ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা : সংকট, সম্ভাবনা ও আমাদের করণীয়

হাসানাত লোকমান 
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৫, ১১:১৯ পিএম

“ন্যায়বিচার হলো রাষ্ট্রের আত্মা; বিচারব্যবস্থা তার হৃদস্পন্দন।”— এই গভীর উপলব্ধি প্রতিটি সভ্য রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার অনিবার্য ভিত্তি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রম করার পরেও বাংলাদেশ এখনো একটি দ্রুতগামী, স্বচ্ছ, প্রযুক্তিনির্ভর এবং জনবান্ধব বিচারব্যবস্থা গঠনে সম্পূর্ণ সফল হয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক জটিলতা, প্রযুক্তিগত অপ্রতুলতা এবং দীর্ঘসূত্রতা—এসব মিলেই আমাদের বিচারব্যবস্থাকে করেছে দুর্বোধ্য ও জনআস্থাহীন।

যখন বিশ্ব এগিয়ে চলেছে ই-জাস্টিস, ব্লকচেইন-ভিত্তিক আদালত, এবং কগনিটিভ কম্পিউটিং কোর্টের মতো উদ্ভাবনী পথে, তখনও বাংলাদেশ মামলার জট, বিচার বিলম্ব, এবং দুর্নীতির মতো পুরোনো সংকটে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। অথচ একটি জাতির সভ্যতা, উন্নয়ন ও ন্যায়বোধ নির্ভর করে তার বিচারব্যবস্থার উপরই।

তবে হতাশার মাঝেও সম্ভাবনার আলো আছে — যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত রূপান্তর একত্রে কার্যকর হয়। এই প্রবন্ধে  বিশ্লেষণ করবো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাস, বর্তমান সংকট, বৈশ্বিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপট এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও আধুনিক বিচারব্যবস্থা গঠনের করণীয় পথনির্দেশনা।

ইতিহাসের পটভূমি : শিকড়ে সমস্যার উৎস

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা মূলত ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনের কাঠামোর উত্তরসূরি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আমলে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরেও, আমরা মূলত সেই পুরাতন কাগজকেন্দ্রিক, নিয়ম-কানুন-আটকে-যাওয়া বিচার প্রথা অনুসরণ করে চলেছি।

১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা স্বীকৃত হলেও, বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক প্রভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে (বিশেষ করে পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী) এই স্বাধীনতায় ফাটল ধরেছে।

বিশেষ করে:

নিয়োগে স্বচ্ছতার ঘাটতি

বিচার ব্যবস্থার অর্থনৈতিক স্বল্পতা

বিচারক ও আইনজীবীদের মানের অবনমন

এসব ঐতিহাসিক সমস্যাই বর্তমানে নানামুখী সংকটের জন্ম দিয়েছে।

বর্তমান সংকটের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ

১. মামলার পাহাড়

সরকারি তথ্য মতে, বাংলাদেশের আদালতসমূহে প্রায় ৪০ লক্ষেরও বেশি মামলা ঝুলে আছে (২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী)।
একটি দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে গড়ে ৮-১০ বছর এবং একটি ফৌজদারি মামলা শেষ হতে ৬-৭ বছর লেগে যায়।

এই দীর্ঘসূত্রতার ফলে:

বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

মানুষ বিকল্প অবৈধ নিষ্পত্তির পথে ঝুঁকে পড়ার প্রয়াস পায়।

বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা দুর্বল হয়।

২. দুর্নীতি ও অনৈতিকতার ছায়া

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা দুর্নীতির অন্যতম উৎস বলে জনগণের একাংশ মনে করে।

জমির দলিল, উত্তরাধিকার মামলা বা জামিনের মতো সাধারণ বিষয়ে উৎকোচ-দালালির প্রবণতা সাধারণ।

৩. রাজনৈতিক প্রভাব

উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বহুবার। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে, এবং বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রতি জনআস্থা কমিয়ে দেয়।

৪. আইন ও ব্যবস্থাপনার জটিলতা

কাগজপত্রভিত্তিক পরিচালনা।

বহুচর্চিত পুরনো প্রক্রিয়াগুলো।

প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত।

ফলে জনগণের বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ খর্ব হয়।

৫. প্রান্তিক মানুষের জন্য বিচারপ্রাপ্তি অসম

দরিদ্র, নারী, শিশু, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর পক্ষে আদালতে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি আজও কঠিন।
বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রকল্প থাকলেও তা যথেষ্ট নয় এবং মাঠপর্যায়ে অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও আমাদের শিখনীয় বিষয় :

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যেই তাদের বিচার ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করেছে। উদাহরণস্বরূপ:

এস্তোনিয়া: সম্পূর্ণ ই-কোর্ট চালু করে মামলার নিষ্পত্তির গতি তিনগুণ বাড়িয়েছে।

নেদারল্যান্ডস: 'কনসেনসুয়াল ডিসপিউট রেজল্যুশন' মডেল চালু করে আদালতের বাইরে দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি করছে।

ভারত: ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, ভিডিও কনফারেন্স শুনানি এবং ন্যাশনাল জুডিশিয়াল ডেটা গ্রিড চালু করেছে।

আমাদেরও এ ধরনের উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তিনির্ভর রূপান্তরের দিকে অগ্রসর হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সংস্কারের পথনির্দেশ:

১. প্রযুক্তিনির্ভর ই-জাস্টিস স্থাপন

ডিজিটাল ফাইলিং ও কেস ট্র্যাকিং ব্যবস্থা।

ভিডিও কনফারেন্স শুনানির ব্যবস্থা।

মামলার অগ্রগতি অনলাইনেই সহজে দেখা যাবে এমন ব্যবস্থা।

২. বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR): একটি মানবিক ও দক্ষ সমাধানপথ

আদালতনির্ভর বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ ব্যয় ও জনবিচ্ছিন্নতার প্রেক্ষাপটে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (Alternative Dispute Resolution – ADR) একটি মানবিক, সময়সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধানপন্থা হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। ADR-এর মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় আদালতের বাইরে, যেখানে সমঝোতা, মধ্যস্থতা, সালিশ ও আলোচনা—এই চারটি প্রধান পদ্ধতির মাধ্যমে পক্ষগণ নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পান এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাধানে পৌঁছাতে পারেন।

বাংলাদেশে দেওয়ানি, পারিবারিক ও কিছু বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ADR-এর ব্যবহার ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে এবং Family Court Ordinance, Code of Civil Procedure ও Arbitration Act-এর মাধ্যমে এর আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে জেলা পর্যায়ে 'মিডিয়েশন সেল' গঠনের মতো পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে, যা বিচারব্যবস্থার উপর চাপ কমাতে সহায়ক।

তবে বাস্তব প্রয়োগে এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে—যেমন বিচারক ও আইনজীবীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি এবং কিছু ক্ষেত্রে পক্ষগণের অসহযোগিতা। তাই ADR ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করা, সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে।

আদালতের বাইরে বিচারপ্রাপ্তির একটি সম্ভাবনাময় পথ হিসেবে ADR কেবল একটি আইনি পদ্ধতি নয়, বরং এটি হতে পারে ন্যায় ও মানবিকতার বাস্তব প্রয়োগ—একটি জনবান্ধব, দ্রুত এবং টেকসই বিচারব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

৩. বিচারক নিয়োগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা

বিচারক নিয়োগে আলাদা একটি নিরপেক্ষ বিচারক কমিশন গঠন।

নিয়োগে শুধুমাত্র মেধা, দক্ষতা ও নৈতিকতাকেই বিবেচনা করা।

৪. বিশেষায়িত আদালত প্রতিষ্ঠা

সাইবার অপরাধ আদালত

পরিবেশ আদালত

ভোক্তা অধিকার আদালত

শ্রম আদালত

এসব পৃথক আদালতের মাধ্যমে বিচার দ্রুত ও দক্ষ হবে।

৫. বিনামূল্যে আইনি সহায়তার পরিধি বাড়ানো

প্রতিটি উপজেলায় আইনি সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন।

অনলাইন আইনি সহায়তার সুযোগ বৃদ্ধি।

৬. নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ জোরদার করা

বিচারকদের জন্য বাধ্যতামূলক নৈতিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ।

"বিচার মানে সেবা" এই দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করা।

আমাদের করণীয় : নাগরিক সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকা

বিচারব্যবস্থার সংস্কার কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের একক দায়িত্ব নয়; আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব:

আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

ভুয়া মামলা, মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে বিরত থাকা।

নাগরিক সমাজের অংশ হিসেবে বিচারসংক্রান্ত সংস্কার দাবিতে সক্রিয় হওয়া।

নতুন দিগন্তের স্বপ্ন :

একটি মানবিক, নৈতিকতাসম্পন্ন, প্রযুক্তিনির্ভর বিচারব্যবস্থা বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে নতুন করে পরিচিত করবে।
আমরা চাই:

যেখানে ন্যায়বিচার বিলাসিতা নয়, বরং প্রতিটি মানুষের সহজপ্রাপ্ত অধিকার হবে।

যেখানে বিচার হবে দ্রুত, সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত।

যেখানে বিজ্ঞ বিচারক হবেন ন্যায়ের পূজারী, দণ্ডপ্রয়োগকারী নয়।

যেখানে প্রযুক্তি ও মানবিকতা হাতে হাত রেখে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে।

সারকথা :

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে, যেখানে সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ববোধের প্রতিটি পদক্ষেপ আগামী দিনের ভিত্তি নির্মাণ করবে। এই সময় আমাদের প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, দূরদর্শী চিন্তা ও পরিকল্পিত কর্মসূচি—যা কেবল আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ন্যায়, মানবতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে একটি সত্যিকারের ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সহায়ক হবে।

বিচার কেবল রায় নয়; বিচার হচ্ছে বিশ্বাসের নির্মাণ---- এই উপলব্ধি থেকেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আমরা যদি একটি আধুনিক, মানবিক ও ন্যায়নিষ্ঠ বাংলাদেশ চাই, তবে বিচারব্যবস্থার আমূল সংস্কার কেবল সময়ের দাবি নয়, বরং জাতির অস্তিত্বের শর্ত। এই অভিযাত্রা শুধু নীতি-নির্ধারকদের কাজ নয়, বরং আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব।

ন্যায় যেখানে প্রতিষ্ঠিত, সেখানেই জাতির মুক্তি — আর সেই মুক্তিই হবে আমাদের গৌরবময় ভবিষ্যৎ।

আসুন, আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলি এমন একটি বিচারব্যবস্থা, যেখানে ন্যায়বিচার হবে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, এবং বাংলাদেশ হবে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।