ঢাকা শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

সৃজনশীলতায় আলোকিত বাংলাদেশের প্রত্যাশা

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৫, ০৯:২৪ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে একটি উদীয়মান অর্থনীতির নাম। শিক্ষা-প্রযুক্তি, কৃষি ও শিল্পসহ নানা খাতে দেশ এগিয়ে গেলেও সত্যিকারের টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা জনগণের জীবনমান উন্নত করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ একটি দেশ গড়ে তুলবে। তাই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে সৃজনশীলতা, যা জাতিকে শুধু উন্নতই করবে না, বরং একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

শিক্ষা ও গবেষণায় সৃজনশীলতা: নতুন ধারণার জাগরণ

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্ব প্রতিযোগিতার মঞ্চে শুধু প্রচলিত জ্ঞান দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যেখানে মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে গবেষণা, সমস্যা সমাধান ও উদ্ভাবনী দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি বাস্তবিক সমস্যা সমাধানের উপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ‘ইনোভেশন ল্যাব’, ‘থিঙ্ক ট্যাংক’, এবং ‘স্টার্টআপ ইনকিউবেটর’ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

নবায়ণযোগ্য শক্তি: টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত এখনো আমদানিনির্ভর। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে যেতে হবে। সোলার প্যানেল, বায়ুশক্তি এবং বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের মতো প্রযুক্তিকে ব্যবহার করলে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হবে, অন্যদিকে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। প্রতিটি গ্রামে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা হয়ে উঠবে।

উন্নত কৃষি প্রযুক্তি: সৃজনশীল কৃষকের পথচলা

বাংলাদেশের কৃষিকে শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে, তা টেকসই ও লাভজনক করার জন্য সৃজনশীলতার প্রয়োগ জরুরি। স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি যেমন- ড্রোনের মাধ্যমে জমির সার ও পানির অবস্থা বিশ্লেষণ, স্মার্ট সেন্সরের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, এবং ডিজিটাল কৃষি বিপণন ব্যবস্থা চালু করা গেলে কৃষকের আয় বহুগুণে বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় লবণাক্ততা ও খরাপ্রতিরোধী নতুন ফসল উদ্ভাবনে গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে।

শিল্প ও প্রযুক্তি: বৈশ্বিক বাজারে দেশের নতুন সম্ভাবনা

শুধু পোশাক শিল্প নয়, বাংলাদেশকে বহুমুখী শিল্প উন্নয়নের দিকে যেতে হবে। প্রযুক্তিভিত্তিক খাত যেমন- সফটওয়্যার, রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হতে পারে। বিদেশে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি দেশীয় ইলেকট্রনিক্স, ওষুধ ও বায়োটেকনোলজি শিল্পের প্রসারে সৃজনশীল উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

টেকসই নগরায়ণ ও পরিবহন ব্যবস্থা: বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনার প্রয়োজন

শহরগুলোর অপরিকল্পিত বিস্তার, যানজট ও দূষণ রোধ করতে হলে টেকসই নগর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন, এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে শহরকে বসবাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য শহরগুলোতে সবুজায়ন বাড়াতে হবে এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

নতুন উদ্যোক্তা: সৃজনশীলতাই সাফল্যের মূলমন্ত্র

দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। ব্যাংক ঋণের জটিলতা কমিয়ে সহজ শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি, নতুন ব্যবসায়িক ধারণার জন্য ইনোভেশন হাব, কো-ওয়ার্কিং স্পেস এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ বাড়ানো দরকার। তরুণরা যদি নতুন পণ্য ও সেবা তৈরি করতে পারে, তবে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে নিজেদের একটি আলাদা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ: সৃজনশীল পরিকল্পনায় আত্মনির্ভরশীলতা

বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রকৃত চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে গ্রামের অর্থনীতিতে। শুধু শহর নয়, গ্রামকে সমৃদ্ধ করতে হবে নতুন ব্যবসা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজলভ্য ঋণ, ডিজিটাল বিপণন সুবিধা এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গ্রামীণ পণ্য বিশ্ববাজারে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এভাবে প্রতিটি গ্রাম হবে একটি স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ইউনিট, যা সামগ্রিক উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তুলবে।

সৃজনশীল প্রশাসন: জনসেবায় আধুনিকতা

একটি দক্ষ প্রশাসন ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থার জটিলতা ও আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই দরকার ডিজিটাল গভর্নেন্স, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং সরকারি সেবা সহজীকরণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বয়ংক্রিয় তথ্যপ্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে এনে জনগণকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি সেবা প্রদান সম্ভব হবে।

পরিবেশ ও জলবায়ু: প্রকৃতির সুরক্ষায় প্রযুক্তির প্রয়োগ

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি। নদী ভাঙন, বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রযুক্তিভিত্তিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। স্মার্ট বন্যা পূর্বাভাস, গ্রিন বিল্ডিং নীতি, এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সম্ভব। শিল্পকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কড়া নজরদারি এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন কৌশল গ্রহণ করলে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে।

উপসংহার
বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা শুধু প্রবৃদ্ধির সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না; বরং এই উন্নয়ন কতটা সৃজনশীল, টেকসই ও মানবিক, সেটাই হবে মূল নির্ধারক। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি দেশ, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নতুন কিছু সৃষ্টির সুযোগ পাবে, চিন্তা করবে উদ্ভাবনীভাবে, এবং তার প্রতিভা কাজে লাগিয়ে দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সৃজনশীলতার আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশই হবে ভবিষ্যতের শক্তিশালী, স্বনির্ভর এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। এখন সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ারÑ আমরা কি শুধু প্রচলিত পথে হাঁটব, নাকি সৃজনশীলতার আলোয় আলোকিত নতুন ভবিষ্যৎ গড়ব?
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার