বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার চিন্তা থেকে সরে এসেছে সরকার। অর্থাৎ নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী বছরেই এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের দিন ঠিক আছে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর।
বিষয়টিকে আরও পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিল অন্তর্র্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে) এ ভাবনার কথা বলেছিলেন।
তখন জানানো হয়েছিল, উত্তরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি করা হয়েছে।
২০২৬ সালেই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে, তা মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এই উত্তরণে বাংলাদেশের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে। এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)।
এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এ তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়।
যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এ মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়।
২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তাহলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে। ২০২৬ সালেই এলডিসি উত্তরণ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত।
এখন উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশল ঠিক করা আছে। প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে প্রস্তুতি নিতে হবে। জোর দিতে হবে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সামাজিক সুরক্ষায়।
এলডিসি উত্তরণের বিষয়টি আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের মধ্যে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। এতে নির্বাচন-পরবর্তী সরকার তাদের মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় তা অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্তবাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে।
এলডিসি দেশগুলো এক ধরনের উন্নয়নশীল দেশ। যেসব দেশের সক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাদের এ তালিকায় রাখা হয়। আগামী পাঁচ বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় আছে ছয়টি দেশ।
বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় আরও দুটি দেশ লাওস ও নেপাল আছে। ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়।
এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো- ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুইটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ।
এলডিসি থেকে বের হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং আগের চেয়ে বাড়বে এবং এখনকার চেয়ে কম সুদে ঋণ পাওয়া যেতে পারে।
আর্থিক বাজারের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে আরও ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে। অন্যদিকে, চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্কমুক্ত ও বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা থাকবে না। ফলে রপ্তানি বিশেষত, তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
অন্যদিকে, কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নে প্রাধিকার থাকবে না। ওষুধ শিল্প পেটেন্ট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান থেকে এত দিন যে অব্যাহতি পেয়ে আসছে, তা থাকবে না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক নীতিগুলো পালন করতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে বাংলাদেশকে একটি উত্তরণ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের এ অর্জন বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে এবং আরও অধিকতর উন্নয়নের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করবে। প্রস্তুতিকালে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা এত দিন পেয়ে আসছিল, সেগুলো অব্যাহত থাকবে।
তা ছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরাও ৩ বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এলডিসি উত্তরণে পণ্য রপ্তানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বার্ষিক চাঁদা বেশি দিতে হবে বাংলাদেশকে।
এ ছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইস্যুতে ওষুধশিল্পে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। বেড়ে যাবে ওষুধের দাম এবং এতে রপ্তানি বাজারও কিছুটা সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহজশর্তের ঋণ ও অনুদান সহায়তা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। রপ্তানি পণ্য ও শিল্পে ভর্তুকি দেওয়ার সুবিধা হ্রাস করতে হবে।
তবে বেশকিছু কিছু কৌশল নেওয়া গেলে সহজেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে দেশের সামনে।
তবে দেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি প্লাস এবং স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি পাওয়া যেতে পারে। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
সেক্ষেত্রে শ্রম অধিকার, কারখানার কর্মপরিবেশ ও মানবাধিকার ইস্যুতে ২৭টি শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে ইইউ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব শর্ত পালনে বেশকিছু কৌশল নেওয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর বেশকিছু বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসবে।
কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও সুযোগও তৈরি হবে অনেক। সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে।
এলডিসি উত্তরণের ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে হলেও ঋণ নিয়ে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিক খরচ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলোর দেওয়া রেটিং বাড়বে, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। এই অর্জন বড় ভূমিকা রাখবে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে।
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়াবে। দেশের ভাবমূর্তি ব্র্যান্ডিংয়ে বড় ভূমিকা রাখবে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এটি দেশের জন্য বড় অর্জন- শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রবাসে যারা ব্যবসাবাণিজ্য করছেন তাদের জন্য এ অর্জন সহায়ক হবে। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই পেতে যে ক্রেডিট রেটিংয়ের প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেক উপাদান থাকে। ব্যবসার পরিবেশকে উপযুক্ত করার জন্য সরকারের অনেক নীতি থাকে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হলে এসব নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে এলডিসি থেকে উত্তরণে অনেক সমস্যা তৈরি হবে, এগুলো সমাধানে ভূমিকা নিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে অগ্রাধিকার বাণিজ্যসহ মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল ও রপ্তানি বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করার প্রস্তুতি দিতে হবে বাংলাদেশকে।
উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার কারণে আমরা অনেক সুবিধা যেমন পাবো, তবে স্বল্পোন্নত দেশের সব সুযোগগুলো পাবো না। বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণে নিঃসন্দেহে দেশের ভাবমর্যাদার জন্য গৌরবের। ত
বে দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা দুটিই অপেক্ষা করছে সামনে। এ অর্জন অবশ্যই আমাদের আশাবাদী করে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া যেমন গৌরবের, তেমনি তা চ্যালেঞ্জেরও বটে। বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে বাণিজ্যে যে অগ্রাধিকার পায়, তার সবটুকু পাবে না।
আবার বৈদেশিক অনুদান, কম সুদের ঋণও কমে আসবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নতুন কিছু শর্ত পরিপালনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় এগিয়ে থাকতে হলে বাংলাদেশকে এখন থেকেই জিএসপি প্লাস প্রাপ্তির শর্তগুলো পূরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ-পরবর্তী দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল করার প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করছে অনেক সমীকরণ। বিষয়গুলো মাথায় রেখে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
বিদেশি প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে আমদানি-রপ্তানি-করনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। চাপে পড়ে হলেও এসব নীতি-সংস্কার আখেরে আমাদের জন্য ভালোই হবে। আমরা এরই মধ্যে আমাদের কারখানাগুলোকে অনেকটাই পরিবেশ ও শ্রমিকবান্ধব করতে পেরেছি।
তবে বাদবাকিদেরও একই মানের হতে হবে। সবুজ জ্বালানির ব্যবহার, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমাদের শিল্প-কারখানাকে আরও আধুনিক ও মানবিক করার তাগিদ বাড়বে। প্রতিযোগী মূল্যে পণ্য রপ্তানির জন্য এ পরিবর্তন অপরিহার্য হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে আরও স্মার্ট করতে হবে।
নতুন করে বিশ্ব বাণিজ্যনীতিতে যেসব পরিবর্তনে আমাদের সায় দিতে হবে তাতে কোনো রকম হেলাফেলা চলবে না। মনে রাখতে হবে, এলডিসি হিসেবে এত দিন মেধাস্বত্ব, পেটেন্ট, আইসিটি ও সেবা খাতে বিশেষ বিশেষ যেসব সুবিধা পেতাম, উত্তরণের পর সেসব উঠে যাবে।
আমাদের ওষুধশিল্প ২০৩৩ পর্যন্ত উন্নত বিশ্বে শুল্কবিহীন সুবিধা পেতেই থাকবে। ওই সময় পর্যন্ত আইপিআরের শর্তগুলো শিথিল থাকবে। প্রযুক্তি ও কাঁচামালও আমরা সহজশর্তে আমদানি করতে পারব। এর পর আমাদের নিজস্ব গবেষণা, পেটেন্টসহ উন্নততর বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।
গার্মেন্টস খাতেও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা আমাদের গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু শুল্ক দিয়েই আমরা আরএমজি রপ্তানিতে আমাদের শক্তিমত্তা দেখাচ্ছি। জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে খুব একটা সহায়তা না পেলেও নিজেদের অর্থ খরচ করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে যেসব বৃত্তি, অনুদান আন্তর্জাতিক ও উন্নত দেশ থেকে পেয়ে থাকি, সেসব হয়তো কমে যাবে। তবে দরকষাকষি করে খানিকটা রক্ষা করাও সম্ভব।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা- তাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদের হার খানিকটা বাড়াবে। এ প্রক্রিয়া এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শুরু হয়ে গেছে। তবে ভয় না পেয়ে আমাদের নিজেদের শক্তির জোর দেখাতে প্রস্তুতি নিতে হবে। কৃষি ও রপ্তানিপণ্যের বহুমুখীকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার আমরা নিশ্চয় তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সক্ষম।
অবকাঠামোর উন্নয়ন, ব্যবসার পরিবেশ সক্ষমতা, বন্দর ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বাড়িয়ে নিশ্চয় শুল্ক দিয়েও আমাদের পণ্যকে বিশ্বে প্রতিযোগী করে তুলতে পারি। তাই এখন আমাদের নতুন পণ্য, নতুন বাজার এবং উৎপাদন পদ্ধতিকে আধুনিক করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
আমরা যদি আগামী দিনে জ্ঞানভিত্তিক ও সবুজ অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিই এবং সেজন্য কাক্সিক্ষত মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে পারি, তা হলে উত্তরণের পরও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে জোর কদমে। এ ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের বিষয়টিই সবচেয়ে বড় কথা। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে ধারার সূচনা করেছি, তা শুধু অক্ষুণ্ন নয়, আরও গতিময় করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া তেমনটি করেই আজ উন্নত দেশ।
ভিয়েতনামও সেই পথে হাঁটছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং চীনও একই পথের যাত্রী। তাই কোনো দিকে না তাকিয়ে দেশি-বিদেশি সম্পদের সমাবেশ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উচ্চ প্রবৃদ্ধির পথেই আরও অনেকটা পথ আমাদের হাঁটতে হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাব না, জাতিসংঘ থেকে অনুদান এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ফ্রি টিকিট পাব না- এসব অবান্তর ভাবনা থেকে এখন আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
আমরা এখন আর কতইবা অনুদান ও রেয়াতি সুদে বিদেশি ঋণ নিই? প্রায় সব ঋণই তো ‘নন-কনসেশনাল’ হয়ে গেছে। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবেই বাংলাদেশকে বিশ্ব অর্থনীতির মাঠে দৌড়ে খেলতে হবে।
চীন থেকে অনেক উদ্যোক্তাই ‘রুলস অব অরিজিন’-এর সুযোগ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ থেকেই বিদেশিরা তাদের পণ্য রপ্তানি করবেন।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এসব পণ্য রপ্তানি থেকে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ যেন বাংলাদেশেই পুনর্বিনিয়োগ হয়। আমাদের মধ্য ও উচ্চ আয়ের মানুষের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে।
তাদের উচ্চমানের পণ্যের ভোগের চাহিদাও বাড়ছে। বাড়ন্ত এই অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে নিশ্চয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও মনোযোগ রয়েছে। তাই আমাদের দেশীয় বাজারেও প্রযুক্তিনির্ভর নয়াপণ্যের বিকিকিনি বাড়বে।
আমাদের তাই দ্রুতই ‘নিট আমদানিকারক’ দেশের পরিচয় ঘুচিয়ে আরও আমদানিবিকল্প এবং রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত সুযোগ বাড়িয়ে যেতে হবে।
রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমাদের দেশেই দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা আমাদের ইপিজেড, বেজা, বেপজা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন করবেন- সেই সক্ষমতা অর্জনের দিকেই আমাদের নীতি-মনোযোগ বাড়াতে হবে।
এরই মধ্যে আমরা সিমেন্ট, পেট্রো কেমিক্যাল, উন্নতমানের বড় সুতা উৎপাদনে প্রভূত উন্নতি করেছি। এসব সহায়ক শিল্পের উন্নয়নে একদিকে দেশি বাজারের জন্য শিল্পায়নের জন্য কাঁচামালের চাহিদা মিটছে, অন্যদিকে আমাদের প্রতি ইউনিট রপ্তানি আয় থেকে মূল্য সংযোজনও বাড়ছে।
এভাবেই আমাদের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ সেøাগানটিকে বাস্তবে রূপায়ণ করতে হবে। আমাদের উন্নয়নের এ ধারাকে আরও বেগবান করতে তাই সরকারকে অবারিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবহন, দক্ষ বন্দর ব্যবস্থাপনা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের সক্রিয় ব্যক্তি খাতকে আরও দক্ষ করার জন্য ব্যবসায় সহায়ক নীতি, তথ্য, আর্থিক খাতের আরও আধুনিকায়ন ও সুশাসন এবং সর্বোপরি মহামারি-উত্তর নয়া পৃথিবীতে নিজেদের শক্তিমত্তা বজায় রাখতে সবুজ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের কৌশলকে আরও জোরদার করতে হবে।
আগামী দিনগুলোয় আমাদের আরও ব্যাপক হারে সম্পদের সমাবেশ ঘটাতে হবে। সেজন্য কর কাঠামোর ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা প্রকল্পগুলো দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে হবে।
এসবই হবে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বড় সহায়ক। আর কর্মসংস্থান বাড়লেই দারিদ্র্য কমবে। বৈষম্যও কমবে। তা ছাড়া রপ্তানি খাতে বস্ত্রশিল্পের বাইরের উদ্যোক্তা যেন একই রকম প্রণোদনা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে।
রপ্তানি বাড়াতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চৌকস অর্থনৈতিক কূটনীতির কোনো বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও বাণিজ্যনীতি ঢেলে সাজাতে হবে।
তবেই না উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা আমাদের মানমর্যাদা বজায় রাখতে পারব। সবশেষে বলতে চাই, উন্নয়নশীল দেশের উপযুক্ত মানব শক্তি এবং স্মার্ট কূটনীতির প্রসারে যা যা করা দরকার সরকারসহ সব অংশীজনকে নিষ্ঠার সঙ্গে তা করতে হবে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে (এলডিসি) উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার পরিকল্পনা বা স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্র্যাটেজি (এসটিএস) বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে সরকার।
এদিকে এলডিসি উত্তরণকে মসৃণ ও টেকসই করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এসটিএস কর্মকৌশল অনুমোদন ও প্রকাশ করা হয়েছে। এ কর্মকৌশল বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তার জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলডিসি উত্তরণে আমাদের সামনে খুবই কম সময় রয়েছে।
ফলে স্বল্প সময়ে ঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। এ কারণে এসটিএস কীভাবে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটি দেখভাল করবে এ কমিটি। এসটিএস বাস্তবায়নে এরই মধ্যে অনেক উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।
তাদের মধ্যে দায়িত্বও বণ্টন করা হয়েছে। ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি এসব উপকমিটিকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করবে। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পায় বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ সুবিধা আর থাকবে না।
তাই ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকেরা এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
ব্যবসায়ীদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতে সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছিল।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সময়সীমা না পিছিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক