ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
জলবায়ু পরিবর্তন

এল নিনোর প্রভাবে বাড়ছে বন্যা

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৪, ০৭:৪৯ পিএম

এল নিনোর প্রভাবে বাড়ছে বন্যা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

স্প্যানিশ শব্দ ‘এল নিনো’। এর অর্থ হলো ‘লিটল বয়’ বা ‘ছোট ছেলে’। পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তখন তাকে এল নিনো বলা হয়। আর এর বিপরীত অবস্থার নাম ‘লা নিনা’, যার অর্থ ‘লিটল গার্ল’ বা ‘ছোট মেয়ে’। পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তখন তাকে লা নিনা বলা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) বিজ্ঞানীরা বলেন, পূর্বাভাস অনুযায়ী, এল নিনো জলবায়ু পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেছে। এতে আবহাওয়া ও তাপমাত্রা চরম রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এনওএএর জলবায়ুবিজ্ঞানী মিশেল এল হুরু বলেন, এল নিনো কতটা শক্তিশালী, তার ভিত্তিতে পরিবেশের ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। যেমন বিশ্বজুড়ে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ভারী বৃষ্টি কিংবা খরার ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আবহাওয়াবিদরা গত জুনে ভারতের পুনে শহরে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। সম্মেলনে এ অঞ্চলে চলতি মৌসুমের প্রচণ্ড গরম নিয়ে আলোচনা হয়। তবে আলোচনার মূল বিষয় ছিল আসন্ন বর্ষা মৌসুম (জুন-সেপ্টেম্বর)। সম্মেলনে আগামী মাসগুলোর আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে এ অঞ্চলের শীর্ষ আবহাওয়াবিদরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি প্রাথমিক মতামত হাজির করেছেন। সেটি হলো, এবার বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য খবর ছিল, এ দেশে বর্ষায় বৃষ্টি যেমন বেশি হবে, তেমনি বাংলাদেশের উজানে ভারতের রাজ্যগুলোতেও বৃষ্টি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বর্ষায় বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা আছে। 

এল নিনো সক্রিয় হলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি শুষ্ক রেখা তৈরি হয়। এর উল্টো অবস্থা হলো লা নিনা। এটি তৈরির সময় শুষ্ক রেখাটি উষ্ণ রেখায় পরিণত হয়। এতে বাতাসে জলীয় বাষ্প বেড়ে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টি বেড়ে যায়। ভারতে আবহাওয়াবিদদের সম্মেলনের পর যে বিবৃতি প্রচার করা হয়, তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে এবার বর্ষা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের তাপপ্রবাহের এলাকাগুলোতে এবার বৃষ্টিও বেশি হবে। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জুনেই বন্যার একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের উজানে তো বটেই, সিলেট বিভাগজুড়ে বৃষ্টি হবে। এতে সুরমা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে বন্যা শুরু হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ ৭৬ বছরের মধ্যে এবার এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশি দিন টানা তাপপ্রবাহের মধ্যে কাটিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ চৌধুরী বলেন, ১৯৯৭ সালে এল নিনোর কারণে টানা তাপপ্রবাহ ও খরা হয়, পরের বছর বেশি বৃষ্টির কারণে বড় বন্যা হয়।

এর মধ্যেই দেশের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার অনেক উপজেলা আকস্মিক বন্যায় ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছে। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই করুণ, যা কল্পনাতীত। এ বছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বন্যা হয়েছে। সিলেট অঞ্চলেও বন্যা হয়েছে। এবার হলো চট্টগ্রাম বিভাগে। বাংলাদেশে ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপরে যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও বন্যা হলো, তার জন্য আবহাওয়াসম্পর্কিত ৪টি প্রধান কারণ খুঁজে পাওয়া যায় প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে। ১. এল-নিনো ২. মেডেন-জুলিয়ান দোলন বা সংক্ষেপে এমজেও ৩. জেট স্ট্রিম ও ৪. বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি লঘু চাপ। আবহাওয়াসম্পর্কিত এই চারটির প্রতিটি কারণই পৃথকভাবে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। দৈবক্রমে আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে একই সঙ্গে ৪টি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর একই সময় সক্রিয় অবস্থায় উপনীত হয়ে ৪টি বৈশিষ্ট্যের মিলিত প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিমাত্রার বন্যা দেখা যাচ্ছে। যার সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশ, চীন এবং কানাডার ভয়াবহ বন্যা। এত ঘন ঘন বন্যা হওয়া আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকা বায়ুমণ্ডল এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আর্দ্রতা ধারণ করছে। বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন।

২০২৩ সালের এপ্রিলে ইরাক, ইরান, কুয়েত এবং জর্ডান প্রতিটি দেশে ভয়াবহ বন্যা আঘাত হেনেছে। তার সঙ্গে ছিল তীব্র বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি এবং অতি মাত্রায় বৃষ্টিপাত। আবহাওয়াবিদরা পরে দেখতে পান যে, ওইসব অঞ্চলের আকাশ বা বায়ুমণ্ডল রেকর্ড পরিমাণ আর্দ্রতা বহন করছে। যা ২০০৫ সালের পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। দুই মাস পরে, চিলিতে মাত্র তিন দিনে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। আকাশ থেকে এত বেশি পানি ঝরেছিল যে, এটি আন্দিজ পর্বতের কিছু অংশের তুষারও গলিয়ে ফেলে। এতে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। ফলে সেখানকার রাস্তাঘাট, সেতু এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে বন্যা আঘাত হানে। যাকে সেই দেশের রাজনীতিবিদরা রেইন-বোমা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। 

বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলো প্রতিনিয়ত দীর্ঘ, প্রশস্ত এবং প্রায়ই ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। যা বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে বন্যার ঝুঁকিতে ফেলছে বলে জানিয়েছে নাসা। এই আকাশের নদী বা উড়ন্ত নদী হলো ভূপৃষ্ঠ থেকে বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত লম্বা ও প্রশস্ত জলীয় বাষ্পের স্তম্ভ যার উদ্ভব হয় সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে, পরে তারা ঠান্ডা মেরু অঞ্চলের দিকে সরতে থাকে। এই উড়ন্ত নদীগুলো পৃথিবীর মধ্য-অক্ষাংশজুড়ে চলাচল করা মোট জলীয় বাষ্পের প্রায় ৯০ শতাংশ বহন করে। একটি বায়ুমণ্ডলীয় নদী গড়ে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ, ৫০০ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং প্রায় তিন কিলোমিটার গভীর হয়ে থাকে। যদিও এই নদীগুলো ক্রমেই দীর্ঘ ও প্রশস্ত হচ্ছে। অনেক সময় তা পাঁচ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি দীর্ঘ হয়ে প্রশস্ত হয়ে থাকে। তবুও, মানুষ এই নদী চোখে দেখতে পায় না। তারা যা দেখে তা শুধুই কিছু পুঞ্জীভূত মেঘ। জেট স্ট্রিম হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুর একটি পরিবর্তিত ধরন। আঞ্চলিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বায়ুমণ্ডলীয় নদী সম্পর্কে ধারণা বেশ সীমিত বলেছেন ভালপারাইসো বিশ্ববিদ্যালয়ের বোজকার্ট। এক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো জটিল অঞ্চলগুলোয় বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলোর উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি থাকা।

 

সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ
 

আরবি/জেডআর

Link copied!