আলোচনায়, দেশে বিদ্যমান আইনে জোরপূর্বক কোনো পুরুষকে কিংবা কোনো ছেলেশিশুকে যদি আরেক পুরুষ পায়ুপথে মিলনে বাধ্য করে তবে সেটা বলাৎকার হিসেবে বিবেচিত। 

এই অপরাধের ধারা হচ্ছে দণ্ডবিধির ৩৭৭। কিন্তু ইতোমধ্যে দাবিও উঠতে শুরু করেছে, কোনো নারী যদি কোনো সক্ষম পুরুষকে জোরজবরদস্তি মিলনে বাধ্য করে সেটা কেন ধর্ষণের মতো অপরাধ হবে না? তাই আইনটি সংস্কারের দাবি উঠতে শুরু করেছে। আবার কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো শিশুর সঙ্গে যৌন মিলন করে সেক্ষেত্রে কেন ধর্ষণ হবে না? অনেক সময় আমরা দেখি পিতা-মাতা চাকরিজীবী হওয়ায় সন্তানের দেখভাল করার জন্য একজন গৃহপরিচারিকাকে পরিবারে এনে দায়িত্বে রাখেন। 

তখন সেই নারীটি যদি চাকরিজীবী দম্পতির সন্তানের সঙ্গে লালসাস্বরূপ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে তাহলে কেন ধর্ষণ হবে না? এমন ঘটনা হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। যা মিডিয়াতে ফলাও করে ছাপা হয়ে থাকে। অন্যদিকে অনেক পুরুষ এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে চেপে যান। আবার উল্টো দায়ে উল্টো অভিযোগের তীর পরিবারের সেই পুরুষটির দিকে ছুটে এলে সম্মানহানিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে বলেই এড়িয়ে যান। তাই বলে এই সংখ্যা নেহায়েত কম নয়!

এরই মধ্যে দাবি উঠতেও শুরু করেছে, বলাৎকারকে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ গণ্য করতেও উচ্চ আদালতে রিট করার খবরও ছাপা হয়েছে। রিটকারীদের ভাষ্যমতে, দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় নারী ধর্ষণের অপরাধের পাশাপাশি ‘পুরুষ ধর্ষণকেও’ অপরাধ হিসেবে সংযুক্ত করতে এই ধারাটির সংশোধন প্রয়োজন। সম্প্রতি দেশে ছেলেশিশু তথা পুরুষকে যৌন নির্যাতন ও বলাৎকারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। 

কিন্তু এই ধরনের নির্যাতনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে বিচার করা যাচ্ছে না। তাই দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন এনে ‘নারী ধর্ষণ’ এর অপরাধের পাশাপাশি অপরাধ হিসেবে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ বিষয়টিকে যুক্ত করার আবেদন করা হয়। রিটে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে পুরুষ কর্তৃক শিশুদের বলাৎকারকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করে এ ধরনের অপরাধ ধর্ষণের মতোই শাস্তিযোগ্য যাতে করা হয়। 

সেটি আমরা অবশ্যই চাই। একটি বিষয় এখানে পরিষ্কার, অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে দুয়েকটা হয়তো পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। অন্যগুলো আসে না। অথবা আসতে দেওয়া হয় না। কেউ সামাজিক পারিবারিক সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে, অন্যরা গ্রামের মাতবরদের কথিত শালিস (নেপথ্যে বাণিজ্য) এর কারণে ধামাচাপা দিতে বাধ্য হয় পরিবার। না হলে নেমে আসে ‘একঘরে’ করে রাখার অতিপরিচিত শাস্তির খড়্গ! আর এতেই দমে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবার চাইতে পারে না বিচার। গুমরে কেঁদে মরে আরও কেউ কেউ!

নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ঢাবিতে মানববন্ধন করেছে ‘এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন’। তেমনই খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম দেখলে চোখ তো কপালে উঠবেই সঙ্গে বিশদ পড়লে গা শিউরে উঠবে। 

ব্রিটেনের ল্যাংক্যাস্টার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর সিওভান উইয়ার একটি গবেষণায় দেখান নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ সম্ভব। বরং অসম্ভব মনে করাটাই একটা মিথ বা কাল্পনিক উপকথা। ওই গবেষণাটি ২০১৭ সালে প্রতিবেদন আকারে বিবিসিতে প্রকাশিতও হয়েছে। 

বেসরকারি শিশু সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সে’র নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা মনে করেন, বাংলাদেশে সামাজিকভাবেই ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের বিষয়ে এক ধরনের নীরবতা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে।

ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলা কোন আইনে? নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুর বাবা তার ছেলেশিশুর ধর্ষণের ঘটনায় থানায় যে মামলাটি করেছিলেন সে মামলাটি দায়ের হয়েছিল দণ্ডবিধির-৩৭৭ ধারায়। অথচ মামলাটি হওয়ার কথা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কারণ ৩৭৭ ধারায় শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। 

ধারাটি মূলত: প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গম বা সমকামিতার অপরাধ বিষয়ে। কিন্তু নারী কর্তৃক পুরুষের প্রতি ধর্ষণের বিষয়টি কোনো আইনেই সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। তার মানে কি এসব অপরাধ ঘটছে না? নিশ্চয়ই ঘটছে! বর্ণিত আলোচনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বলা যায় মূলত বহুবিধ কারণে বিষয়টিকে একজন পুরুষ এড়িয়ে যেতে চান। যা কাম্য নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যা-ই কিছু ঘটুক না কেন তা-ই অপরাধ। আর এ ধরনের অপরাধের প্রতিকার না চাইতে থাকলে মহামারি আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে!

ফিরে আসি মাগুরার আছিয়ার বিষয়ে। মানুষরূপী অমানুষগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। আমরা সেই পিশাচদের শাস্তি চাই।  

এ বিষয়ে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে, অপরাধী বুঝতে পারে যে, অপরাধ করে হয়তো আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যেতে পারে কিন্তু সমাজের মানুষজন তাকে ঠিকই চিহ্নিত করেছে, সে নিপীড়নকারী, যৌন হেনস্তাকারী, সে ধর্ষক, সে বলাৎকারকারী, সে ইভটিজার! এতে করে অপরাধ করতে যাওয়া লোকটির মনের ভেতর হয়তো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। আর এতে করে সে ভালো পথে ফিরেও আসতে পারে। তবে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য, কিন্তু তড়িঘড়ি বিচারপ্রক্রিয়ার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিও যাতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়! এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে। 
লেখক: অ্যাডভোকেট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক