কর্মপরিবেশ। নিরাপদ, সহযোগিতামূলক। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা; সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পেশাগত উন্নয়নে উৎসাহিত করা। নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। বাড়ছে অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের গতি। এ ধারা অব্যাহত রাখতে কর্মপরিবেশের উন্নয়ন জরুরি। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় কর্মীদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা থাকলেও সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ নেই। প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ও অংশীজনদের সচেতনতা ও সদিচ্ছা।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হলে দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ- দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রথম পূর্বশর্ত। এর সমন্বয়ে তৈরি হয় সুস্থ ও সুন্দর কর্মপরিবেশ।
এটি পেশাগত সাফল্য, সম্মান ও পারস্পরিক সহযোগিতারও মূল ভিত্তি। নারী ও পুরুষ সহকর্মীদের সমমর্যাদার বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য কিংবা কাম্য নয়। কর্মক্ষেত্রে অশালীন ভাষা প্রয়োগ এবং যৌন হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড- নৈতিক স্খলন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়।
কর্মজীবনে পারিবারিক শিক্ষা একজন ব্যক্তির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এটা শুধু ওই ব্যক্তির আচরণ, মূল্যবোধ ও নীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার নেতৃত্বের ধরন, সমস্যা সমাধানের কৌশলেও প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পেশাগত উৎকর্ষতা, আনুগত্য, সততা ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা একজন ব্যক্তির জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এ সমস্ত গুণাবলির কারণে কর্মক্ষেত্রে সুনাম অর্জন ও সহকর্মীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক।
কর্মপরিবেশ এমন হওয়া দরকার যেখানে নারী ও পুরুষ কর্মীরা থাকবে আচরণের দিক থেকে ইতিবাচক ও সংবেদনশীল। নারী-পুরুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পৃক্ততা বজায় রাখা। সমতার ভিত্তিতে উভয়ের মাঝে কর্ম ও দায়িত্ব বণ্টন করা। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখনই যখন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা থাকে না।
কর্মপরিবেশে একজন ব্যক্তির (নারী-পুরুষ) ব্যক্তিজীবন ও পেশাগত আচরণ কী হওয়া উচিত এবং কর্মক্ষেত্রে যতক্ষণ অবস্থান করা হয় (নির্ধারিত সময়), সেসময় পর্যন্ত কার্যক্রম পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় কী কী প্রতিফলন হবে বা হওয়া উচিত নয়- এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার প্রয়াস এ লেখা।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণের জন্য এনজিওর বিকাশ ঘটে। নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন (এনজিও), যা সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত। অরাজনৈতিক অলাভজনক সামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করে।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিওর দ্রুত বিকাশের কারণে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি থানাপর্যায়ে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মূলত ক্ষুদ্রঋণের কারণে এনজিও কার্যক্রমের ব্যাপকতা লক্ষণীয়।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর তথ্যানুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশে এনজিওর সংখ্যা ২ হাজার ৬শ’ ৪৪টি। এসব এনজিও ত্রাণ, পুনর্বাসন, সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (শিশু ও বয়স্ক), প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি, প্রতিবন্ধী ও সিনিয়র সিটিজেনদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া, গৃহায়ন, ক্ষুদ্রঋণ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, মৎস্য চাষ, কৃষি উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গঠন, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, পরিবেশ সুরক্ষা, রিনিউয়েবল এনার্জিসহ অনেক উদ্ভাবনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে।
এনজিওগুলো দেশের সুবিধাবঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সেবাপ্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই নারী। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের স্বাবলম্বী করাই এর মূল লক্ষ্য।
যাতে তারা একটি মর্যাদার আসনে আসীন হতে পারেন। তাই বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নারী তার অবস্থানকে করেছে আরও শক্ত ও সুদৃঢ়। এতে কোনো সন্দেহ নেই, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। গ্রামীণপর্যায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থের গতিশীলতা, ক্রয়ক্ষমতাসহ নারীর ক্ষমতায়ন।
এত এনজিওর কারণে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের খাত তৈরি হয়েছে। অনেকে এখানে কাজ পাওয়ার সুযোগে পরিবার-পরিজন নিয়ে সচ্ছল জীবন-যাপন করছেন। একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে নিজের ‘উন্নয়ন’ কতখানি করতে পেরেছেন সেটা এক বড় প্রশ্ন। মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে প্রধান কার্যালয়ের নারী ও পুরুষ কর্মীদের বদলি, শোকজসহ মানসিক ও শারীরিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
বিশেষ করে নারীকর্মীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ- এগুলো কোন্ উন্নয়নকর্মীর কাজ! এ ছাড়া আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি- ছাপিয়ে গেছে সব সীমা। একদল বিপথগামী উন্মাদ-উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে এসব কর্ম। বাদ পড়ছেন না পর্ষদ সদস্যরা। নেই সততা ও মানবিকবোধের চর্চা।
পরিবর্তনের শক্তিশালী নেতৃত্ব নারী।
নারীর বিচক্ষণতা ও সুদূরপ্রসারী ভাবনা নাড়া দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মূর্ত প্রতীক নারী। সিদ্ধান্তে অটল ও অবিচল। বিশ্ব অঙ্গনে নারীর প্রতিনিধিত্বকে দেখা হচ্ছে নতুন করে। নারীর ভাবনায় এসেছে এক অলঙ্ঘনীয় পরিবর্তন। ঘরে ও বাইরে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন ‘দশভূজা নারী’। ‘কর্মই ধর্ম’- এ ব্রত নিয়েই এগিয়ে চলেছেন তারা। আমাদের দেশের নারীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন।
সর্বত্রই নারীর জন্য চ্যালেঞ্জ, সেক্ষেত্রে এ বিপর্যয় নারীকেই সামাল দিতে হয়। কারণ, অস্বীকার করার উপায় নেইÑ নারীই ঘর সামলান। সন্তানের লালন-পালন করেন। পুরুষের তুলনায় নারীরাই তাদের শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের যত্ন, দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। একজন কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন তিনগুণ।
কেনাকাটায় পুরুষের অংশগ্রহণ থাকলেও বর্তমানে কর্মজীবী নারীরাও ঘরের কেনাকাটায় একইভাবে দায়িত্বশীল। পরিবারের শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ সদস্যদের দেখভালের দায়িত্বটাও কর্মজীবী নারীকে নিতে হয়। এসব নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও সংসারের টুকিটাকি অন্য কাজে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় বেশি। তবে কর্মজীবী নারীর ঘরের কাজের আর্থিক মূল্যায়ন করা হয় না। তাই এর গুরুত্বও দৃশ্যমান হয় না। কারণ আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটাই স্বাভাবিক চিত্র।
ঘরের কাজে নারীর পাশাপাশি পুরুষ এগিয়ে আসবেÑ এ সংস্কৃতি আমাদের সমাজে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারী যতটা অর্থ উপার্জনে এগিয়ে এসেছে, পরিবারের হাল ধরেছে কিন্তু সেই তুলনায় পুরুষ এগিয়ে আসেনি ঘরের কাজে। এ বৈপরীত্যের জন্য সমাজ দায়ী, নাকি পুরুষের মন-মানসিকতা!
এত সংকট মোকাবিলা করেও যখন একজন নারী তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানের তোয়াক্কা করে না, নিজেকে সংযুক্ত করে সেই লোভী, দানবরূপী পুরুষকর্মীর সঙ্গে- এ চিত্র সত্যিই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ঙ্কর।
একজন নারী সহকর্মীকে কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা মানবিকবোধের মধ্যে পড়ে। সে ক্ষেত্রে নারী সহকর্মীর যদি ছোট বাচ্চা থাকে, তাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি বা প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতন করে তার পক্ষে কর্মক্ষেত্রে কিইবা দেওয়া সম্ভব (যদিও দায়বদ্ধ নারীকর্মীর কাছে)? অথচ অহঙ্কার পোষণ করা হয়- তিনি উন্নয়নকর্মী। একজন উন্নয়নকর্মী হবেন নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল। এটা না হলে এ জাতি আরও সংকটে পড়বে।
কারণ মানবিক মূল্যবোধ হারাচ্ছি প্রতি পদে পদে। বড় পদ, মোটা অংকের বেতন- গর্ব করে বলা হয়, ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে দীর্ঘকাল কাজ করছি। কোথায়, কখন কী বলা উচিত বা অনুচিত, স্থান-কাল-পাত্রÑ এ জ্ঞান যার মধ্যে ডেভেলপ হয়নি তাদের কী বলা যায়? মানসিক ভারসাম্যহীন! মানসিক স্বাস্থ্যের ঘাটতি।
কর্মপরিবেশ সুস্থ ও সুন্দর হবে- এটি দাবি নয়, এটি অধিকার। কারণ সুস্থ পরিবেশ তৈরি করে উৎপাদনশীল জনশক্তি। এই জনশক্তি শারীরিক ও মানসিক শক্তি ও স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেললে অনিবার্যভাবে নেমে আসে দুর্যোগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বজনবিদিত উক্তিটি উল্লেখের দাবি রাখে:
‘বিদ্যা সহজ
শিক্ষা কঠিন
বিদ্যা আবরণে আর
শিক্ষা আচরণে।’
কারণ নারী খেলনা নয়, রয়েছে জ্ঞান, বিদ্যা, মানসিক ঐশ্বর্য, বল ও বৈরাগ্য। যার দ্বারা অসুরকে বিনাশ করা সম্ভব। নারীই হলো অসুর বিনাশের প্রতীক। এটিই নারীর মহাশক্তি। সব নারীর ব্রত হোক এটাই।
লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও প্রধান
কমিউনিকেশন, পাবলিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ
উদ্দীপন, প্রধান কার্যালয়।
আপনার মতামত লিখুন :