এমপক্স, যা আগে মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত ছিল। এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। যা বেশ জোরালোভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু মহামারি কী জিনিস, তা চার বছর পূর্বেই সারা বিশ্ব দেখেছে। করোনা মহামারির সমাপ্তি ঘটেছে অনেকটাই। কিন্তু এখনো তার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারে নাই বিশ্বের অনেক দেশ। আর এর মধ্যে চোখ রাঙাচ্ছে মাঙ্কিপক্স। যা গুটিবসন্ত গোত্রের রোগ। আফ্রিকান অঞ্চলে মাঙ্কিপক্স পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। বিশ্বের অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে রোগটি। স্বাভাবিকভাবেই উপায়ান্তর না দেখে গত ১৪ আগস্ট এই ভাইরাসের সতর্কতায় বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির মতে, এই রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এবং মানুষের জীবন বাঁচাতে একটি সমন্বিত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। দ্য আফ্রিকা সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্যমতে, এই বছরের জুলাই অবধি সাড়ে ১৪ হাজার মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে। এ সময় পাঁচ শতাধিক আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
মাঙ্কিপক্স নতুন কোনো ভাইরাস না। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কে একটি বানরের দেহে প্রথম এই রোগটি শনাক্ত হয়। যার জন্য একে মাঙ্কিপক্স বলা হয়। তবে বানর এই রোগের জন্য দায়ী নয়। মাঙ্কিপক্সের দুটি প্রধান ধরন রয়েছে। যাকে বলা হয়, ক্লেড-১ ও ক্লেড-২। ২০২২ সালেও একবার এমপক্স নিয়ে ‘জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা’ ঘোষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ক্লেড-২ ধরনের তুলনামূলক মৃদু সংক্রমণে জারি করা হয়েছিল এই জরুরি অবস্থা। তবে আশঙ্কার কথা হলো, এখন আরও অধিক প্রাণঘাতী ক্লেড-১ এর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এর আগে এ ধরনের সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল ১০ শতাংশ পর্যন্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে এমপক্সের ভাইরাসের রূপ বদল হয়। এই রূপান্তরে তৈরি হওয়া নতুন ধরনটির নাম ক্লেড-১বি। তখন থেকেই দ্রুত ছড়াচ্ছে। মনে রাখতে হবে, একটি ভাইরাস যত ছড়ায়, তত তার রূপ বদলায়। করোনার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছে। রূপবদলের কারণে বিপদের মাত্রা সারা বিশ্বই দেখেছে। সেই কারণেই মাঙ্কিপক্স অধিক ছড়ালে তার কোনো একটি ধরন আরও অধিক বিপজ্জনক ও অধিক সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। এই ধরনের ভাইরাসের বিপদ এখানেই। তা ছাড়া এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার যথেষ্ট অধিক।
মাঙ্কিপক্সের ইনকিউবেশন পিরিয়ড, অর্থাৎ সংক্রমণের পর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সময়সীমা সাধারণত ৬ থেকে ১৩ দিন। তবে এটি ৫ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত হতে পারে। রোগটি সাধারণত স্বল্পমেয়াদি হলেও কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল, যেমন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি বা ক্যানসার, অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট গ্রহণকারীরা, তাদের জন্য মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এ ছাড়া যারা সংক্রমিত রোগীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন, যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের জন্য মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলো সাধারণত ফ্লু-এর মতো শুরু হয়। যার মধ্যে থাকে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশি ব্যথা এবং ক্লান্তি। এর সঙ্গে লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া (লিম্ফ্যাডেনোপ্যাথি) ঘটে, যা মাঙ্কিপক্সকে গুটিবসন্ত থেকে আলাদা করে। এরপর ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, যা মুখ থেকে শুরু করে শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এই ফুসকুড়ি বিভিন্ন পর্যায়ে যায়। প্রথমে ম্যাকুলস, তারপর প্যাপুলস, ভেসিকলস, পুস্টুলস এবং শেষে স্ক্যাব।
জানা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তির নিবিড় সংস্পর্শ, যেমন শারীরিক সম্পর্ক, ত্বকের স্পর্শ, এমনকি খুব নিকট হইতে কথাবার্তা বলা বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে এমপক্স। এই রোগের উপসর্গ ফ্লুর মতো। ভাইরাসটি বায়ুবাহিত। প্রায় চার দিন অবধি বাতাসে টিকে থাকতে পারে। এর অর্থ, এই সময়কালে এর সংক্রামক ক্ষমতা থাকে। এই রোগে আক্রান্তদের মুখ, হাত, বুক ও নিম্নাঙ্গে ফোসকা বা ফুসকুড়ির মতো দেখা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে শতকরা ৮৫ ভাগ কার্যকর। এই টিকার মাধ্যমে ২০২২ সালে এর সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। এই বছর ইতিপূর্বে পাকিস্তানে এই রোগে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। উপমহাদেশের জনঘনত্ব অধিক বিধায় যে কোনো সংক্রমণ রোগ উপমহাদেশের জন্য অধিক বিপদের। সুতরাং উপমহাদেশে এই রোগ প্রবেশ করলে তা প্রতিরোধের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে অধিক দায়িত্বশীল হতে হবে।
করোনা প্রতিহতের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। যদিও করোনার মতো না। তবে মাঙ্কিপক্স গুটিবসন্ত গোত্রের রোগ বিধায় গুটিবসন্তের যেই ভ্যাকসিন রয়েছে, তা দিয়েই আপৎকালীন পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা চলছে। গুটিবসন্ত অনেক পূর্বেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই ভ্যাকসিন সেই কারণে উৎপাদন করা হয় না। এখন সারাবিশ্বের সমস্যা। সুতরাং, একে মোকাবিলাও করতে হবে বৈশ্বিকভাবে। যেকোনো মহামারির আশঙ্কার পরিস্থিতিতে অনেক ধরনের গুজব ছড়ায়। সুতরাং, অহেতুক আতঙ্ক ও গুজব যাতে না ছড়ায় সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ
আপনার মতামত লিখুন :