ষড়ঋতুর পরিক্রমায় প্রকৃতির খেলায় নাগরদোলার ন্যায় বছর ঘুরে আবার এলো বাঙালির সর্বজনীন লোক উৎসব পহেলা বৈশাখ। প্রতিটি বাঙালি বর্ষবরণে প্রথম দিনের নতুন সূর্যকে আহবান জানাবে সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে।
ঢাকায় আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হবে উৎসব উদযাপন। আর তাই খুব ভোরে ভোরে ঘুম থেকে উঠে নতুন জামাকাপড় পড়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেয় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার বাঙালি।
সূর্যোদয়ের পরপর ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…। তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক, এসো এসো…’ গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানাবে।
তবে বাঙালির বির্তকের শেষ নেই। আজ এটা নিয়ে তো কাল ওটা নিয়ে। বির্তকের ধারাবাহিকতা মোটাদাগে এ বঙ্গে ইতিহাসবহুল। বাজার থেকে ঘাট, নদী থেকে সমুদ্র, এসব নিয়ে খুব বির্তক না হলেও, বির্তক শুরু থেকে শেষ কেবলই ধর্মীয় কালচার আর দেশীয় সংস্কৃতির বেলায়।
আমাদের আধুনিকতা আমাদেরই পেয়ে বসেছে এক ভয়াভহ রোগে। ফেসবুক হাতে নিলেই আমরা যেন বির্তকের খাতা খুলে বসি। এ যেন সংবাদপত্রের মতো ইভেন্ট কাভার দেওয়া। মানে কোনো ইস্যু বাদ দেওয়া যাবে না। কোনো ঘটনা নজরে আসা মাত্রই আমরা মালকোঁচা কাচা মেরে নেমে পড়ি সেই ঘটনার নাড়িভুঁড়ি টেনে হিঁচড়ে বের করতে। সেটা রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক কোনো ইস্যু।
এখন দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সংস্কৃতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। আমরা বাঙালিরা বর্তমানে মজেছি পহেলা বৈশাখ উদযাপন বিতর্কে। কেননা অনেকের মতে এটা এদেশের কোনো কালচার নয়।
আবার ধর্মের দিক থেকে অনেকেই বলছেন বাংলা নববর্ষ উৎযাপন একটি হিন্দুয়ানি কালচার, যা ধর্মীয় সংস্কৃতিতে, অনুভূতিতে আঘাত করে বা সাংঘর্ষিক।
তাদের মতে, ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে যে জনস্রোত বের হয়, তার ভেতর সনাতন ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রকাশ পায়। এতেই বোঝা যায়, বাঙালি সংস্কৃতি মানেই যেন হিন্দুয়ানি ব্যাপার। বাংলা নববর্ষ নিয়ে আবার কেউ কেউ বলে থাকেন এই উৎসব আসলে পশ্চিমা থেকে ধার করে আনা।
মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের জন্য ২০২২ ও ২০২৩ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান একটি আইনি নোটিশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনকে পাঠিয়েছিলেন।
এই নোটিশে বলা হয়েছিল, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই।
‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আকৃতি যেমন- পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’ রবী ঠাকুর কিন্তু তার লেখায় বৎসরের আবর্জনা দূর করার আহ্বনা জানিয়েছিলেন।
এখান থেকেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় এ দেশ কোনো ধর্মের একার নয়। এদেশ হিন্দ-মুসলিম, বৌদ্ধ-খিষ্ট্রান সবার। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে পহেলা বৈশাখের নামে দেশে যে কালচার বা সংস্কৃতি চলমান তার উদ্ভব কোথায়?
শুরুতে যে বিষয়টি বলা দরকার সেটা হলো বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের বসবাস। ফলত সব ধর্মের সমন্বয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বা ওঠে সেটাই বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি।
একটু অতীত ফিরে দেখলে বোঝা যাবে এ বাংলায় বৈশাখ উদযাপন কীভাবে এল। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় শুরু করেন।
কিন্তু ভেজাল বাধলো অন্যখানে, কেননা হিজরি সনের চাঁদ আর কৃষি ফলন, দুটই আলাদা আলাদা সময়ে উঠতো ফলে কেউ কারোর সঙ্গে মিলত না।
এ কারণে কৃষকদের খাজনাদি পরিশোধ করতে হতো ফসল ওঠার আগেই। সেক্ষেত্রে দেখা যেত ওইসব খেটে খাওয়া কৃষকদের খুবই নাজেহাল অবস্থা হয়ে যেত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা ও সহজিকরণের লক্ষ্যে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আর এভাবেই সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ হয় আকবরী আমলে।
যেহেতু ফসলকে কেন্দ্র করে এই সনের সৃষ্টি তাই প্রথম দিকে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে প্রবর্তন হয়। এরপর থেকেই ফসল আর নতুন বাংলা বর্ষকে ঘিরে কৃষকদের ঘরে নতুনভাবে একটা উৎসবের আমেজ শুরু হতে থাকে।
তার একটা বড় কারণ তখন প্রতিটি বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাসুল ও শুল্ক পরিশোধ হয়ে যেত। ফলে এর উৎসব হিসেবে পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে গ্রামের কৃষকেরা সামর্থ্যানুযায়ী খাবার দিয়ে প্রতিবেশীদের আপ্যায়ন করত।
শুধু কি ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়াই ছিল সেসব বর্ষবরণে? উত্তর না! এর সঙ্গে সেসময় বিভিন্ন উৎসবেরও আয়োজন করা হত। আর ওই উৎসবগুলো একটা সময় এসে সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হতে শুরু করে, যার পাটাতন এই বর্তমানেও বহমান।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে।
আর সেসময় থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়।
পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন বাংলাদেশ নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। বাড়িঘর পরিষ্কার করাএবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। খোলা মাঠে মেলা বসানো, মেলায় নানান শিল্প প্রদর্শন, বিক্রি-বাট্টা, খেলা, নাচ-গান ইত্যাদি।
বর্তমানে যত বিতর্ক মঙ্গলশোভাযাত্রাকে ঘিরেই। অথচ এই যাত্রা নিয়েও আছে ইতিহাস। ১৯৮৯ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে আমাদের বাঙালি জীবনে। ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করে। এর আগে ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে।
বৈশাখের এই উৎসবকে সর্বজনীন উৎসব বলা হয়। কারণ এই উৎসবে সব ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। কেননা বাঙালি সম্প্রদায়জুড়ে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা। সেই চর্চা এখানে হাজার বছর ধরে প্রবহমান। তবে যারা মনে করছেন ধর্মী সংস্কৃতি আর রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি একই, তাহলে আপনাদের মতামতকে ভুল বলেই আখ্যায়িত করব।
শুরুতেই বলেছিলাম এদেশ হিন্দু-মুসলিম বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার জন্য সমান। ধর্মী সংস্কৃতি যার যার নিজস্ব সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। মুসলমানদের যেমন- ঈদ, শবেবরাত, আশুরা, ইত্যাদি। হিন্দুদের আছে- বিভিন্ন রকমের পূজা। খ্রিষ্টাদের-যিশুকে ঘিরে আনন্দ। বৌদ্ধদের- গৌতমকে ঘিরে।
এসবই হল যার যার ধর্মীয় সংস্কৃতি বা অনুষ্ঠান। আর রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি হল অন্যরকম। রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠে ধর্ম-বর্ণ সব ভুলে। রাষ্ট্রের বড় কয়েকটি সংস্কৃতির মধ্যে পহেলা বৈশাখ অন্যতম। ফলত এইসব বিভেদ বিভাজন আর বিতর্ক ভুলে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
আপনার মতামত লিখুন :