ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

অর্জিত আমার স্বাধীনতা ও মোদির ধৃষ্টতা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪, ০৯:২৪ এএম

অর্জিত আমার স্বাধীনতা ও মোদির ধৃষ্টতা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা অনেক কঠিন কাজ। তাই বলে কি আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত? মনে হয় না। দেশের এই অবস্থার কথা ভাবতে গেলে আমরা দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছি। মূলধারার রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। দেশ রক্ষায়, দেশের স্বার্থে আমরা আত্মত্যাগ করে এসেছি, এখনো করছি। চেতনায় বিপ্লব খেলে ওঠে, শাণিত তলোয়ারের মতো শক্তি সঞ্চারিত হয়। আমাদের এই স্বাধীনতা। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। বাংলা ও বাঙালিকে মুক্ত করার স্বাধীনতা। যা একাত্তরে করেছি, এখনো করছি।

ফ্যাসিবাদ ও তার অনুসারীদের তাণ্ডবলীলা রুখে দিয়েছে প্রতিবাদী ছাত্ররা। অত্যাচারিত পরাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছে দামাল ছেলেরা ‘চব্বিশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। দেশ ও দেশের জনগণকে ভালোবাসায় আগলে রাখবে এমন নেতা চোখে পড়ে না। প্রকৃত নেতার অভাবে আমরা পিছিয়ে। স্বার্থান্বেষী নেতারা আগলে রাখতে জানে না। গত ১৫টি বছর আমাদের বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে, লেখার স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে, ভোটের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। সমাজচিন্তক আবুল কাসেম ফজলুল হকের  ‘যুগসংক্রান্তি ও নীতিজিজ্ঞাসা’ থেকে যে দিকনির্দেশনা পাই তা হলো-

“কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, নেতাদের চরিত্র নেতারা নিজেরা যতটা অর্জন করেন ঠিক ততটাই হঠন করে দেয় তাদের অনুসারীরা আর জনসাধারণ। একটি সমাজে একটির পর একটি খারাপ সরকার প্রতিষ্ঠার, সমাজের বিভিন্ন স্তরে খারাপ নেতৃত্বের আত্মপ্রকাশের এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বৈরাচারী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল সরকারের, নেতৃত্বের কর্তৃপক্ষের লোকেরাই দায়ী-এ কথা ঠিক নয়, এর জন্য জনসাধারণও বহুলাংশে দায়ী। সমাজের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল ‘অস্তিত্বের ও আত্মপ্রকাশের সংগ্রাম’ আর বৃত্তি-প্রবৃত্তির ও আশা-আকাক্সক্ষার সংঘাত কত ভয়াবহতার উপলব্ধি সমাজের অভ্যন্তরে যথেষ্ট পরিমাণে দেখা না দিলে সেই সমাজ ভালো নেতৃত্ব সৃষ্টির দিকে  এগোতে পারে না। ইতিহাস থেকে এই শিক্ষাই পাওয়া যায়। সবসময় দায়িত্ব শুধু নেতাদের ওপর চাপানো ঠিক নয়।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে অচিরেই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়া। বৈধ রাজনৈতিক সরকার ব্যতীত গণতন্ত্র আসে না। অন্যদিকে সব রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তাদের প্রত্যেকেই যেন প্রস্তুত হয়ে ওঠে নির্বাচনের জন্য। পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক দিক ঠিক রেখে সামনের দিকে চলতে হবে অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে- দেশের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক মঙ্গল, আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধ, সামরিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক লক্ষ্যসমূহ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রে বা রাষ্ট্রচিন্তায় যথেষ্ট মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি আছেন, কিন্তু মূল্যায়ন নেই। তারা দেশকে এগিয়ে নিতে পারে বহুদূর। এটা ঠিক, মেধাবীরা কখনো বিচক্ষণ নেতা হতে পারে না, কূটনৈতিক বিশ্লেষণে বা পররাষ্ট্রনীতিতে কেবল রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই যথেষ্ট ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। রাষ্ট্রগঠনে তাই রাজনৈতিক সরকারের বেশি প্রয়োজন। ইদানীং লক্ষ্য করা গেছে তারেক জিয়ার বর্তমান সময়ের কথাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুক্তিগ্রাহ্য। ৩৬ জুলাইয়ের পর থেকে যথেষ্ট পরিপক্ব ও বাস্তবসম্মত কথা তিনি বলে যাচ্ছেন। জনগণ এখন খুবই সচেতন, কথাগুলোকে কাজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চায়।

সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদি তার টুইটারে যে বার্তা দিলেন তা গর্হিত। একজন রাষ্ট্রপ্রধানের এ ধরনের ন্যক্কারজনক প্রপাগান্ডা মেনে নেওয়ার মতো নয়। তার কথা বর্জনযোগ্য। প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধানের উচিত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করা। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে দেশ ও দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন্ন রেখে চলাই শ্রেয়। এই একই ব্যবহার আমাদেরও উচিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে আসতে পারে, সহযোগিতা করতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতীক্ষায় ছিল এ বাংলার আপামর জনগণ। তাদের সর্বস্ব দিয়ে, তাজা প্রাণের রক্ত দিয়ে, দলমত নির্বিশেষে সব ধর্মাবলম্বীর মানুষ এই চেতনায় ঝাঁপ দিয়েছিল। এটা মুক্তির চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা যা সব নাগরিকের শিরা-উপশিরায় টগবগিয়ে খুন খেলে ওঠার চেতনা।

এটা অনস্বীকার্য যে, ভারত আমাদের ঢের সহযোগিতা করেছে। তার মানে এই নয়, নরেন্ত্র মোদি, ভারতের সামরিক বাহিনী কিংবা অন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের এই দিনটিকে বরাবরই ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য’ বা ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়’ বর্ণনা করে ব্যাখ্যা দেবেন! আমরা লেজ গুটিয়ে বসে থাকা জাতি নই, ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে বলি। আমাদের এই বাঙালি চেতনায় কোনো পরাজয় নেই। মরে যাব কিন্তু হার মানব না। এখন দেখছি, চিতার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে হায়েনার রোষানলে পড়ে যাচ্ছি। ফ্যাসিবাদী ও তার দোসরদের অতিরঞ্জিত ভালোবাসার বহির্প্রকাশ এটাই। কতবড় ধৃষ্টতা! একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নিজেদের অঙ্গরাজ্য ভেবে উক্তিটি ছুড়ে দিয়েছে। ছুড়ে ফেলে দেই এহেন উদ্ধৃতি, সেসঙ্গে প্রতিবাদ জানাই এসব ধৃষ্টতাকে। আর এও বলতে চাই বাঙালি জীবনটাই এক একটি যোদ্ধার জীবন।  

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; দৈনিক পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে ‘দৈনিক বাংলা’ হয়। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতাজুড়ে বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছিল: ‘দখলদার পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণ, সোনার বাংলা মুক্ত’। দৈনিক আজাদী প্রথম পাতাতে বড় অক্ষরে লিখেছিল- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ এবং ‘মুক্তি ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নিকট বাংলাদেশ দখলদার পাক সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ’। ওই একই দিন সকাল ৮টা ১০ মিনিটে বেতারে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ চৌধুরী বাংলায় এক ঘোষণায় বলেন, ্“কিছুক্ষণ পর মেজর হায়দার একটি ঘোষণা পাঠ করবেন।’

ঘোষণাটি ছিল, ‘প্রিয় দেশবাসী, আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক। সব গেরিলার প্রতি আমার নির্দেশÑআইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কোথাও যেন আইন ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট না হয়। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এলাকায় এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে দায়িত্ব না নেবেন, ততদিন পর্যন্ত গেরিলাদের যার যার এলাকায় আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। জনগণের প্রতি আমার আবেদন, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও দালালদের ধরিয়ে দিন। নিজহাতে আইন তুলে নেবেন না।’’

মেধাবী ও বিপ্লবী ছাত্ররাই পরিবর্তন এনেছে। পরিবর্তনের পর পরই আবার ফিরে গেছে নিজস্ব কর্মে বা  লেখাপড়ায়। কেউ কেউ রয়ে গেছে এই ভেবে ফ্যাসিবাদীর দোসররা যদি আবার তাণ্ডবলীলা করে, লুণ্ঠন করে, অরাজকতা সৃষ্টি করে, তাই আরও কিছুদিন তারা বিপ্লবী চেতনায় পথে পথে হাঁটবেন। এরই সূত্র ধরে কেউ কেউ তাদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত, কেউ আবার ফ্যাসিবাদী দোসরদের সহযোগিতা করছে, কেউ আবার স্বপ্ন দেখছে উপদেষ্টা হওয়ার। আমরা স্বভাবে লোভী,  নিজেদের অস্তিত্বকে পরিমাপ করতে চাই না, কতটা যোগ্য ভাবি না। ছাত্রদের কোনো অনৈতিক কাজ বা আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। কেবল যৌক্তিক গ্রহণযোগ্য কাজকেই সমর্থন করতে হবে।

বেশিরভাগ ছাত্র এখন অন্য পথে হাঁটছে। সংস্কারের ব্যনারে রাষ্ট্রচিন্তায় তারা পুথিগত বিদ্যা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর প্রভাব খুব শিগগিরই সমাজের মধ্যে বিশৃঙ্খলার দানা বাঁধবে। আন্দোলনের নামে অনেকেই নিজেদের কার্য-সুবিধা হাসিল করে চলেছে। ছাত্রদের উচিত পরিবর্তনের জন্য যে আন্দোলন প্রয়োজন হয়, ঠিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তা স্তিমিত করা। নইলে সময়ক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে এর বিস্তার বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হতে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ভালোবাসা বিপরীতমুখী আচরণের নামান্তর। ফার্সি কবি জালাল উদ্দিন রুমির উক্তিটি মনে পড়ে- ‘‘মানুষের প্রয়োজনে অতিরিক্ত যা কিছু আছে, তাই হচ্ছে বিষ। এটি হতে পারে ক্ষমতা, সম্পদ, ক্ষুধা, অহংকার, লোভ, অলসতা, ভালোবাসা, উচ্চাকাক্সক্ষা, ঘৃণা বা যে কোনো কিছু।’’

আরবি/জেআই

Link copied!