ঢাকা শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর, ২০২৪

প্রশাসনিক সংস্কার ও সময়ের প্রত্যাশা

মর্তুজা হাসান সৈকত

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৪, ০২:১৬ পিএম

প্রশাসনিক সংস্কার ও সময়ের প্রত্যাশা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে ইতোমধ্যে এক মাস পূর্ণ হয়েছে। কঠিনতম পরিস্থিতিতে একটি বিপর্যস্ত অবস্থা মোকাবিলা করে এখন পর্যন্ত সঠিক পথেই এগিয়ে চলছে বর্তমান সরকার। ফলে পাশাপাশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থনও লাভ করেছে।

এসব কারণে এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও বাড়ছে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে একটি নির্বাচন পরিচালনা করাকেই কেবল এ সরকারের দায়িত্ব বলে মনে করছেন না অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা। তাদের মধ্য থেকে দাবি উঠেছে যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সর্বাত্মক মেরামত এবং বৃহত্তর অর্থে অর্থবহ পরিবর্তন আনার। এই মেরামত বা সংস্কারের ভেতরে রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারসহ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ আরও বহু ক্ষেত্রের সংস্কার জড়িত। এ মুহূর্তে এগুলো সংস্কারের প্রয়োজনও রয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রীয় কাঠামো মেরামত কিংবা সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন না এনে যদি সুপারিশ আকারে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেওয়া হয় তাহলে কাক্সিক্ষত ফল না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ক্ষমতায় গিয়ে পরবর্তী সরকার তাদের ব্যক্তি, গোষ্ঠী, শ্রেণি কিংবা দলীয় স্বার্থে অনেক প্রস্তাব কিংবা সুপারিশ বাতিল করে দিতে পারে।

এই সংস্কার কাজে অন্তর্বর্তী সরকারকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তাও নিতে হবে। কারণ সরকারের সাফল্যের প্রধান কারণগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বড় সমস্যা হলো গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে প্রশাসনকে এমনভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে যে, এদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে তেমন কিছু করাই সম্ভব নয়। যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারাই নিজেদের মতো করে প্রশাসন সাজিয়েছে। তাই সবার আগে এদের সংস্কার জরুরি। গত এক মাসে এর কিছু নিদর্শনও আমরা দেখেছি। নতুন সরকার এরই মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদলসহ বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ সময়ে সরকারের তরফ থেকে কয়েকটি নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত এসেছে।

আমরা যদি পেছনে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, বাংলাদেশের প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে একাধিকবার। একসময় আওয়ামী লীগের দিক থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের জন্য ‘রাজনীতি কঠিন’ করে তুলেছিলেন। তার সময়ে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের তোষণ, পদলেহন করতে হয়েছে রাজনীতিবিদদের। দেশ চালাতেন সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। বিএনপির এক দশকের শাসনামলেও আমলারা যথা নিয়মে সরকারের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে ছিল। সেই সময়ের অনেক আমলার বিএনপি-জামায়াতের জোটপ্রীতির কথা মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। এসব অভিযোগ করা সেই আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় এসে টানা সাড়ে পনেরো বছর আমলানির্ভর হয়ে সরকার পরিচালনা করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের এই পুরো সময়টাতেই প্রশাসন জনসেবার চেয়ে সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার প্রতি অধিক মনোযোগী ছিল। ফলে নাগরিকদের ভোট ছাড়াই দেশশাসন করারও ‘বিচক্ষণতা’ দেখিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত সরকার।

ওই সময়কালে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে প্রশাসনকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে একান্ত অনুগত এবং অসৎ ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়। একজন কর্মকর্তা রাষ্ট্রের সম্পদ। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের এ সময়ে এই কর্মকর্তাদের অনেককেই আমরা মিডিয়ার সামনে বারবার নিজেকে আওয়ামী পরিবারের পরিচয় দিতে দেখেছি। এই দলকানা কর্মকর্তারা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ অব্যাহত রাখার জন্য সরকারকে টিকিয়ে রাখতে কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা প্রয়োগ করে গেছে বছরের পর বছর ধরে। আর এ কারণে প্রশাসনের এ কর্মকর্তারা তাদের জন্য যেগুলো প্রয়োজনীয় নয় এমন অনেক সুবিধা সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন। ফলে অনেক আমলাই অবৈধভাবে শতকোটি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিকও হয়েছেন।

মজার ব্যাপার হলো, যে আওয়ামী লীগ সরকারকে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে সহায়তা করেছেন আমলারা, সেই সরকারের সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও আমলাদের অতি খবরদারি ও কর্তৃত্ববাদী ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন একটা পর্যায়ে এসে। আওয়ামী লীগের এই সময়ে সচিবরা এমন অনেক কিছু করছেন অনেক ক্ষেত্রেই যা মন্ত্রী-এমপিদের ‘ইগোতে’ লেগেছে। এতে উপেক্ষিত অনেক মন্ত্রীরা দুঃখও প্রকাশ করেছিলেন রাজনৈতিক মহলে। ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, মহামারি করোনার সময়ে সংসদ অধিবেশনে তৎকালীন সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের এমপিরাও সমস্বরে সরকারের প্রতি অভিযোগ তুলেছিলেন যে- আমলাদের প্রতি অতি নির্ভরশীলতার কারণে দেশ রাজনীতিশূন্য হতে চলেছে আর রাজনীতিবিদরা হয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাহীন। আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে এ রকম কথাও বলেছিলেন যে, ‘ইউএনও, ডিসি- তারাই মনে হয় দেশটার মালিক। তারা যা করেন, সেটাই চলে।’ তবে সমস্বরে এমন অভিযোগ তুলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমলারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মদদে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন।

আমলাদের সম্পর্কে দার্শনিক কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘নিজেদের নাককেই তারা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেইসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান।’ আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারদের ক্ষেত্রেও বারবার সেটিই ঘটছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ভোগ করেন, অনেকে প্রকাশ্যেই ক্ষমতার দাপট দেখান। তারা সব সময় আলাদা গুরুত্ব চান, চান বাড়তি মর্যাদা। এই বাড়তি মর্যাদা ও মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে তাদের অনেকে প্রায়ই সাধারণ মানুষকে বিড়ম্বনায় ফেলেন। এর চরম নজির আমরা বিগত সরকারের সময়ে বহুবার দেখেছি।

মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে, জেলা প্রশাসক এবং ইউএনও। সরকারের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের এ পদের জন্য নির্বাচিত করা হতো। ফলে তারা এতই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন যে, নিজেকে রাজা জ্ঞান করে সাধারণ মানুষদের ভাবতেন প্রজা। স্যার না ডাকলে ক্ষেপে গিয়ে হেনস্তা করা ছিল খুবই মামুলি ব্যাপার। এ ছাড়াও কত কাণ্ড যে ঘটিয়েছে গত দেড় দশকে। একবার এক উপজেলা পরিষদে ঢুকে ফুলগাছ খেয়ে ফেলেছিল একটি ছাগল। এই ‘মস্তবড়’ অপরাধে ইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সেই ছাগলকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে বসেন। শুধু জরিমানা করে ক্ষান্ত হননি তিনি, কয়েকদিন আটকে রেখে অবশেষে ৫ হাজার টাকায় বিক্রিও করে দেন। বোঝেন অবস্থা!

অন্যদিকে, করোনাকালে নারায়ণগঞ্জে সরকারি তথ্যসেবা নম্বর ৩৩৩-এ কল করে খাদ্যসহায়তা চাওয়ায় অসহায় এক বৃদ্ধকে শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন আরেক ইউএনও। ওই সময় ইউএনও অসহায় সেই বৃদ্ধকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০০ জনকে খাদ্য সহায়তা দিতেও বাধ্য করেন। অন্যদিকে সাংবাদিকদের প্রতি কেউ কেউ এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে যা মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসনের এক উচ্চপদস্থ আমলা এক সাংবাদিককে জেল খাটিয়ে, হত্যার হুমকি দিয়ে হেনস্তা করেছিলেন। এ রকম যে কত ঘটনা আছে! সত্যি কথা বলতে, এসব কাজের জন্য মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও এ দেশের মানুষ নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করত। তা সত্ত্বেও গত সরকারের মেয়াদে এ রকম ঘটনা অহরহই আসত গণমাধ্যমে।

খেয়াল রাখা দরকার, যেন এই সংস্কারের নামে পুনরায় যেন দলদাস ব্যক্তি কিংবা দুর্নীতিবাজদের পুনর্বাসন না ঘটে। এমন বেশ কিছু নজির ইদানীং গণমাধ্যমে আসছে। বহুল আলোচিত ক্রেস্ট কেলেঙ্কারির ঘটনায় ওএসডি হওয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র সহকারী সচিবকে সরকার বদলের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি পদোন্নতি বাগিয়ে এক লাফে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ বারবার আসে না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন করে সুযোগ এসেছে। যেসব প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ‘জনগণের কল্যাণের’ জন্য কাজ না করে, ‘দলীয় সরকার’ ও ‘নিজেদের’ কল্যাণে নিয়োজিত থেকেছে সুদীর্ঘকাল, পরিবর্তিত বাংলাদেশে তাদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনকে সংস্কার করে যুগোপযোগী এবং কল্যাণমুখী করতে সমর্থ হলে, সেটার মাধ্যমেই গণ-আকাক্সক্ষার সঠিক প্রতিফলন ঘটবে।

লেখক

মর্তুজা হাসান সৈকত

প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

আরবি/জেআই

Link copied!