ঢাকা সোমবার, ০৭ অক্টোবর, ২০২৪

যুদ্ধের দামামা মধ্যপ্রাচ্যে, শান্তি দূর অস্ত

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৪, ০৩:৫৮ পিএম

যুদ্ধের দামামা মধ্যপ্রাচ্যে, শান্তি দূর অস্ত

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গত কয়েক বছর ধরেই আগুন জ্বলছিল। কখনো তা অল্প আঁচে আবার কখনো একটু তীব্র। এখন তা প্রায় পুরো মাত্রায় জ্বলে উঠেছে। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত চরমে পৌঁছেছে। পক্ষে ও বিপক্ষে পাশর্^বর্তী দেশগুলোতেও যুদ্ধের মেঘ ঘনাতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ইসরাইলে ইরানের উপর্যুপরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তেল আবিবের সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করেছে ওয়াশিংটন। তেহরানও পালটা হামলার হুমকি দিয়েছে। এভাবে চললে পুরো মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।  গোটা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে। লেবাননে ইরানসমর্থিত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ-প্রধান হাসান নাসরুল্লার মৃত্যুর বদলা নিতে ইসরাইলে ভয়ঙ্করর হামলা চালিয়েছে তেহরান। ইসরায়েলজুড়ে আছড়ে পড়ে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক মিসাইল। রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-হামাসের পথ ধরেই এখন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। জড়িয়ে পড়েছে হুথি বিদ্রোহীরাও।

ইসরায়েলকে এখন বহুমুখী ক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যেই পক্ষ-বিপক্ষ দেশগুলো থেকে ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে যদিও এখনই বড় মাত্রায় যুদ্ধে বেশিরভাগেরই সম্মতি নেই। তবে ইসরাইলের সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই এগিয়ে আসবে। বহুবছর যুদ্ধের মুখোমুখি পরিস্থিতি তৈরি হলেও সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ায়নি দুই দেশই। এড়িয়ে গেছে বড় ধরনের সংঘাত। তবে এর মধ্যেই ইরানের উচ্চপর্যায়ের নেতা হত্যার শিকার হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বারবার। তবে এবার কি পরিস্থিতি এড়ানো যাবে? বিশ্লেষকরা বলছেন যে, এটা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। আর যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে যুদ্ধ সম্ভবত চাইবে না। কারণ দেশটিতে সামনেই নির্বাচন। নির্বাচনের আগে অন্তত যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। এরপর প্রশ্ন হলো ইরানের পরমাণু স্থাপনায় ইসরাইলের হামলার সম্ভাব্যতা। এ নিয়েও আলোচনা চলছে। ইরসাইল মুহূর্তে এটা করলে তা হবে ভুল সিদ্ধান্ত এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব হবে না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলকে রক্ষায় জড়িয়ে পড়বে। আর বাকি দেশগুলোও কম বেশি জড়িয়ে যাবে। যার ফল হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভয়ঙ্কর। টার্গেট হতে পারে ইরানের তেল স্থাপনাগুলোও।

ইসরাইলে মধ্যপ্রাচ্য গত কয়েক বছর ধরেই বেশ উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতি আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে মূলত কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হলে। এরপর আরও কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মধ্যপ্রচ্যে উত্তেজনা কমেনি। বরং দিন দিন তা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও। লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ হাবিব বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান জোরদার করার পর থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখে পৌঁছেছে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার আগে লেবাননে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার। তারপর ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের হামাসের সংঘাত শুরু হলে হিজবুল্লাহর সঙ্গেও ইসরায়েলের হামলা পাল্টা হামলা ঘটতে থাকে। সেই পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সংঘাত বহু বছর আগের হিসাব। বহু বার উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সম্প্রতি লেবাননের যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে টার্গেট করে ভয়াবহ বিমান হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।

২০০৬ সালে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘাত শুরুর পর একদিনে এতজন মানুষ নিহতের নজির নেই। সোমবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫০ শিশুসহ ৫৬৯ জন লেবানিজ প্রাণ হারিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিরাস আবিয়াদ। এছাড়া আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮৩৫ জন। চলমান হামলার জেরে লেবাননে হিজবুল্লাহ সিনিয়র নেতা ইব্রাহিম মুহাম্মাদ কুবাইসি নিহত হয়েছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর লেবাননে এবারই সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইসরাইলের এই হামলা। সংঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রাণহানি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি। একদিকে ইসরায়েল লেবাননের হিজবুল্লাহকে টার্গেট করে বিমান হামলা চলাচ্ছে। অন্যদিকে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিতে রকেট নিক্ষেপ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ভয়াবহ সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সুতরাং এর থেকেও যে বিষয়টি বেশি ভাবাচ্ছে সেটি হলো মধ্যপ্রাচ্য এখন একটি বড় যুদ্ধের সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে। যেটি ঘটলে অবশ্যই খুব খারাপ হবে এবং তা আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনের সমর্থনে ইসরাইলের সঙ্গে গত এক বছর যাবত সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে।

লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে তেল আবিবের হামলায় হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাত চরম মাত্রায় পৌঁছেছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে একদিনে এত প্রাণহানি দেখেনি লেবানন। খুব দ্রুতই এই যুদ্ধ শেষ হওয়ারও কোনো লক্ষণ নেই। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যেকার যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,  ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর প্রথম সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় ১৯৮২ সালের জুন মাসে। তখন ইসরায়েল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছিল। তেল আবিব পিএলও-এর হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেবাননে হামলা করে। ১৯৮৩ সালের অক্টোবরে বৈরুতে ফরাসি এবং মার্কিন সামরিক ব্যারাকে বোমা হামলা। সেসময় তিন শতাধিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য নিহত হন। উগ্রপন্থি ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠী এই হামলার দাবি করলেও, অনেকের ধারণা হামলার পেছনে হিজবুল্লাহ জড়িত ছিল। ১৯৮৫ সাল নাগাদ, হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননের বেশিরভাগ অংশ থেকে ইসরাইলের সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে দিতে পেরেছিল। ২০০৬ সালে, হিজবুল্লাহ কর্তৃক দুই ইসরায়েলি সেনা অফিসারকে বন্দি করার মধ্য দিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে পুনরায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে শুরু হয় জুলাই যুদ্ধ। ৩৪ দিনের সংঘাতের ফলে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে: ১২০০ লেবানিজ এবং ১৫৮ জন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছিলেন।

এরপর ইসরায়েল হামাসের ওপর হামলা শুরু করলে এবং নিরীহ ফিলিস্তিনদের নির্মমভাবে হত্যা শুরু করলে হিজবুল্লাহ ফের ইসরায়েলের ওপর রকেট হামলা চালায় এবং ইসরায়েলও তার জবাব দেয়। সেখান থেকে এখন এই যুদ্ধ উভয়পক্ষের মধ্যে তীব্রতা পেয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহ এবং হামাসের চলতি সংঘাত বর্তমানে একটি সংকটপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে। এমন অবস্থা বিশে^র পরাশক্তিধর দেশগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে। যদি তা আরেকটি পূর্ণমাত্রার সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে। কারণ যুদ্ধ শুধু ইরান আর ইসরায়েলের মধ্যেই থেমে থাকবে না। এটি আরো বিস্তৃত হবে। ফলে সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য। আর এই যুদ্ধ শুরু হলে তা হবে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা। এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্য গতে কয়েক বছর ধরেই বেশ উত্তপ্ত হয়ে আছে। এর মধ্যেই ইরসায়েল ফিলিস্তিনে হামলা চালালে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। এখানে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো ইসরায়েল যদি লেবাননে হিজবুল্লাহ দমনে সর্বাত্মক হামলা চালায় তাহলে আরও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটবে এবং পরিস্থিতি যদি আরেকটি যুদ্ধাক্রান্ত শহরের মতো হয় তাহলে বিশ্বের জন্য নিশ্চয়ই ভালো হবে না। তা ছাড়া লেবানন এবং ফিলিস্তিন এক নয়। ফলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘লেবানন একদম খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কেউই লেবাননকে আরেকটা গাজা হয়ে যেতে দিতে পারি না। হামলা ক্রমেই বিস্তৃত করছে ইসরায়েল। এটিকে বিশ্লেষকরা অবশ্য পুরোপুরি হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধই বলছেন। সমস্যা হলো এটি দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। নতুন এই উত্তেজনা নিয়ে উদ্বিগ্ন রাশিয়াও। এরই মধ্যে রাশিয়া সতর্ক করে জানিয়েছে, লেবাননে ইসরায়েলি হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্য সম্পূর্ণভাবে অস্থিতীশীল হয়ে পড়তে পারে ও সংঘাতের পরিধি আরও বাড়তে পারে।

পৃথিবী এমন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে যেখানে বৈশি^ক রাজনীতি একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অবস্থা এমন যে নগর পুড়লে দেবালয় এড়াতে পারে না। মধ্যপ্রাচ্য যদি একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধে জড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে পৃথিবীর বাকি অংশ এর আঁচ থেকে বাঁচতে পারবে না। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষ প্রভাব হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।

এই যুদ্ধ এমন এক সময়ে শুরু হলো যখন মার্কিন নির্বাচন আর কিছু দিন বাকি। ওদিকে গাজা যুদ্ধও এখনো বিরতির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ইরানে হামাস নেতা নিহত হওয়ার পর থেকে সেই সম্ভাবনা প্রায় কমে এসেছে। এর ফলে মানবতা আরও ভয়াবহভাবে বিপন্ন হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধও চলমান। এই তিন যুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পদক্ষেপ কিছুটা স্তিমিত নির্বাচনের কারণে। এই তিন যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সহজ করা নয়। আবার এই তিন ক্ষেত্রেই শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য এতসব দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধের ডামাডোলে বেশ খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যকে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বের করতে হলে প্রয়োজন বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। প্রয়োজন কার্যকর শান্তি চুক্তি। 

লেখক 

অলোক আচার্য

প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

 

আরবি/জেআই

Link copied!