প্রস্তাবনা :
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা একত্রে দেশের সামষ্টিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সংকট মানেই স্থবিরতা নয় সঠিক দিকনির্দেশনা ও সমন্বিত প্রয়াস থাকলে যেকোনো সংকটকে সুযোগে রূপান্তর করা সম্ভব। এ নিবন্ধে বর্তমান বাস্তবতা, করণীয় এবং উত্তরণের পথ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্র
অর্থনীতি হলো একটি দেশের মেরুদণ্ড। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছেÑ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ, আমদানিনির্ভরতা, মূল্যস্ফীতি, এবং বৈদেশিক ঋণের ভার।
করণীয়:
স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তি খাতের বিকাশ ঘটিয়ে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে।
রপ্তানি বহুমুখীকরণ: শুধু তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভর না করে তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষিভিত্তিক পণ্য রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার: এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে কর্মসংস্থানে অবদান রাখতে পারে।
রিজার্ভের সঠিক ব্যবস্থাপনা: বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং কৌশলগতভাবে ব্যয় হ্রাস করে রিজার্ভের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়ানো: বৈধপথে রেমিট্যান্স আনতে প্রণোদনা বৃদ্ধি করা এবং বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নে জোর দেওয়া জরুরি।
সামাজিক সংহতি: জাতীয় ঐক্যের অপরিহার্যতা:
সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা একটি রাষ্ট্রের অন্যতম বড় দায়িত্ব। সম্প্রতি বিভাজন, গুজব ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জাতীয় সংহতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য রাষ্ট্র, গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
করণীয়:
সচেতনতা বৃদ্ধি: বিভ্রান্তিকর গুজব প্রতিরোধে শিক্ষিত ও সচেতন জনগোষ্ঠীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা: ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে হবে।
মানবিক সহায়তা: সমাজের দুর্বল ও দরিদ্র অংশের প্রতি মানবিক দায়িত্ব পালন করা জরুরি। খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয় সুবিধা নিশ্চিত করতে স্বচ্ছ উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: যুবসমাজকে কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে, যাতে তারা স্বনির্ভর হয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে।
সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা:
সরকারের দায়িত্ব হলো স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
করণীয়:
অর্থনৈতিক সংস্কার: বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
দুর্নীতি দমন: প্রশাসন ও ব্যবসায়িক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: অহেতুক হরতাল, অবরোধ ও সহিংস কর্মসূচি পরিহার করে গঠনমূলক রাজনীতি করতে হবে।
গণমাধ্যমের দায়িত্ব: গঠনমূলক সমালোচনা, তথ্যনির্ভর প্রতিবেদন ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জনগণ বিভ্রান্ত না হয়।
সংকট থেকে উত্তরণের রূপরেখা
এ কঠিন সময়ে সরকার, জনগণ, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দল ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া সফলতা সম্ভব নয়। প্রতিটি খাতের দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণই বাংলাদেশকে সংকট মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলতে পারে।
সংক্ষেপে করণীয়:
* অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: উৎপাদন বাড়ানো, রপ্তানি খাতের প্রসার ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি।
*সামাজিক সংহতি: গুজব প্রতিরোধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা ও মানবিক সহায়তা।
* দায়িত্বশীল সরকার ও গণমাধ্যম: স্বচ্ছ নীতি গ্রহণ, দুর্নীতি দমন ও তথ্যনির্ভর সংবাদ প্রচার।
* রাজনৈতিক পরিমিতিবোধ: রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ ও সহিংসতা পরিহার।
সারকথা:
বাংলাদেশের এ সংকটময় সময়ে হতাশা নয়, বরং সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সংকট মোকাবিলার মাধ্যমে বাংলাদেশ যদি সঠিক পরিকল্পনায় এগিয়ে যায়, তবে এটি একটি আত্মনির্ভরশীল, সমৃদ্ধশালী ও উন্নত দেশে পরিণত হতে পারবে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এ চ্যালেঞ্জকে জয় করতে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
আপনার মতামত লিখুন :