কোনো রাজনৈতিক দল, সরকার বা নেতার যখন হাতে অধিক ক্ষমতা থাকে, তখন তাদের জবাবদিহি কমে যায় এবং তারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। আবার এটি বিভিন্ন উপায়েও ঘটতে পারে। স্বৈরাচারী শাসকরা তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য আইন পরিবর্তন আইনের অপব্যবহার করে।
তারা বিরোধীদের দমন করতে এবং তাদের ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে আইনের শাসনকে পঙ্গু করে দেয়। একইভাবে স্বাধীন গণমাধ্যম স্বৈরাচারীদের জন্য একটি হুমকি।
স্বৈরাচারী শাসকরা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে। তারা ভোটারদের ভয় দেখিয়ে জাল ভোটের মাধ্যমে ভুয়া ভোটার উপস্থিতি দেখিয়ে বিরোধী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করে। তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য স্বৈরাচারী শাসক বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এর মাধ্যমে তারা ভিন্নমত দমন করে এবং জনগণের কাছে শুধু তাদের পছন্দের তথ্যগুলোই পৌঁছে দেয়।
স্বৈরাচারী সরকার গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। স্বৈরাচার হলো- এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠী সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করে যা জনগণের অধিকার এবং স্বাধীনতার পরিপন্থি। এই ধরনের সরকার প্রায়শই দমন-পীড়ন, দুর্নীতি এবং অদক্ষতার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
যখন ক্ষমতা একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর জনগণের বা প্রতিষ্ঠানের নজরদারি কমে যায়। এর ফলে জবাবদিহির অভাব তৈরি হয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ বাড়ে। স্বৈরাচারী সরকার প্রায়শই বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতাসহ মৌলিক নাগরিক অধিকার দমন ও হরণ করে থাকে।
তারা ভিন্নমতকে সহ্য করে না। আর যারা সরকারের সমালোচনা করে তাদেরকে অহেতুক শাস্তির আওতাই এনে হয়রানি করে জেল জুলুম এমনকি ভুয়া মামলায় শাস্তির ব্যবস্থা করে। ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাও করে। আসলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ স্বৈরাচারের জন্ম দিতে পারে এটিই সত্য।
স্বৈরাচারী শাসকেরা প্রায়শই গণমাধ্যম, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য যোগাযোগমাধ্যমে সেন্সরশিপ আরোপ করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের অপছন্দের তথ্য বা মতামত প্রকাশে বাধা দেয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে টুঁটি চেপে ধরে তাদের পক্ষে খবর প্রকাশে বাধ্য করে।
স্বৈরাচারী শাসকেরা প্রায়শই রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে তাদের প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। বেসরকারি গণমাধ্যমকে সরকারের পক্ষে সংবাদ প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়। জুলুমের পরে জুলুম করেই ক্ষান্ত হয় না, সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি বা কারাবন্দি করার মাধ্যমেও মিডিয়ার স্বাধীনতা দমন করা হয়।
স্বৈরাচারী শাসনে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে। জনগণের সরকার এমন হওয়া উচিত; আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য করা যাবে না, সরকারি নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা, আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, এখানে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে ‘গ্রেপ্তার আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ’ শিরোনামে গ্রেপ্তারদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে।
প্রথম দফায় বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের কারণ না জানিয়ে কোনো ব্যক্তিকে আটক করা যাবে না এবং আটক ব্যক্তিকে অবশ্যই তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তারপর জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষা ইত্যাদি।
পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে এবং নানা দেশে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জার্মানিতে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি একটি কুখ্যাত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি ছিল একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্র। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর এবং পরবর্তীকালে ফিউরার (নেতা) ছিলেন।
তার নেতৃত্বে নাৎসি পার্টি জার্মানির রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। জোসেফ স্টালিনের শাসনামলে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯২৪-১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ছিলেন জোসেফ স্টালিন। এই সময়ে তিনি তার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেন এবং একটি দমনমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।
বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী ইতালি ছিল ২০ শতকের অন্যতম কুখ্যাত স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। ১৯২২-১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং এই সময়ে তিনি একটি কর্তৃত্ববাদী, জাতীয়তাবাদী এবং সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। উত্তর কোরিয়া কিম জং উনের নেতৃত্বে একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্র।
লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে স্বৈরাচারী শাসনের দীর্ঘ এবং জটিল ঐতিহ্য রয়েছে। গত শতকের বিভিন্ন সময়ে, এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ বিভিন্ন ধরনের স্বৈরাচারী শাসকদের অধীনে ছিল। চিলি ১৯৭৩-১৯৯০ সাল পর্যন্ত চিলি অগাস্টো পিনোশের স্বৈরশাসনের অধীনে ছিল। এই সময়ে, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং নির্যাতন সাধারণ ঘটনা ছিল।
১৯৭৬-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনা সামরিক জান্তার অধীনে ছিল। এই সময়ে, হাজার হাজার মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। ব্রাজিল ১৯৬৪-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। এই সময়ে, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন সাধারণ ঘটনা ছিল।
বর্তমানে ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিতর্কিত, যেখানে নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে স্বৈরাচারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে সামরিক স্বৈরাচারী শাসন দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশেও সামরিক স্বৈরাচারী শাসন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের সংবিধান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান রেখেছে। সংবিধানের মূল লক্ষ্য হলো- জনগণের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করা। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই বলা হয়েছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি।
এখানে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ শব্দটিই ইঙ্গিত দেয় যে, রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছানুসারেই পরিচালিত হবে, কোনো স্বৈরাচারী শাসকের ইচ্ছানুসারে নয়। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বাক-স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ আরও অনেক অধিকার এখানে সুরক্ষিত।
এই অধিকারগুলো স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এই বিধানটি আইনের শাসনের গুরুত্ব তুলে ধরে, যা স্বৈরাচারী শাসনের বিপরীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) স্বৈরাচারী শাসক যদি গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো গুরুতর অপরাধ করে থাকেন, তবে আইসিসিতে তার বিচার হতে পারে। কিছু দেশ সর্বজনীন বিচার বিভাগীয় নীতির অধীনে অন্য দেশে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের জন্য বিচার করতে পারে। স্বৈরাচারী শাসকের অপরাধ যদি দেশের সংবিধান বা প্রচলিত আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, তবে সেই দেশের আদালতে তার বিচার হতে পারে। গুরুতর অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। স্বৈরাচারী শাসকের বিচারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। তবে জনগণের জোরালো চাপ এবং সামাজিক আন্দোলন বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, উৎখাত করতে পারে স্বৈরাচারকে।
স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার শেষ কথা হলো জনগণের ক্ষমতা। যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হয়, তখনই স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগঠিত হতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করতে হবে। জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
বিভিন্ন সভা, সেমিনার, ও প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে স্বৈরাচারী শাসনের কুফল সম্পর্কে জানাতে হবে। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধৈর্য ও সাহসিকতার প্রয়োজন। অনৈতিক এই জুলুমবাজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধৈর্য একটি অপরিহার্য গুণ। এই ধরনের শাসন প্রায়শই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সহিংসতা, দমন-পীড়ন এবং গুমসহ অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করে থাকে।
তাই, জনগণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং অবিচল থাকা দরকার। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে স্বৈরাচারী শাসকরা পরাজিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং তাদের অধিকারের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম করাই উত্তম।
স্বৈরাচারী সরকার প্রায়শই দুর্নীতি ও অপচয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। এর ফলে দেশে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমে যায়, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তোলে। স্বৈরাচারী শাসন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা, সহিংসতা এবং এমনকি গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
জনগণের বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান বা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাদের পতন ঘটতে পারে। জনগণের সচেতনতা, সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই স্বৈরাচারী শাসনের পতন সম্ভব।
লেখক: প্রকৌশলী, কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :