ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫

অন্তর্বর্তীতে মুঘলী ঈদের আমেজ

জুবায়ের দুখু
প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৫, ০৫:১১ পিএম
ছবিটি আসিফ মাহমুদ এর ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ঈদেই ফোটে মায়ের মুখে হাসি। তাই ঈদ আমাদের জনজীবনে এক বিশেষ মুহূর্ত। প্রচলন আছে ঢাকার ঈদ নাকি রসহীন। শহরবাসী ছেড়ে নাড়ীর টানে গ্রামে ঈদ উদযাপন করতে গেলে এ শহর হয়ে ওঠে লোকালয়হীন। এখন আমেজ বলতে ঢাকার স্থানীয়দের মধ্যে থাকে ঘরোয়ানা আয়োজন।

তবে ইতিহাসে খোঁজ করলে দেখা যায় এককালে এই শহরের ঈদ আয়োজন ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। কানাই কানাই বাজতো ঈদের জারিগান, আর ঘরে ঘরে ছিল ঈদ আয়োজনে পূর্ণতা।

গত কয়েক দশক আগেও ঢাকার ঈদ ছিল ইতিহাসবহল। তবে তার আগের মোঘলদের ঈদ ছিল ভিন্ন। প্রথম দিকে ধনী গরীব ভেদাভেদে ঈদ উদযাপন শুরু হলেও, পরে নায়েব-নাজিম এবং পঞ্চায়েত সর্দারদের আমল থেকে ঈদ উৎসব ক্রমাগত সর্বজনীন হতে শুরু করে।

মোগলদের সময় ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া হতো ভিন্ন কায়দায়। অনেকটা বান্ধবমূখর। একালে যেটা একেবারেই কিলশে। মোগল আমলে শোভাযাত্রা করে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। এ সময় মুসল্লিরা পথে পথে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণে সরোবর রাখতেন চারিদিকে।

কথিত আছে মোগল নবাব সুজাউদ্দীনের অধীনস্ত ঢাকার নায়েব সুবেদার মুর্শিদকুলী খান ঈদের দিন ঢাকার দুর্গ থেকে ঈদের ময়দান পর্যন্ত পথে প্রচুর পরিমাণ টাকাকড়ি ছড়িয়ে দিতেন।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও ঢাকা শহরে শোভাযাত্রা বা মিছিল করে ঈদগাহের মাঠে যাওয়ার প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের স্মৃতিচারণ বইয়ে তিনি বলেছেন, পুরানো পল্টনে ঈদের সবচেয়ে বড় জামাত হত। বিভিন্ন মহল্লা থেকে লোকেরা মিছিল (শোভাযাত্রা) নিয়ে আসত নামাজে অংশ গ্রহণের জন্য। এভাবে মিছিল করা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো। সবারই চেষ্টা ছিল নিজেদের মিছিল অন্যান্য মিছিলের চাইতে বর্ণাঢ্য করা।

মিছিল প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসান তার বইতে আরও বলেছেন, ঈদের দিন সকালে এসব মিছিল দেখার জন্য রাস্তার ধারে হিন্দু-খ্রিষ্টানরা দাঁড়িয়ে থাকতো। ঢাকায় বিদেশী যারা ছিল তারাও এসব মিছিলের ফটো তুলবার জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতেন।

ঈদ আনন্দ নিয়ে ঢাকাবাসী তথা সমগ্র বাংলাদেশ সেই ইংরেজি আমল থেকেই বেশি আগ্রহী দেখা যায়। ব্রিটিশ আমল বা দেশভাগের কারণে এই আনন্দে কিছুটা ভাটা পড়লেও থেমে থাকেনি ইদ মিছিল বা শোভাযাত্রা। ঢাকাইয়ারা তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে দেয়নি।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনৈতিক আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল। সেই সময় থেকে ঈদ ঢাকা তথা বাংলাদেশে আরও বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। ঢাকার নেতারা ঈদ আনন্দ অর্থাৎ মিছিলের ব্যপারে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। আর এসব মিছিলে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল অন্যতম
বৈশিষ্ট্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীয়ান মুহাম্মদ সিদ্দীক খান ঈদ মিছিল সম্পর্কে এক স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, ১৯২০ সালের দুর্যোগ পর্যন্ত ঈদ মিছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হিসাবে চালু ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হাঙ্গামায়, উপ্তত্ত পরিস্থিতির জন্য এই ইদ মিছিল ক্রমাগত পরিত্যক্ত হতে শুরু করে। তবে ঢাকায় জাঁকজমক সহকারে মহররম ও জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হত। হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর মিছিল এত জাঁকজমকসহকারে বের হত যে, সারা ভারতে এর জুড়ি ছিল না।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে আলম মুসাওয়ার নামে একজন চিত্রশিল্পী ঢাকার ঈদের মিছিল এবং মহররমের মার্সিয়া মিছিলের কিছু ছবি আঁকেন। ছবিগুলোতে দেখা যায়, ঈদের মিছিলে নায়েব-নাজিমদের নিমতলী প্রাসাদ (বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটির পেছনে), চকবাজার, হোসেনি দালানের মতো সেই সময়ের ঢাকার বিশেষ বিশেষ স্থাপনার সামনে দিয়ে যেত। মিছিলে থাকত সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি, পালকি এবং অস্ত্র হাতে সৈন্যদল। কখনো কখনো ব্যান্ডপার্টিও দেখা যেত।

নাট্য ব্যক্তিত্ব জনাব সাঈদ আহমেদ ১৯৯৪ সালে ২৫ অক্টোবর লন্ডন বিবিসি রেডিওতে ঢাকার সংস্কৃতি বিষয়ক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঈদ মিছিল প্রত্যেক সোসাইটিতে খুব ইমপোটেন্ট একটি আউটলেট। সেদিক দিয়ে ঢাকার মুসলমানরা ঈদের মিছিল করতো বিরাট। আর এসব ঈদ মিছিলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক এবং মুসলিম দেশগুলির ঘটনা ক্যারিক্যাচারের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। ঈদের মিছিলে ঢাকার প্রায় সকল মহল্লা হতে মুসলিম বিশ্বের এবং নগর জীবনের ঐতিহ্য ও সমস্যার চিত্রগুলো তুলে ধরে তাদের দুঃখ সহানুভূতি প্রকাশ করা হত ।

ঢাকার ঈদ আনন্দে ঈদ মিছিল একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি। দেশের আর কোথাও এ ধরনের সংস্কৃতি দেখা যায়নি। আর এজন্য এ মিছিল মুঘল আমলে থেকে ছোট আকারে শুরু হলেও একসময় এই মিছিল প্রতিবাদ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলে পরে এটি গণমানুষের মিছিলে রূপ নেয়। এসব মিছিলে সামাজিক সচেতনতা, প্রশাসকদের ব্যর্থতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপের কথাও উঠে আসতো। ফলে ঈদ মিছিল অনেকটা জড়িয়ে ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে।

সর্বশেষে ঢাকার ঈদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেয়র মো. হানিফ। তারপর দীর্ঘদিন ঈদ মিছিল বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে এটি স্বল্প পরিসরে আয়োজন করে হাজারীবাগের ‘ঢাকাবাসী’ সংগঠন। সে মিছিলের ধরন অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেলেও তারা ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। তারা ঈদ মিছিলের ব্যানারে ঢাকার নাগরিক সমস্যাগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একটিকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করতেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গত গত ২৬ মার্চ রাত সাড়ে ১১টায় এক ফেসবুক পোস্টে ঢাকার ঈদ মিছিল সম্পর্কে, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পুরোদমে এই ঈদ মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আয়োজনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের পাশের মাঠে (বাণিজ্য মেলার পুরান মাঠ) অনুষ্ঠিত হবে ঈদ জামাত। ঈদের নামাজ শেষে মোগল আমলের রীতি অনুযায়ী থাকবে ঈদের আনন্দ মিছিল। মিছিলটি জামাতের স্থান থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে সংসদ ভবনের সামনে এসে।

এর আগে গত রোববার (২৩ মার্চ) ফেসবুকে  পোস্ট করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের ঈদে উৎসবের আমেজ নেই। টিভি প্রোগ্রাম দেখে কিংবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেটে যায় ঈদ। ঈদের জামাত ছাড়া কালেক্টিভ কোনো কর্মসূচি নেই।’

‘এবারের ঈদকে নগরবাসীর জন্য আরও সুন্দর করতে আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদ মিছিলের বিষয়ে আমরা কমবেশি সবাই অবগত আছি। সুলতানি আমলে, পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলেও ঈদ মিছিলের আয়োজন করা হতো। এই সংস্কৃতিকেই এবার থেকে রিভাইভ করার উদ্যোগ নিচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।’

তিনি বলেন, ‘এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের পাশের মাঠে (বাণিজ্যমেলার পুরাতন মাঠ) ঈদের জামাত হবে। ঠিক গ্রামের ঈদগাহের পাশে যেমন ছোট মেলা বসে তেমনই মেলা থাকবে দিনব্যাপী। নামাজের পরে হবে ঈদ আনন্দ মিছিল। আনন্দ পূর্ণ ও বর্ণাঢ্য একটি মিছিল আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আয়োজনের কোনো অংশেই ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করে এমন কিছু থাকবে না। মিছিলটি জামাতের স্থান থেকে শুরু হয়ে সংসদ ভবনের সামনে এসে শেষ হবে।’

আসিফ মাহমুদ আরও লিখেন, ‘আসুন নতুন বাংলাদেশে নতুনভাবে আমাদের ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেই। এবারের ঈদটা একসাথে উদযাপন করি। নগরবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই এই আয়োজনকে সাফল্যমণ্ডিত করবে।’