জলবায়ুু অর্থায়ন, অভিযোজন ও প্রশমন কৌশলগুলো ন্যায়সংগত হতে হবে এবং সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংকট মোকাবিলায় ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল, তা বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোর অর্থ সাহায্য কিছু আর্থিক সমস্যার সমাধান করলেও এর দ্বারা প্রকৃত জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থাকবে সব সময়। অভিযোজন পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ এবং তরুণদেরও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে।
এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং উচ্চাভিলাষী প্রশমন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে জোরালো অ্যাডভোকেসির প্রয়োজন রয়েছে, যাতে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং সহনশীলতা গঠনে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠেয় কপ-২৯ আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বয়ে আনবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সবাই। জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশের চলমান কার্যক্রমের ওপর আরও জোর দিতে হবে। মানব চলাচলে এর প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে এটিকে অন্যতম হিসেবে দেখা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে সহায়তা করতে জলবায়ু অর্থায়ন জরুরি। সবাই প্রত্যাশা করছে কপ-২৯ কাক্সিক্ষত ফল নিয়ে আসবে।
কপ-২৯-এর পক্ষগুলোর সম্মেলনের ২৯তম আসরে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বিশ্বনেতারা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হবে। ১৯৭টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ১৯৮টি পক্ষ নিয়ে কপ জলবায়ু-সম্পর্কিত নীতি বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ফোরাম।
এ সম্মেলনে জলবায়ু অভিযোজন, প্রশমন, লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতির জন্য অর্থায়নসহ বিভিন্ন জটিল বিষয়গুলোকে মোকাবিলা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশগুলোর জন্য সর্বাধিক উদ্বেগের বিষয়।
আজারবাইজানের বাকু শহরে এ সম্মেলনে প্রদর্শিত হবে বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ‘লতিকা’। নড়াইল জেলার চিত্রা নদীর পারে ঐতিহ্যবাহী মালো সম্প্রদায়ের এক সংগ্রামী নারী ও তার পরিবারকে নিয়ে ছবিটি বানিয়েছেন সামছুল ইসলাম স্বপন। তিনি জানান, আজারবাইজানের ‘ডকুবাকু আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব’-এর দুটি বিভাগে অংশ নিচ্ছে ‘লতিকা’। সে সুবাদেই ২৯তম জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ-২৯) জায়গা করে নিয়েছে প্রামাণ্যচিত্রটি। কপ-২৯ সম্মেলনে আরও দুটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে; একটি রাশিয়ার ‘অ্যাগেইনস্ট দ্য উইন্ড’, অন্যটি বেলজিয়ামের ‘ধন মেল্টিং স্নো’। ১১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে কপ-২৯ সম্মেলন। চলবে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। মালো সম্প্রদায়ের সংগ্রামী নারী লতিকা। তার স্বামী শ্যাম বিশ্বাস ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করে। দুই সন্তান ও তিন জোড়া ভোঁদড় নিয়ে তাদের টানাপড়েনের সংসারের চিত্র উঠে এসেছে এ প্রামাণ্যচিত্রে।
জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা করতে ৩২ হাজার মানুষের সমাবেশ হতে যাচ্ছে এ সম্মেলনে। জলবায়ু নিয়ে এই মহা আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করবে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করার জন্য কপ-২৯ সম্মেলনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। রেকর্ড ছাড়ানো বৈশ্বিক তাপমাত্রা, চরম আবহাওয়ায় বিপর্যস্ত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এসব সমস্যার সুনির্দিষ্ট সমাধানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে কপ-২৯ বিভিন্ন দেশের সরকার, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের নেতাদের একত্রিত করবে। জাতিসংঘের মতে, কপ-২৯-এর মূল লক্ষ্য হবে অর্থায়ন, কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকে জীবন ও জীবিকা রক্ষায় দেশগুলোর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। প্যারিস চুক্তির অধীনে দেশগুলোর হালনাগাদ জাতীয় জলবায়ুু কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হবে এ সম্মেলনে।
বাকুতে আসন্ন কপ-২৯ শীর্ষ সম্মেলন, জ্বালানি, বাণিজ্য, ব্যবসায়িক সহযোগিতা এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে একটি পরিকল্পিত বিমান পরিষেবা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভিযোজন বা দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের বিকল্প নেই। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় তহবিল আদায়ের কাজও চালিয়ে যেতে হবে।
কপ-২৮-এর অভিজ্ঞতা, ফল ও ভবিষ্যৎ নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে সবখানে, আলোচকেরা মনে করেন, পাহাড়, বন, নদীর মতো বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। অকারণে ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে বিপর্যয় ডেকে আনছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজনের পাশাপাশি নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ক্ষতিপূরণ আদায়সহ কপ-২৯ সম্মেলনে ভালো করতে হলে বাংলাদেশকে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে।
জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন কনফারেন্স অব পার্টিজ বা কপ-২৮ সম্মেলন গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে আরব আমিরাতে। এবার কপ-২৯ সম্মেলনের এজেন্ডা বা আলোচ্যসূচি বেরিয়ে আসছে। এজেন্ডা ধরে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের অভিযোজনের বা দুর্যোগ আসার আগের প্রস্তুতির সঙ্গে সমঝোতা করা যাবে না। কপ-২৯ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য ফলপ্রসূ করতে হলে অভিযোজন, সক্ষমতা, প্রযুক্তি, ক্ষতিপূরণ, পর্যবেক্ষণের মতো আটটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।
জলবায়ু মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শত বছরের জন্য প্রস্তুতি নিলেও বাংলাদেশের তা নেই, এ বিষয়ে নাগরিক সমাজকে আরও পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশে অনেক ভালো চর্চা আছে, আরও ভালো চর্চা দরকার। যাতে সক্ষমতা দেখানো যায়, টাকা দিলে সেটা আমরা খরচ করতে পারব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে তেমন ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না। আশপাশের দেশের তুলনায় কী পেয়েছি আমরা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দুই-তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। প্রক্রিয়াটাই ভিন্ন, প্রক্রিয়াটা হচ্ছে তারা কারিগরি সহযোগিতা দেবে, বড় বিনিয়োগ সহায়তা দেবে না। উন্নত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বাধ্য করা যায় না। ফলে সমঝোতা করতে গেলে খুব দুর্বল সিদ্ধান্ত আসে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল তৈরি হয়েছে, তা কার্যকর হতে এখনো সময় লাগবে। এ তহবিল পেতে হয়তো আরও কয়েক বছর লাগবে। ওই তহবিল যেন পাওয়া যায়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যাতে করে তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম দিকে থাকতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিমা করার ওপর কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে বন্য বা ঘূর্ণিঝড় হলে কৃষক দেউলিয়া হয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন ঝুঁকিতে যারা আছেন, তাদের বিমার আওতায় আনতে হবে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের বিকল্প নেই বলে মনে করেন অনেকে। উন্নত দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করছে। ফলে যে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে। তবে কপ-২৮ থেকে এ বিষয়ে সফলতা আসেনি।
জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে সরকারের পক্ষ থেকে যারা যান, তাদের আরও প্রস্তুতি নিতে হবে। ক্ষতিপূরণ পেতে হলে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। বান্দরবান ও সিলেট অঞ্চলে বন্যাসহ পরিবেশ নষ্টে সরকারের অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দায়ী করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ জানেন না, কপ কী! কিন্তু তারা জানে, তাদের ওখানে প্রতিবছর খরা হয়, খাদ্যসংকট দেখা দেয়, পানিসংকট দেখা দেয়। তহবিলের চেয়ে বড় বিষয় পাহাড়, পাথর ও ছড়া রক্ষা করা। পাহাড় কাটা বন্ধ করার জন্য তহবিল দরকার নেই। পাথর তুলে পানির উৎস বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে পাহাড় ধ্বংস করা হচ্ছে, সেখানে কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করা যায় তা ভাবতে হবে।
নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার। লবণাক্ততার কারণে সাতক্ষীরা অঞ্চলের নারীরা জরায়ুর নানা ধরনের জটিলতায় ভোগেন। দেশের প্রান্তিক মানুষেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক কৃষিপণ্য হারিয়ে যাচ্ছে। এই চিত্র দেশ-বিদেশে তুলে ধরতে হবে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কপ-২৮-এ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কপ-২৯-এ। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বর্তমানে বিশ্ব কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই বিষয়ে ফাঁকগুলো খুঁজে বের করে ২০৩০ সালের মধ্যে সমাধানের বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে আলোচনায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ১৯৯৪ সালে প্রথম ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) গঠিত হয়। প্রতিবছর ইউএনএফসিসিসির সদস্য দেশগুলোর অংশগ্রহণে জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক সম্মেলন কপ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমানে ইউএনএফসিসিসির সদস্য দেশ হলো ১৯৮। ১৯৯৫ সালের ২ মার্চ জার্মানির বার্লিনে প্রথম কপ-১ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে যৌথ উদ্যোগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
সমগ্র বিশ্বে খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি ছিল যুক্তিসম্মত। তা ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন প্রায় ৪৩ শতাংশ কমানোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
২০২০ সালে কপ-২৬ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে রেজিলিয়েন্স ক্লাইমেট চেইঞ্জ ও বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমানোর জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন রোধে দৃশ্যমান পরিকল্পনার সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কী কর্মপরিকল্পনা যোগ করা যেতে পারে, সেই বিষয় আলোচনায় গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছিল। ফলে ওই সময় প্যারিস চুক্তিতে উল্লিখিত বেশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার সম্ভাবনাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কপ-২৭-এ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচিত হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বছরে সুনির্দিষ্ট অর্থের বরাদ্দের নিশ্চয়তা প্রদান। যেহেতু বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা অসম্ভব, সেহেতু একুশ শতকের শেষে তাপমাত্রা ২ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে কীভাবে রাখা যায়, সে বিষয়ে আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে একটি নতুন জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ড গঠনের বিষয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছিল। ওই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়, উন্নত দেশগুলোর সহায়তায় ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বরাদ্দের বিষয়টি বাস্তবায়ন না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। পরিশেষে ২০২৪ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ফান্ড দ্বিগুণ করার জন্য জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটিজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান, ন্যাশনাল এডাপটেশন প্রোগ্রাম, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট অ্যাক্ট, এনডিসি, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ও ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানসহ আরও অনেক পরিকল্পনা বিদ্যমান রয়েছে। এনডিসি অনুযায়ী দেখা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে শর্তহীনভাবে নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশ প্রায় ২৭ দশমিক ৫৬ টন গ্রিন হাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডল থেকে কমাবে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। ওই ফান্ডের আওতায় ৮০০ প্রকল্পে প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রায় ২ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন অর্থ ব্যয় করেছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ ২০০ মিলিয়নের বেশি ইউএস ডলার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করছে। অন্যদিকে মন্ট্রিল প্রটোকল অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে ২ দশমিক ১৪ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে কমানোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ যদি কপ-২৯-এ ফান্ডের নিশ্চয়তা পায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিদ্যমান কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সমগ্র বাংলাদেশে বনায়ন ১৭ থেকে ৩০ শতাংশে উন্নীতকরণ, বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন, খরা, বন্যা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু উন্নত জাতের কৃষি ফসলের উৎপাদন বাড়ানো, নদীর নাব্য বৃদ্ধিকরণ ও জলাশয়গুলোর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা, পরিকল্পিত শহরায়ন ও শিল্পায়ন, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো, কৃষিতে কেমিক্যালের পরিবর্তে জৈব ও পরিবেশবান্ধব বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়ানো ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। বাংলাদেশও ভবিষ্যতে জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯ থেকে প্রাপ্ত ফান্ডের সদ্ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জিরো কার্বনের দেশে পরিণত হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :