ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

জনগণের ক্ষমতায়নে চাই প্রশাসনিক সংস্কার

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ০৫:২৪ পিএম

জনগণের ক্ষমতায়নে চাই প্রশাসনিক সংস্কার

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান । ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশে সম্প্রতি যে অভাবনীয় বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছে যুব তরুণ-সমাজ তথা ছাত্র-জনতা, তা ৫ আগস্টের এক সপ্তাহ আগেও অনেকেই ভাবতে পারেননি। এটা আবারও প্রমাণিত হলো জনসাধারণ না চাইলে কারও পক্ষেই শক্তি খাটিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। সেটা পাকিস্তানের ২৩ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনকালে যেমন প্রত্যক্ষ করেছি, বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসেও একাধিকবার দেখলাম। ‘লৌহমানব’ বলে পরিচিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউবের মতো প্রবল পরাক্রান্ত শাসকের এক দশকের ক্ষমতার মসনদ ভেসে গেছে ঊনসত্তরের প্রবল গণঅভ্যুত্থানে। সেখানেও নেতৃত্ব ছিল ছাত্রদেরই। নিকট অতীতের জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনেরও অবসান ঘটেছে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।

অবশেষে প্রবল গণঅভ্যুত্থানে বিদায় নিতে হলো শেখ হাসিনার সরকারকেও। সত্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হয় তার ১৫ বছরের শাসন আমলে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন ঘটেছে, কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে চরম দুর্নীতি, লুটপাট, মানি লন্ডারিং, পাচারসহ নানা প্রক্রিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার প্রায় শূন্য করে ফেলেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা আমলাদের সীমাহীন দুর্নীতি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোকে ম্লান করে দিয়েছে।

সবচেয়ে দৃষ্টিকটু বিষয় হলো ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া। পরবর্তী একাধিক নির্বাচনে জনসাধারণের ভোটাধিকারের গুরুত্ব একেবারে হ্রাস করে দিয়ে এক যুগের অধিক কাল ক্ষমতা আগলে রাখার নানা কূটকৌশল সচেতন নাগরিকদের মর্মাহত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহারও করতে হয়েছে এসব অনিয়মের কাজে। বিগত সরকারের নানামুখী অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ড বিরোধী দল তো বটেই, দেশের জনসাধারণও ভালোভাবে নেয়নি। তার ওপর সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের প্রবল প্রতাপে দিনের পর দিন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেশের মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ছাত্রসমাজের আন্দোলনকে অবলম্বন করে।

বাংলাদেশের সংবিধানে ‘জনগণই সব ক্ষমতার উৎস’ এই আপ্তবাক্য লিপিবদ্ধ থাকলেও শাসকরা কখনো এ সত্য মনে রাখেননি। আর সে কারণেই বারবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে জনসাধারণের এবং রাজপথের আন্দোলনে বারবার প্রাণ দিতে হয়েছে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে। এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ে এক মনীষীর ইতিহাস প্রসঙ্গে করা সেই

বিখ্যাত উক্তি: ‘ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।’ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করার পরিণাম আর কত দেখব আমরা? এত ক্ষয়ক্ষতির পরও আমাদের কি বোধোদয় হবে না? আসলে সমস্যার গোড়ায় আমরা কেউই হাত দিচ্ছি না বলেই আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঔপনিবেশিক আমলেরই রয়ে গেছে। অথচ যুগটা হচ্ছে ডিজিটাল কিন্তু আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো এবং শিক্ষাব্যবস্থা রয়ে গেছে অ্যানালগ যুগের।

২০০ বছর আগের ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যবস্থাপনা দিয়ে আজকের আধুনিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অগ্রগতি সম্ভব নয়। এই সত্যটা স্বাধীন বাংলাদেশের সবার আগে উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতন্ত্রের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে একজন করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত গভর্নর দিয়ে জনগণের শাসন কায়েম করতে চেয়েছিলেন, যাতে শতকরা ৮০ ভাগ কাজই জেলা পর্যায়ে শেষ হয়ে যায়।  এমনকি লালফিতার বাঁধনে যখন সচিবালয়ে ফাইল অনড় পড়ে থাকতে দেখলেন, তখন ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন ঔপনিবেশিক আমলের এই সচিবালয় উপড়ে নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দাও।

তাই তিনি আমেরিকান স্থানীয় সরকারের কাউন্টি সিস্টেমের মতো এ দেশের জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি, তার আগেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমলাতন্ত্র আর ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা রকম সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের কঠোর অবস্থান তার পুরানো ভাষণ-বক্তৃতাগুলো শুনলেই যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন।

দুর্নীতি, লোভ-লালসা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বৈষম্য, সুবিচার সুশাসনের অভাব আমাদের সমাজে বহুকালের ব্যাধি। আর সেই ব্যাধি যদি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই স্থায়ীভাবে শিকড় গেড়ে বসে, ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যেই যদি চরম বৈষম্য থেকে যায়, সংক্রামক ব্যাধির মতো সমাজেও তা ছড়াবে। যে কারণে আমাদের সমাজজীবন থেকে আদর্শিক মূল্যবোধ দিনে দিনে মুছে গেছে প্রায়। ভোগবাদিতার লোভ-লালসায় সমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশা কলুষিত হয়ে গেছে। 
১৯৫৮ সালে কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম। আজ নবতীপর বয়সে জীবনের অস্তবেলায় দাঁড়িয়ে পেছনের দিকে তাকালে সত্যি মনটা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

ব্যক্তিগত স্বার্থান্ধতার ঊর্ধ্বে থেকে দেশ এবং মানুষকে ভালোবাসার মতো, দেশের চিরস্থায়ী কল্যাণকামী নিঃস্বার্থ মানসিকতার রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আমলা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক-আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী না, কোনো পেশাতেই খুব একটা দেখছি না আজকাল আর তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কী।

ভবিষ্যৎ আমাদের তরুণ প্রজন্ম যাদের রক্ত এখনো পরিশুদ্ধ। তাদের গড়ে তুলবার জন্য সুস্থ সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রশাসনিক কাঠামোতে এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে জনপ্রতিনিধিত্ব প্রকৃতই ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠে। শিক্ষাব্যবস্থাপনায় এবং পাঠ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষাকে করতে হবে সর্বজনীন এবং একমুখী। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে কর্মমুখী মানবসম্পদ সৃষ্টি। সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেটাও শিক্ষার মধ্য দিয়েই করা সম্ভব।

১৯৫৮ থেকে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত দীর্ঘকাল অধ্যাপনা সূত্রে শিক্ষার নানা ধরনের সমস্যা যেমন প্রত্যক্ষ করেছি, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়েও শিক্ষা প্রশাসনের ভেতরে বিদ্যমান অনেক সংকট দেখেছি।

এসব সংকট সমাধানের জন্য উদার গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি আমার লেখা ‘ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামো : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে সংবিধান নিশ্চিত করেছে সব মানুষের সমান অধিকার, সেখানে ধনী-দরিদ্রের শিক্ষাব্যবস্থা আলাদা হতে পারে না। অথচ আমাদের দেশে দরিদ্র মানুষের সন্তানরাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাদ্রাসায় পড়ে। ধনীরা কিন্ডারগার্টেনসহ ইংরেজি মাধ্যমের শহুরে বিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়ান। দেশে অভিন্ন শিক্ষা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

প্রশাসনিক কাঠামোতে ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনও বিরাজমান। অথচ ওই ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জেলায় জেলায় গভর্নর সিস্টেম চালু ছিল যুগের দাবি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরও আমি প্রশাসনিক সংস্কার তথা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক তৃণমূলের প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের আশা ছাড়িনি। ১৯৮০ সালের ৬ জানুয়ারি ‘প্রশাসনিক কাঠামো ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন আমি রচনা করেছিলাম ইত্তেফাক হাউস থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায়। সেখানে আমি প্রস্তাব করেছিলাম বিষয়ভিত্তিক ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টির। আমার সেই প্রস্তাব আমি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলাম।

ওই প্রস্তাব প্রেসিডেন্টের নির্দেশে প্রশাসন পুনর্গঠন ও সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৎকালীন ক্যাবিনেট সেকেন্ডারি মরহুম মাহবুবুজজামান গ্রহণ করেন এবং সমমান, সমবেদনা এবং সমমর্যাদার ২৪টি ক্যাডার সার্ভিস গঠন করেন ১৯৮০ সালের অক্টোবরে।

উল্লেখ্য, জনপ্রশাসনের ইতিহাসে সমমানের ২৪টি ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা। সেই ২৪টি ক্যাডারকে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী করার জন্য আমার প্রস্তাব ছিল বিশেষায়িত ক্যাডার থেকেই প্রতিটি ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদোন্নতি সচিব পদ গ্রহণ করবেন। যেমন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন শিক্ষা ক্যাডার থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ ব্যক্তি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন কৃষি ক্যাডারের যোগ্যতম ব্যক্তি, একইভাবে তথ্য ক্যাডার থেকে সচিব হবেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের। অর্থাৎ প্রশাসনে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে প্রত্যেক ক্যাডারের সম গুরুত্বদান করার মাধ্যমে। কিন্তু ২৪টি ক্যাডার সৃষ্টি হলেও দু-চারটা ব্যতিক্রম ছাড়া সব মন্ত্রণালয়েরই সচিব হচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেমে ছাত্রছাত্রীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গড়ে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছেন, কিন্তু প্রশাসনে যে এত বড় বৈষম্য বিরাজমান, তার অবসান ঘটাতে এই তরুণ প্রজন্ম কি সচেতন ভূমিকা নেবেন? ক্যাডার সার্ভিসে বিরাজমান দীর্ঘদিনের যে চরম বৈষম্য, তা দূর না হলে গতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। কেননা অন্যান্য ক্যাডারের যোগ্য অথচ বঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তাদের চাপা ক্ষোভ আর অসন্তোষ নিয়ে দায়িত্ব পালন কোনো সরকারের জন্যই কল্যাণকর হতে পারে না। দেশের জন্য তো নয়ই।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ২৪টি ক্যাডার সৃষ্টির পর প্রশাসন সংস্কার তথা প্রস্তাবিত বিকেন্দ্রীকরণ বাস্তবায়ন হতে হতেও আর হতে দেয়নি প্রশাসন ক্যাডার। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি সম্মত হয়েছিলেন ক্যাডার সংস্কারে। কিন্তু তিনিও জেনারেল এরশাদের সামরিক ক্যুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোয় ওই প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ বা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা আর কার্যকর হয়নি, যা হতে দেয়নি প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাবশালীরাই।

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ, আমরা জানি। যত কঠিনই হোক জনগণের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া সুষ্ঠু সরকার ব্যবস্থা প্রচলন করা সম্ভব নয়। সেজন্য জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা যেমন নির্ধারণ করে দিতে হবে, তেমনি কালো টাকা আর পেশিশক্তির স্থলে সৎ, যোগ্য এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষকে জনগণের প্রতিনিধি করার জন্য সারা দেশের জনমত সৃষ্টি এবং নির্বাচন ব্যবস্থারও সংস্কার করতে হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে জিরো টলারেন্স নীতি অন্তর্বর্তী সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মপদ্ধতিতেও সংস্কার সাধন করতে হবে। সময় যা-ই লাগুক দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তা জনসাধারণ এবং রাজনীতিবিদদের মেনে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে একটু পেছনে ফিরে তাকানোর দরকার।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই উপমহাদেশে ব্যবসা করার সুযোগে সশস্ত্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর তারা এই অঞ্চলের ধন সম্পদ আর অর্থ লুটপাটকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিল। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নোওয়ালিশ রাজস্ব আদায়ের জন্য বিভিন্ন জেলায় ‘ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর’ নিয়োগ করেন। এই ইংরেজ কালেক্টররা ভূমি রাজস্ব থেকে শুরু করে হাটবাজারে টোল পর্যন্ত বৈধ অবৈধ নানা উপায়ে আদায় করে কোম্পানিকে পাঠাত। এই অর্থ আদায় করতে গিয়ে তারা নানা ধরনের জুলুম-নিপীড়ন করত যার বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় জনসাধারণ দেশীয় আদালতে মামলা করত, এসব বাংলায়  ইংরেজ কালেক্টররা প্রায়ই হেরে যেত এবং অর্থদণ্ডসহ নানা শাস্তির মুখোমুখি হতো। তখন কর্নওয়ালিশ প্রশাসন তথা কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা রেভিনিউ কালেক্টরদের বিচারিক ক্ষমতাও কোথাও কোথাও দিতে শুরু করে।
ফলে দেশীয় বিচারকদের হাত থেকে বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং চট্টগ্রামের হিলট্রাক্টস অঞ্চলকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘আনরুলি’ এলাকা ঘোষণা করে সেখানে কালেক্টরের পরিবর্তে বিচারিক ক্ষমতাসহ ডিসি পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দান করে। কিন্তু অন্যান্য জেলায় ডেপুটি কালেক্টর পদই বহাল ছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও এই কালেক্টর পদ বহাল ছিল। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আইউব খান ক্ষমতা দখলের পর সারাদেশকেই ‘আনরুলি’ বিবেচনা করলেন। তাই শুধু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বা চট্টগ্রামের হিলট্র্যাক্ট নয়, সব জেলাতেই ডিসি নিয়োগ দিলেন যারা একই সঙ্গে রাজস্ব আদায় এবং বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেলেন।

সরকারের পর সরকার বদল হয়েছে কিন্তু সেই জনবিচ্ছিন্ন ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক স্থানীয় প্রশাসন বদল হয়নি। জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা জেলাগুলো পরিচালিত হলে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু তা হতে দেওয়া হয়নি।

প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া ভারসাম্যমূলক এবং সব ক্যাডারের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। শুধু প্রশাসনিক ক্যাডারের আমলানির্ভরতা দিয়ে দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রবর্তিত ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরদের (ডিসি) নাম কেমন করে জেলা প্রশাসক হয়ে গেল পাকিস্তানি জেনারেল আইউব খানের আমলে সেই ইতিহাসের দিকেও আমাদের ফিরে তাকাতে হবে। প্রশাসক আর যা-ই হোক, পাবলিক সার্ভেন্ট হতে পারেন না। এই সত্য মাথায় রেখে অবিলম্বে প্রশাসনিক সংস্কারেও হাত দিতে হবে।

প্রশাসনিক ক্যাডারের আমলারা হয়তো আমার এই মন্তব্যে ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণে নাখোশ হবেন, কিন্তু দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই সংস্কার বা বৈষম্যমুক্ত ও ভারসাম্য নীতির নতুন ব্যবস্থা মেনে নেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। ছাত্রজনতার মিলিত সংগ্রামের ফসল পরিবর্তিত এই নতুন বাংলাদেশ নিশ্চয়ই ইতিবাচক পথে এগিয়ে যাবে এ বিশ্বাস আমার আছে।

দীর্ঘ ছয় দশক ধরে আমি প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে গবেষণা করছি, চিন্তা করছি, আমার ব্যক্তিস্বার্থে নয়, লাখ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটির ক্ষমতার মালিক দেশের সাধারণ মানুষ হবেন এই প্রত্যাশা থেকেই।

এই সংস্কার আমলাদের দিয়ে করা যাবে না, তাহলে বিড়ালের কাছে ভাজা মাছ ভাগ করে দেওয়ার ফলই দাঁড়াবে। এই সংস্কারের জন্য এমন একটি কমিশন গঠন করতে হবে, যে কমিশনে ইতিবাচক ইমেজের রাজনীতিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজচিন্তক, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, দক্ষ আইনজীবী, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিভিন্ন ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তা, ছাত্র ও যুবসমাজের মতামতের সমন্বয়ে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের জন্য একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করা উচিত বলে আমি মনে করি।

আশা করি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ তথা তরুণ প্রজন্ম গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন পরাধীন দেশের ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তনে করণীয় বিষয়ে। ভেবে দেখবেন কত জরুরি কাজটি। এ সংস্কার ছাড়া ভেতরে ক্ষত রেখে ওপরে মলম লাগালে যেমন সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না, তেমনি বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজব্যবস্থার পুরানো ক্ষত থেকেই যাবে, যা দেশকে ভালোবাসেন এমন কারোই কাম্য হতে পারে না।

 

স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষাবিদ, প্রশাসন সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ
 

আরবি/জেডআর

Link copied!