বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ, যেখানে নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া একসঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকেই ভূমি উন্নয়ন এবং আবাসন খাত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। শহরাঞ্চলের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, গ্রামীণ এলাকার উন্নয়ন, এবং পরিবেশ রক্ষার সমন্বয় সাধন এই খাতের মাধ্যমে সম্ভব। তবে, এ খাতে যে সম্ভাবনাগুলো বিদ্যমান, তা যতটা গুরুত্ববহ, চ্যালেঞ্জগুলোও ততটাই তাৎপর্যপূর্ণ। এ জন্য এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাতের সুফল
১.অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাত একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই খাত নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য খাত, যেমন সিমেন্ট, ইস্পাত, প্লাস্টিক, এবং পরিবহন খাতের প্রবৃদ্ধি ২০%-এর ওপরে নিয়ে গেছে। একটি পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে, যা অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
২.কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি আবাসন ও নির্মাণ শিল্পে প্রায় ৪০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে, যার একটি বড় অংশ দিনমজুর এবং নির্মাণশ্রমিক। প্রকৌশলী, স্থপতি, প্রকল্প ব্যবস্থাপক, এবং পরিষেবাদাতা কর্মীদের জন্যও বিশাল সুযোগ তৈরি হয়। শহরাঞ্চল ছাড়াও গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কাজের সুযোগ বাড়িয়ে এই খাত গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসে অবদান রাখছে।
৩.সম্পদ সৃজন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা পরিকল্পিত আবাসন কেবল ঘরবাড়ি নির্মাণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। উন্নত নাগরিক সুবিধাসম্পন্ন আবাসন প্রকল্প মানুষকে সুষম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সমৃদ্ধ জীবনযাপনের পরিবেশ তৈরি করে।
৪.শরণার্থী পুনর্বাসন ও দারিদ্র্য বিমোচন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়া অন্যতম দেশ। বন্যা, নদীভাঙন এবং ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনে এই খাতের ভূমিকা অপরিসীম। সরকারি উদ্যোগে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’-এর মতো উদ্যোগ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করেছে।
ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাতের সমস্যা
১.অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অবকাঠামো সংকট
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় শহরগুলোতে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে যানজট, জলাবদ্ধতা এবং আবর্জনার স্তূপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা ২ কোটির ওপরে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এই নগরায়ণ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে ঘটেনি।
২.জমির উচ্চমূল্য ও দখলদারিত্ব জমির দাম বাংলাদেশে বিগত এক দশকে গড়ে ২০০% বেড়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য এটি ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। পাশাপাশি, জমি দখল এবং ভূ-মাফিয়াদের আধিপত্য প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।
৩.পরিবেশগত ক্ষতি ও জলবায়ু পরিবর্তন ভূমি উন্নয়নের নামে বনাঞ্চল ধ্বংস এবং জলাভূমি ভরাটের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এর ফলে পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। বায়ুদূষণ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি যেমন এই খাতের ফলাফল, তেমনি বন্যার ঝুঁকিও বাড়ছে।
৪.গুণগত মানের অভাব ও অনিয়ম বেশিরভাগ আবাসন প্রকল্পে গুণগত মান নিশ্চিত না করে লাভ বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এর ফলে ভবন ধসে পড়ার মতো দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫.সামাজিক বৈষম্য ধনীক শ্রেণির জন্য বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং টাউনহাউস নির্মিত হলেও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্পের ঘাটতি প্রকট। এ ধরনের বৈষম্য নগরায়ণে নতুন সংকট সৃষ্টি করছে।
সমস্যার কারণ
১. নীতিমালা ও প্রশাসনিক জটিলতা ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাতে সুসংহত নীতিমালা এবং কার্যকর বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে।
২. প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার বাংলাদেশের নির্মাণশিল্পে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এখনও সীমিত। উন্নত দেশে পরিবেশবান্ধব নির্মাণের যে আধুনিক পদ্ধতি প্রচলিত, তা আমাদের দেশে এখনও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ হয়নি।
৩.দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতা ভূমি ক্রয়, বিক্রয়, এবং রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রকট।
উত্তরণের পথ
১.দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রয়োজন। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই হতে পারে এর মূল লক্ষ্য।
২.সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন স্বল্প এবং মধ্যম আয়ের জনগণের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প চালু করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে এটি কার্যকর করা যেতে পারে।
৩.পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সবুজ প্রযুক্তি এবং পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করে পরিবেশবান্ধব নির্মাণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. প্রযুক্তির ব্যবহার জমির রেজিস্ট্রেশন এবং নগর ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
৫.দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং এর কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে।
নীতিনির্ধারণী পরামর্শ
১. ভূমি উন্নয়ন ও আবাসনে সমন্বিত নীতি প্রণয়ন
২. জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
৩. ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ধারণা বাস্তবায়ন
৪. সাশ্রয়ী ব্যাংক ঋণ প্রদান।
বাংলাদেশের ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন খাত সম্ভাবনাময় একটি খাত, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, এবং ন্যায়নিষ্ঠ নীতিমালার মাধ্যমে এই খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
আপনার মতামত লিখুন :