ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫

পটপরিবর্তনে বাস্তবতা ও আগামীর প্রত্যাশা

মুনাওয়ার মইনুল
প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৫, ১২:২৫ এএম

২০২৪-এর রাজনৈতিক বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে ভবিষ্যতে চিহ্নিত হবে। দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক শাসন, দুর্নীতি ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এ বিপ্লব কি দেশকে একটি টেকসই গণতন্ত্র, সমৃদ্ধ অর্থনীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকে নিয়ে যাবে? নাকি পূর্ববর্তী সংকটগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ইতিহাসের গহ্বরে যেতে হবে, বর্তমান প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে, এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পথগুলো চিহ্নিত করাও জরুরি।

বিপ্লবের পটভূমি ও তাৎপর্য 
২০২৪-এর বিপ্লব শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি ছিল একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ছাত্রছাত্রী, তরুণ প্রজন্ম, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিস্ট, নারী নেতৃত্ব এবং শ্রমিক শ্রেণির সম্মিলিত শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। মূল চাহিদাগুলো ছিল-
১ . সব রকমের বৈষম্যের অবসান: কোটা বৈষম্য থেকে শুরু করে সব বৈষম্যের সমাপ্তি 
২ . নির্বাচন এবং নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার; স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবি  
৩ . ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ: স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে রাজধানীকেন্দ্রিক শাসন কমিয়ে আনা  
৩. অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার: দুর্নীতি দমন, কর সংস্কার এবং বৈষম্য কমানো।  
৪. সামাজিক অন্তর্ভুক্তি: সংখ্যালঘু ও আদিবাসী অধিকার, নারী-পুরুষ সমতা এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ

এ বিপ্লবের সাফল্য ছিল এর অহিংসতা এবং বুক চিতিয়ে সাহসের সঙ্গে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জগদ্দল পাথরেরে মতো জনতার বুকে চেপে থাকা ফ্যাসিবাদ হটিয়ে দেওয়া। পরবর্তী সময়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা। কিন্তু এই অর্জন টেকসই হবে কি না, তা নির্ভর করছে নতুন নেতৃত্বের নীতিনির্ধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর।

দ্বিতীয় পর্ব: রাজনৈতিক পুনর্গঠনের সম্ভাবনা ও সংকট: গণতন্ত্রের নতুন ভোর।
বাংলাদেশ একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারে যদি বিপ্লব-পরবর্তী সরকার এসব পদক্ষেপ নেয় -
সাংবিধানিক সংস্কার: রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে নাগরিকের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা।  
রাজনৈতিক দলের জবাবদিহি: দলীয় অর্থনীতির স্বচ্ছতা ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চালু।  
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের ওপর নানা ধরনের ডিজিটাল আইন ও হুমকি কমিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের নিশ্চয়তা।  

পুরোনো ভূতের প্রত্যাবর্তনরোধ: 
ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রায়ই এক অভিজাত গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পর্যবসিত হয়েছে। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরও দুর্নীতি ও দলীয়করণ বন্ধ হয়নি। ২০২৪-এর পরও যদি নতুন নেতৃত্ব নিম্নলিখিত ভুলগুলো করে, তবে সংকট ঘনীভূত হবে:  
ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অতিমাত্রায় ক্ষমতা সঞ্চয়।  
বিরোধী দলের দমন: রাজনৈতিক মাঠ সংকুচিত করে ‘ডিজিটাল সেন্সরশিপ’ বা গুম-খুনের পুনরাবৃত্তি।  
নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ: যেমন, ‘ইলেকশন টাইম সরকার’-এর পরিবর্তে দলীয় সরকারের আধিপত্য।  

তৃতীয় পর্ব: অর্থনীতির দ্বৈত সংকট ও সম্ভাবনা 
অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের সুযোগ-
বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি কিছু নীতিমালা গ্রহণ করে, তবে তা দক্ষিণ এশিয়ার নতুন অর্থনৈতিক মডেল হতে পারে:  
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: কৃষি, গার্মেন্টস এবং আইটি সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়ানো।  
জলবায়ু অর্থনীতি: ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য অভিযোজন প্রকল্পে বৈশ্বিক তহবিল আদায়।  
এসএমই ও স্টার্টআপ: যুবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবনী উদ্যোগের সম্প্রসারণ।  

আর নয় পুরোনো ফাঁদে পা: 
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা হলো ‘মধ্য আয়ের ফাঁদ’ এবং বিদেশি ঋণের বোঝা। ২০২৪-পরবর্তী সরকার যদি নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো সমাধান না করে, তবে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
রেমিট্যান্স নির্ভরতা: শ্রম অভিবাসনের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কমানোর বিকল্প নেই। প্রশিক্ষিত শ্রমিক বা অভিজ্ঞ কর্মী রপ্তানির ওপর জোর দেওয়া। 
ব্যাংকিং সেক্টরের সংকট: খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকিং সেক্টরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।  
বৈদেশিক বিনিয়োগের অভাব: আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারালে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আক্ষরিক অর্থে সব বিষয়ে যথাযথ ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ নিশ্চিত করা।

চতুর্থ পর্ব: সামাজিক ন্যায়বিচার ও বিভাজনের চ্যালেঞ্জ- 
সামাজিক সেতুবন্ধনের সম্ভাবনা: 
বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি ছিল সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। এই ঐক্য যদি বজায় থাকে, তবে এসব ক্ষেত্রে উন্নতি সম্ভব:  
নারীর ক্ষমতায়ন: সংসদ ও স্থানীয় সরকারে ৫০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ।  
ধর্মীয় সম্প্রীতি: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় শক্ত আইন প্রণয়ন।  
শিক্ষা সংস্কার: পাঠ্যক্রমে বৈষম্য ও উগ্রবাদ দূর করে বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে তোলা।  

বিভাজনের নতুন মুখোশ: 
বাংলাদেশের সামাজিক ঐক্য বারবার রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০২৪-পরবর্তী সময়েও যদি বিভাজন তৈরি হয়, তবে সহিংসতা ফিরে আসতে পারে। বিভাজনগুলো এমনÑ  
ডিজিটাল বিভাজন: সামাজিকমাধ্যমকে ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ও ঘৃণার প্রচার।  
শ্রেণি সংঘাত : ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়লে সমাজে অস্থিরতা ছড়াবে।  
প্রজন্মগত দ্বন্দ্ব: তরুণদের চাহিদা ও পুরোনো প্রজন্মের রক্ষণশীলতার মধ্যে টানাপড়েন।  

পঞ্চম পর্ব: ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ- 
২০২৪-এর বিপ্লব শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিকেও প্রভাবিত করেছে।  
ভারত-চীন সাম্য অবস্থা: দুই পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য রেখে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা চুক্তি নবায়ন।  
রোহিঙ্গা সংকট: জাতিসংঘপ্রধানের বাংলাদেশ সফরের আমেজ কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের ওপর  কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা।  
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক: মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অগ্রগতির জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সমর্থন আদায়।  

ষষ্ঠ পর্ব: ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি  
বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করছে তিনটি স্তম্ভের ওপর:  
১. নেতৃত্বের নৈতিকতা: রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত সুবিধা ত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে কাজ করা।  
২. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা।  
৩.নাগরিক সচেতনতা: গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় জনগণের সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা রাখা।

পরিশেষে, এটাই জানার বাকি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না কি নতুন ইতিহাস? 
২০২৪-এর বিপ্লব বাংলাদেশকে একটি ক্রসরোডে দাঁড় করিয়েছে। একদিকে, গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি এবং ন্যায়ের পথ; অন্যদিকে, স্বৈরাচার-বৈষম্য, দুর্নীতি এবং বিভাজনের অন্ধকার গলি। এ মুহূর্তে প্রয়োজন  সমষ্টিগত প্রজ্ঞা। রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ এবং তরুণ প্রজন্ম যদি হাতে হাত রেখে কাজ করে, তবে এ বিপ্লব সত্যিকারের ‘সোনার বাংলা’ গঠনের সূচনা হতে পারে। অন্যথায়, ইতিহাসের করুণ পুনরাবৃত্তিই আমাদের ললাটলিখন হতে পারে।

লেখক: সাংস্কৃতিক ও গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব