ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বদলে যেতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৪, ০৮:২৭ পিএম

বদলে যেতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

কথা ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতে লড়বেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেই লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জো বাইডেন। বাইডেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এবার কমলা হ্যারিস। তাঁর নামটি উচ্চারিত হতেই মার্কিন ভোটরঙ্গ মঞ্চে সাড়া জাগায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লড়াই হবে তুল্যমূল্য। কোন কোন কারণে কমলা হ্যারিস এত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন? কমলা হ্যারিসকে এগিয়ে দিয়ে ডেমোক্র্যাট শিবিরও যে চাঙ্গা, সেটা চাঁদা আসার পরিমাণ দেখেই অনুমেয়। ডেমোক্র্যাট দলের ফান্ড ম্যানেজাররা উৎসাহের সঙ্গে জানিয়েছেন, হ্যারিসের নাম সামনে আসার পরেই ফান্ডে এক দিনে ৬০ মিলিয়ন ডলার চাঁদা জমা পড়েছে। তাহলে ধরে নিতে হয়, অতি দক্ষিণপন্থি ‘আইকন’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের (বিশেষত, পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানোর ঘটনার পরই তাঁর ‘অ্যাপ্রুভাল রেটিং’ যেভাবে চড়চড়িয়ে বাড়ছিল) বিপরীতে প্রার্থী হিসেবে জো বাইডেন টিকতে পারবেন না, বরং খড়কুটোর মতো উড়ে যাবেন এই আশঙ্কা তীব্র ভাবেই ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম কমলা হ্যারিসের লড়াই হলে তাতে অন্য পরিপ্রেক্ষিতও থাকবে। এরই মধ্যে ডেমোক্র্যাটরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কমলা হ্যারিসের প্রাথমিক পরিচিতি তৈরি হয়েছিল একজন সফল আইনজীবী ও কড়া সরকারি অ্যাটর্নি হিসেবে। ‘কালার্ড উইমেন’ কমলা হ্যারিস আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, আর বিপরীতে ট্রাম্প আইনের চোখে ‘অপরাধী’। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই এমন দু’জনের মধ্যে হবে যেখানে একজন আইনের হাতকে শক্তিশালী করা, মহিলাদের আইনি অধিকারের জন্য সর্বস্ব বাজি রাখতে পারেন এবং এর বিপরীতে থাকছেন একজন ধনকুবের যিনি নিজের যৌন সংসর্গের ‘কিস্সা’ গোপন রাখতে বেআইনি পথ বেছে নেন। রক্ষণশীল, মধ্যবিত্ত মার্কিন মূল্যবোধের ভোটারদের কাছেও কমলা হ্যারিসের অন্যরকম আবেদন থাকতে পারে, যাকে সদা বিতর্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে অতিক্রম করে যাওয়া সহজ হবে না।

বিশ্বজুড়ে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে গণতন্ত্র। চরম এক অস্থিরতায় ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষ। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেবল দেশটির নাগরিকদের কাছেই নয়, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর কাছেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এমন তথ্যই দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতা ও জনগণ। এ নির্বাচনের ফল তাদের জন্য কী বয়ে নিয়ে আনতে পারে সেই হিসাবও কষছেন তারা। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এ নির্বাচনকে। অনেকের মতো, রাজনীতিতে নতুন ধারার পথ দেখাচ্ছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার জনসমর্থনও তুঙ্গে। তবে দেশের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক অজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ট্রাম্প। সম্প্রতি পেনসিলভানিয়ায় এক জনসভায় আকস্মিক হামলার শিকার হয়েও অল্পের জন্য রক্ষা পান সাবেক এ প্রেসিডেন্ট। এতে নিজ দেশে তার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

এবারের নির্বাচনে তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট দলের কমলা হ্যারিস। দলের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন কুড়িয়েছেন এশীয়-আমেরিকান এ কৃষ্ণাঙ্গ নারী। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, তার চেয়ে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকানদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন ৪৯ শতাংশ। তার চেয়ে দুই শতাংশ পিছিয়ে কমলা হ্যারিস। অথচ মাসখানেক আগে এক জরিপ বলেছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে ছয় শতাংশ এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। কমলা সেই ব্যবধান ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছেন। জলবায়ুবিদরা বলছেন, আগামী নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে যে লড়াই হবে, তাতে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, বৈশ্বিক জলবায়ু নীতিতেও প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জলবায়ু সংক্রান্ত গোষ্ঠী ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ অ্যাকশনের সরকার ও রাজনৈতিক বিষয়ক পরিচালক অ্যারিয়েল মগের বলেন, ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই বিভিন্নভাবে, আমাদের এই গ্রহের তকদির আমেরিকান ভোটারদের ওপরই নির্ভর করছে। অনেকের কাছে আমার কথা বাগাড়ম্বরপূর্ণ মনে হলেও আমরা এই বাস্তবতার ভেতরেই বাস করছি।’

সবচেয়ে বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশের তালিকায় চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে যুক্তরাষ্ট্র। গেল বছরে দিনে গড়ে এক কোটি ২৯ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যদিয়ে ২০১৯ সালের রেকর্ড ভেঙেছে বিশ্বের শীর্ষ এ পরাশক্তি। কিন্তু মার্কিন নির্বাচনের প্রচারে জলবায়ু সংকট খুব একটা গুরুত্ব পায়নি বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেন, অর্থনৈতিক সংকট, অভিবাসন ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে যতটা না আলোচনা হচ্ছে, সে তুলনায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না জলবায়ু পরিবর্তন। বেশ কয়েকটি জরিপে দেখা যায়, আমেরিকানরা যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, তাতে জলবায়ু সংকট গুরুত্ব পাচ্ছে না। গত মে মাসে গ্যালপের এক জরিপে দেখা যায়, কেবল দুই শতাংশ আমেরিকান মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন তাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিপরীতে ৩৬ শতাংশ আমেরিকান অর্থনৈতিক সংকটকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার ও দুর্বল নেতৃত্বকে সমস্যা মনে করছে ২১ শতাংশ।

২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দায়িত্ব পালনকালে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। তখন ফিলিস্তিনি সংকটকে গুরুত্বহীন বিবেচনা করে নেতানিয়াহুর সরকারকে জোরালো সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল ট্রাম্প সরকার। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দিতে না পারলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতীতের ইতিহাসও ভালো খবর দিচ্ছে না। ট্রাম্পের আমলে করোনা মহামারিতে যখন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছিল, তখন দেশটির অর্থনৈতিক মার্কেটেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশটির জাতীয় ঋণের পরিমাণ ৩৪ ট্রিলিয়নের রেকর্ড স্পর্শ করেছিল। এদিকে, চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যযুদ্ধ ট্রাম্পের আমলে শুরু হয়েছিল, জো বাইডেন প্রশাসনও সেটা অব্যাহত রেখেছে। বৈদ্যুতিক যান, ব্যাটারি ও সৌর সেলসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতকে রক্ষা করতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চীনা পণ্যে মার্কিন বাজার সয়লাব হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সর্বশেষ পরিণতি নির্ধারণ করবে বিশ্বে আমেরিকার অবস্থান কী হবে। কারা বিজয় পেতে যাচ্ছে? মার্কিন মিত্র ইউক্রেন, নাকি পুতিন ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক চীন? বাইডেনের একের পর এক অস্ত্রের বহর এবং তার ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিতে ইউক্রেনের সক্ষমতায় উল্লেখযোগ্যভাবে আঘাত করেছে। কুরস্ক কি যুদ্ধে একটি অস্থায়ীভাবে বিশেষ পরিস্থিতি হিসেবে কাজ করেছে, নাকি সে মুহূর্তে ইউক্রেন ও তার সমর্থক তথা আমেরিকা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও দখল নিতে হামলার সূত্রপাত করেছে? আগামী সপ্তাহগুলোতে ইউক্রেনের মাটিতে, হোয়াইট হাউসে ও প্রচারণার পরীক্ষায় কী হতে যাচ্ছে, সেটিই ফল নিয়ে আসবে। আগামী ৫ নভেম্বর (মঙ্গলবার) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে যিনি জয়ী হবেন, তিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হবেন। দেখা যাক, এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে কে জয়ী হন?

 

সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ
 

আরবি/জেডআর

Link copied!