ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে চাকরিÑ আরামদায়ক ও নিরাপদ ভ্রমণের জন্য মধ্য ও নিম্নবিত্তের প্রথম পছন্দ রেল। আর এ কারণেই রেলের টিকিট সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হয় ভ্রমণকারীদের। তবে আরামদায়ক ভ্রমণমাধ্যমটি দিনে দিনে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে যাত্রীদের জন্য। বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন ২ হাজার ৫৯টি সেতুর ওপর দিয়ে নিয়মিত চলাচল করে রেল। এর মধ্যে ৩০০ সেতুর লাইফটাইম পেরিয়েছে অনেক আগেই। এই ৩০০ সেতুর মধ্যে বেশির ভাগের বয়স পেরিয়েছে শতবর্ষ, কিছু কিছু সেতুর বয়স হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ বছর। শতবর্ষী এসব সেতুর ওপর দিয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছে লাখো যাত্রী। অথচ এসব যাত্রী জানেই না তাদের এই আনন্দযাত্রা বিষাদে পরিণত হতে পারে
যেকোনো মুহূর্তে। ঝুঁকিপূর্ণ থেকে অতিঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে ট্রেন চলাচলের উপযুক্ত রাখে রেলওয়ে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, আখাউড়া-সিলেট জোনে ঝুঁকিপূর্ণ এমন সেতু রয়েছে ১২০টি, শ্রীপুর-বিদ্যাগঞ্জ রুটে ৫২, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা রুটে ২৫, নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রুটে ২৫, জয়দেবপুর-শ্রীপুর রুটে ১৯, সিলেট-ছাতক বাজার রুটে ১৪, শ্যামগঞ্জ-জারিয়া জাজাইল-দুর্গাপুর রুটে ১৩, বিদ্যাগঞ্জ-জামালপুর-বাহাদুরাবাদে ১১, লাকসাম-চাঁন্দপুরে ৬টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলকে ১০টি রুটে ভাগ করে প্রতি বছর একটি সার্ভে করে পূর্বাঞ্চলের সেতু বিভাগ। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম প্রপোজাল-ডিপিপির আওতায় মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে পূর্বাঞ্চল। সেই প্রস্তাবে ২৯৮টি সেতুকে নতুনভাবে নির্মাণের বাজেট পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে অ্যানুয়াল প্রোগ্রাম প্ল্যান-এপপির আওতায় আরও একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে পূর্বাঞ্চল, যেখানে অতিঝুঁকিপূর্ণ ২৮টি সেতু সংস্কারের প্রস্তাব করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শতবর্ষী এসব সেতুর লাইফটাইম শেষ হয়ে গেলেও রক্ষণাবেক্ষণ করে তা ট্রেন চলাচলের উপযোগী রাখা হয়। যদি কোনো সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তাহলে সেই সব স্থানে ট্রেনের স্পিড কমিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু পূর্বাঞ্চলের কোনো স্থানে ট্রেনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, সেহেতু কোনো সেতুকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলা যাবে না। তবে শতবর্ষী এসব সেতু নতুন করে নির্মাণ না করা হলে কয়েক বছরের মধ্যে সেতুগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশ রেলওয়ে শতবর্ষী একটা প্রতিষ্ঠান, সেহেতু এই সংস্থার অনেক অবকাঠামোই পুরোনো হয়ে গেছে। বেশির ভাগ সেতু অনেক পুরোনো। পুরোনো সেতুগুলো নতুনভাবে করার জন্য মন্ত্রণালয়ে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’
ঝুঁকিপূর্ণ এসব সেতুতে ট্রেন চলাচল নিরাপদ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে যে সেতুগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হয়, সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রেনের একাধিক চালক জানান, পুরোনো সেতুগুলো জোড়াতালি দিয়ে ট্রেন চালাচল ঠিক রাখা হয়। তবে বর্ষাকালে সেতুর নিচে যখন পানি বেড়ে যায়, তখন সেতুগুলো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। দুর্ঘটনার শঙ্কা থাকে বেশি। বর্ষাকালে অনেক জায়গায় প্রায়ই ট্রেন স্পিড কন্ট্রোল করা হয়।
শতবর্ষী এসব সেতুর তথ্য সন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু আখাউড়া-সিলেট রুটে। এই রুটে শত বছর ছুঁয়েছে ১২০টি সেতু। এর মধ্যে বড় সেতু ১৬টি, ছোট সেতু ৯৬টি এবং গুরুত্বপূর্ণ সেতু ১৬টি।
আখাউড়া-সিলেট রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু নম্বর হলো ২, ৩, ৪, ৫, ১০, ১১, ১৫, ১৬, ১৮, ২১, ২৫, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৬, ৩৭, ৪৩, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫৪, ৫৫, ৫৮, ৬০, ৬২, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭১, ৭২, ৭৬, ৮২, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৮৭, ৯১, ৯৩, ৯৬, ৯৮, ১০৬, ১০৮, ১০৯, ১১২, ১১৩, ১১৫, ১১৫এ, ১১৮, ১২০, ১২১, ১২২, ১২৩, ১২৪, ১২৫, ১২৯, ১৩০, ১৩১, ১৩৪, ১৩৭, ১৩৮, ১৪০, ১৪২, ১৪২এ, ১৪৫, ১৫২, ১৫৩, ১৫৯, ১৬১, ১৬৩, ১৬৪, ১৭২, ১৭৪, ১৭৫, ১৭৬, ১৭৭, ১৭৮, ১৭৯, ১৮০, ১৮২, ১৮৩, ১৮৭, ১৯২, ১৯৩, ১৯৫, ১৯৯, ১৯৯, ২০৫, ২০৭, ২১০, ২১১, ২১৪, ৩, ৪, ৫, ৭, ৯, ১০, ১২, ১৪, ১৫, ১৭, ১৮, ১৯, ২৪, ২৫, ২৭, ২৮, ৩২, ৩৪, ৩৫, ৪০, ৪১, ৪৬, ৫১, ৫২, ৫৫, ৫৭।
পূর্বাঞ্চলের শ্রীপুর-বিদ্যাগঞ্জ রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু রয়েছে ৫২টি। এর মধ্যে ৫১টি ছোট সেতু এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। এই রুটে ঝঁকিপূর্ণ সেতু নম্বর হলো ১১১, ১১২, ১১৩, ১১৪, ১১৫, ১১৬, ১১৮, ১২১, ১২২, ১২৩, ১২৪, ১২৫, ১২৬, ১২৭, ১৩০, ১৩২, ১৩৩, ১৩৭, ১৪৩, ১৪৪, ১৫৩, ১৫৪, ১৫৮, ১৬৫, ১৬৮, ১৭০, ১৭৪, ১৭৫, ১৭৭, ১৮০, ১৮১, ১৮২, ১৮৩, ১৮৪, ১৮৯, ১৯১, ১৯২, ১৯৩, ১৯৪, ১৯৮, ১৯৯, ২০০, ২০২, ২০৯, ২১৭, ২২০, ২২২, ২২৪, ২২৬, ২২৭, ২২৮, ২৩০।
ময়মিনসিংহ-নেত্রকোনা রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ২৫টি। এর মধ্যে বড় সেতু ২টি, ছোট সেতু ২৩টি। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো হলো ২, ০বি, ০সি, ৭, ৮, ৯, ৬, ১১, ৯এ, ১২, ১৩, ১৪, ১৬এ, ১৯, ১৯ডি, ২০, ২১এ, ২০বি, ২০সি, ২৪, ২৫এ, ৩০, ৩১, ৩১এ, ৩১বি।
নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ২৫টা। এর মধ্যে বড় সেতু ১টি, ছোট সেতু ২৩টি এবং গুরুত্বপূর্ণ সেতু ১টি। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো হলোÑ ২এ, ৪, ৫এ, ৬, ৮, ৯, ৯এ, ১১,
১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৮, ১৮এ, ১৯, ২১, ২২, ২২এ, ২৩এ, ২৫, ২৭, ২৮, ৩১, ৩২।
জয়দেবপুর-শ্রীপুর রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ১৯টি। এর মধ্যে সবগুলো সেতু ছোট। সেতুর নম্বরগুলো হলো ৬০, ৬২, ৬৬, ৬৭, ৬৮, ৭০, ৭২, ৮২, ৮৩, ৮৫, ৯০, ৯২, ৯৫, ৯৭, ১০১, ১০৪, ১০৭, ১০৭, ১১০।
সিলেট-ছাতক বাজার রুটে ১৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর তালিকা করেছে পূর্বাঞ্চলে। এর মধ্যে বড় সেতু ৪টা, ছোট সেতু ৯টা এবং গুরুত্বপূর্ণ সেতু ১টি। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো হলো ১এ, ৪, ৬, ১২, ১২এ, ১৩, ১৯, ২১, ২৩, ২৮, ৩২, ৩৩এ, ৩৪এ, ৩৮।
শ্যামগঞ্জ-জারিয়া জাজাইল-দুর্গাপুর রুটে ১৩টি সেতু। এর মধ্যে বড় সেতু ৩টি, ছোট সেতু ১০টি। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো হলোÑ ৩, ৩এ, ৪, ৬, ৭, ৮, ৯, ১১, ১২, ১২বি, ১৪, ১৮, ১৯।
ষোলশহর নাজিরহাট রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ১৩টি। এর মধ্যে বড় সেতু ১টি, ছোট সেতু ১২টি। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো হলো সিএন১৩, সিএন২২, সিএন৩৫, সিএন৪৩, সিএন৪৪, সিএন৪৮, ২ইউ, সিএন৫৫, সিএন৫৬, ৬ইউ, সিএন৮৩, ৯৭, ৯৮।
বিদ্যাগঞ্জ-জামালপুর-বাহাদুরাবাদ রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ১১টা। এর মধ্যে বড় সেতু ১টা, ছোট সেতু ১০টা। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো হলোÑ ২৪৫, ২৫০, ২৫৯, ২৬০, ২৮৮, ২৮৯, ২৯১, ৯, ১৫, ১৯, ২০।
রেওলয়ে পূর্বাঞ্চলে সবচেয়ে কম ঝঁকিপূর্ণ সেতু রয়েছে লাকসাম-চাঁন্দপুর রুটে। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ৬টি। এর মধ্যে বড় সেতু ২টি, ছোট সেতু ৪টি। এই রুটে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো হলো সি২, সি৩, সি৫, সি৭, সি৩৯, সি৪৫।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে সর্বমোটি ২ হাজার ৫৯টি সেতু রয়েছে। এর মধ্যে বড় সেতু ২২২টি, ছোট সেতু ১ হাজার ৮০১টি, গুরুত্বপূর্ণ সেতু ৩৬টি, কেপিআইভুক্ত সেতু ১৮টি।
২০৫৯টি সেতুর মধ্যে গার্ডার সেতু ৭৩০টি, কম্পোজিট গার্ডার সেতু ১৮টি, আরসিসি স্লাব দেওয়া সেতু ৪৯৯টি, আরসিসি বক্স কালভার্ট সেতু ২৪৩টি, পাইপ দিয়ে বানানো সেতু ২২৫টি, এআরসিএইচ সেতু ২১৩টি, রেল ক্লোস্টার সেতু ৮৩টি, থ্রপ্লেট সেতু ৩৫টি, ওপেনটপ সেতু ১১টি, মাসনরি সেতু ১টি এবং মিক্সড সেতু ১টি।
আপনার মতামত লিখুন :