তরুণী অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ হেলেনা খাতুনের বোনের এখনো কানে বাজছে তার ছোট বোনের করুণ আর্তনাদ ‘বুবু আমি আর বাঁচব না। আমাকে একটু পানি খাওয়াও’। অথচ সকালবেলা এই হেলেনার চোখেই স্বপ্ন ছিল কোলে নবজাতক সন্তান নিয়ে ঘরে ফিরে আসবেন।
অনাগত এই সন্তানের মা এমন একটি পরিবেশে বাস করতেন, যেখানে ৯ মাসের গর্ভবতী হেলেনার রক্তক্ষরণ শুরু হলে, অন্য কোনো উপায় না পেয়ে তাকে জলচৌকিতে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কপাল ছিল মন্দ। পথের কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এলেন লাশ হয়ে, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে। এই দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটে কয়েক বছর আগে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি ঘাটে। যেটা আমার মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে।
হেলেনাদের বাড়ি যমুনার চরে কালুরপাড়ায়। শুকনো মৌসুমে নদী থেকে মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার জন্য নেই কোনো যানবাহন। দুর্গম চরে হেঁটে চলাচলের একমাত্র বিকল্প ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু জরুরি মুহূর্তে অনেক সময় সেটাও মেলে না বলে জানিয়েছেন চরের মানুষ।
ঠিক যেমনটা ঘটেছিল হেলেনাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময়। কালুরপাড়া চর থেকে কাঁধে করে যখন হেলেনাকে ফুলছড়ি ঘাটে নেওয়া হচ্ছিল, তখন সময় দুপুর। হেঁটে যেতে সময় লেগেছে ৪ ঘণ্টা। এরমধ্যে যন্ত্রণায় ছটফট করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন হেলেনা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ফুলছড়ি ঘাট থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে। এর মাঝে নেই কোনো সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক। ৪০ হাজার মানুষের মধ্যে কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জলচৌকি বা চাঙিতে রশি বেঁধে ঘাড়ে উঠিয়ে হেঁটে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক সময় যাদের বাড়িতে লোক পাওয়া যায় না, তারা যেতেই পারে না। এখানেই বিনা চিকিৎসায় ভুগতে হয়।
এ দুর্ভাগ্য শুধু হেলেনারই নয়, গাইবান্ধার দুর্বল এই স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারাতে হয় আরও অনেক অন্তঃসত্ত্বা মায়ের। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে স্বামীরা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চান না।
এর আগে করোনাকালে আমরা ছবি দেখেছিলাম করোনায় আক্রান্ত মাকে বাঁচাতে অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে ছেলে পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে মোটরসাইকেলে করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন।
কোথাও অ্যাম্বুলেন্স, এমনকি অটো রিকশা বা কোনো থ্রি-হুইলার না পেয়ে নিজের পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার গামছা দিয়ে বেঁধে মোটরসাইকেলে মাকে নিয়ে সেই ঝালকাঠি থেকে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করিয়েছেন। সেই মা বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাঁচতে পারলেন না হেলেনা।
অন্য একটা খবরে দেখলাম অ্যাম্বুলেন্সের অনেক ভাড়া দিতে পারবেন না বলে একজন বাবা তার অসুস্থ মেয়েকে ১১০ কিলোমিটার পথ ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে ঠাকুরগাঁ থেকে রংপুরে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। সাত মাসের ছোট মেয়েটি রক্ত আমাশয়ে ভুগছিল। ঠাকুরগাঁও হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন জাগে কেন একজন রক্ত আমাশয়ের শিশু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো যন্ত্রপাতি বা চিকিৎসক ঠাকুরগাঁওয়ের মতো পুরোনো জেলা সদর হাসপাতালে ওই সময়ে ছিল না? কেন বাবাকে রিকশা চালিয়ে মেয়েকে রংপুর হাসপাতালে নিতে হলো?
গত ৫৩ বছরে দেশের চিকিৎসা খাত অনেক এগিয়েছে বলে আমাদের সামনে দাবি করা হয়। বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের আছে শক্তিশালী গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামো। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ না হয়েও বাংলাদেশ গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।
এখন মানুষের বাড়ির পাশে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এরপর আছে জেলা হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিটি জেলায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক।
এরপরেও কেন চিকিৎসাকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেন না প্রান্তিক এলাকার মানুষজন? বিশেষ করে যারা চর বা নদীভাঙন এলাকায় বাস করেন, তারা এসব সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত আছেন। ফুলছড়ি ইউনিয়নে কোনো স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ছিল না। যদি থাকত তাহলে হয়তো হেলেনাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত। অনেক জায়গায় প্রশিক্ষিত ধাত্রী বা কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্স আছেন। তারা যে আছেন, সেই প্রচারটাও করতে হবে। হয়তো সুবিধা থাকা না থাকা সমান হয়ে যায়।
চরের মধ্যে বসবাসকারী রোগীকে সেবা দেওয়া বেশ কষ্টকর। নৌকা নিয়ে দুর্গম একটি চরে যেতে প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। আবার চর থেকে একজন অসুস্থ রোগীকে মূল ভূখণ্ডে আনতে নৌকা ভাড়া লাগে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এ কারণে অনেক রোগীকে হাসপাতালে নিতে পারেন না স্বজনরা। আর শুকনো মৌসুমে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে যায়। সেজন্য প্রতিটি চর এলাকা ধরে নৌ-হাসপাতাল চালু করা দরকার। বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের একটা হাসপাতাল ছিল গাইবান্ধায়। ঠিক এভাবেই সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারের অনেক কল্যাণকর উদ্যোগ দৃশ্যমান, তাহলে গ্রামীণ এলাকার জনগণ কেন পুরো সুবিধাটা পাচ্ছে না? এই অবকাঠামোর ভেতরেই আরও উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু হচ্ছে না। কারণ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুল সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। দ্বিতীয়টিই এখানে বেশি মারাত্মক।
বেসরকারি চিকিৎসা এদেশের শতকরা ৮০ জন মানুষের জন্য নয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে যারা সমাধান খুঁজেছেন, তারা ভুল করছেন বা ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। এদেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে চিকিৎসা পৌঁছে দিতে না পারলে সরকারের এত টাকা ব্যয়ে অবকাঠামো নির্মাণ সব ভেস্তে যাবে। স্বাস্থ্য খাতে পাবলিক সেক্টরকে শক্তিশালী করতে হবে, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে দক্ষ জনবল।
সরকারি তথ্য বলছে, আমাদের স্বাস্থ্যের পেছনে যত খরচ হয়, তার ৬৭ শতাংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে খরচ করছে। অথচ বৈশ্বিক মান হচ্ছে ৩৪ শতাংশের মতো। তার প্রায় দ্বিগুণ আমরা খরচ করছি। আমাদের কাছে স্বাস্থ্য খরচ একটা বড় বোঝা। স্বাস্থ্যসেবার খরচের বিষয়টি আমরা ঠিকমতো স্বীকার করি না বলে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমে যাচ্ছে বা দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। (অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান) ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এখন মনে হয় কথার কথা। ‘মানসম্মত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা’ নিশ্চিত করতে হলে শুধু বিনিয়োগ নয়, অপচয় রোধ এবং দুর্নীতি দমন করতে হবে কঠোর হাতে। চিকিৎসা ব্যবস্থায় রয়ে গেছে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি ও পরিকল্পনার অভাব।
গ্রাম বা জেলাপর্যায়ে প্রায় সব চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল। কারণ শুধু অবকাঠামো দিয়ে একটা হাসপাতাল চলবে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে দুর্বলতা বা সক্ষমতার অভাব রয়েছে, করোনাকালে তা চোখে পড়েছে খুব প্রকটভাবে। আসলে স্বল্প বরাদ্দের বাজেটের পরিকল্পিত সদ্ব্যবহারের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
বড় নেতিবাচক ব্যাপারটা হচ্ছে আমাদের দুর্নীতি পরায়ণতা ও কাজে ফাঁকি দেওয়ার মনোভাব। যার, যেখানে দায়িত্ব পালন করার কথা, তিনি কি সেখানে থেকে সেই দায়িত্ব পালন করছেন? এ খাতে প্রশাসনিক দুর্বলতাও চূড়ান্ত। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে বা অভিযোগ প্রমাণিত হলে, তাকে শুধু বদলি করা হয় বা ওএসডি করা হয়। বড়জোর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। এই অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি বহু বছরেও।
বাংলাদেশ এখন দ্রুত নগরায়ণের দেশ। মোট জনসংখ্যার ৩৬.৬ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি মানুষ বাংলাদেশের নগর এলাকাগুলোতে বসবাস করছে এবং এর এক তৃতীয়াংশ বস্তিবাসী। নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা খুব একটা ভালো না। যেকোনো পাবলিক হাসপাতালে গেলে দেখা যায় অসুস্থ মানুষের ঢল নেমেছে। হুড়োহুড়ি ভিড়, ডাক্তার, স্টাফরা হিমশিম খাচ্ছেন। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য পাবলিক হাসপাতাল ছাড়া আর কোনো জায়গাও নেই।
একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, নগরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের এবং তাদের সেই সামর্থ্য নেই নগরে অবকাঠামো দাঁড় করাবে। সরকার অনেকগুলো নতুন হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট তৈরি করেছে। মানুষের তুলনায় তা কিছুই না। সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার এই চাহিদার বিপরীতে নগরে গড়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা।
শুধু কি নগরে? গ্রামগঞ্জে এত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও রোগীরা উপায়হীনভাবে সরাসরি ওষুধের ফার্মেসি অথবা এলাকার ডাক্তারের কাছে বেশি ভিজিট দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমি নীলফামারি জেলার একটি গ্রামের কথা বলছি। দেখলাম উপজেলাতে বেসরকারি ডাক্তারের নাম মানুষগুলোর মুখে মুখে ফিরছে। কী ব্যাপার তোমরা সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে কেন টাকা দিয়ে দেখাচ্ছ? এমন প্রশ্নের উত্তর এলো, ‘সরকারি হাসপাতাল অনেক সময় নাগে মাই। ডাক্তার আসিতে আসিতে বেলা পার। মাইনষের ভিড়, নম্বা লাইন। এর উপর ওষুধপাতি সেইতো কিনি খাবার নাগে। তাই হামার বাড়ির ডাক্তারই ভালো।’
এই মানুষগুলো যেন এ ধরনের অভিযোগ না করতে পারেন, সেজন্য দেশের বাজেটের একটা নির্ধারিত অংশ অবশ্যই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পেছনে ব্যয় করা দরকার। কারণ মানুষ বিপদে পড়লে প্রথমেই সরকারি হাসপাতাল বা কমপ্লেক্সে যায় সাহায্যের জন্য। সেখানেই যদি তারা চিকিৎসা-ওষুধ, টিকা গ্রহণ ও পরীক্ষা করাতে পারেন অল্প টাকায়, তাহলে সাধারণ মানুষের ভালো থাকা অনেকটাই নিশ্চিত হয়। এই সময়ে এসে রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমন বাড়ছে দক্ষ জনশক্তি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের চাহিদা। শুধু অবকাঠামো স্থাপন করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
শুধু সরকারের একার পক্ষে দেশের এত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা চ্যালেঞ্জিং। এজন্য এগিয়ে আসতে হবে ব্যক্তি উদ্যোগকে, কমিউনিটি পার্টিসিপেশন, বেসরকারি সহায়তা, বড় কোম্পানি ও এনজিও সাপোর্ট। সবকিছু হওয়ার পরেও সবচেয়ে যা জরুরি, তা হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, প্রতারণা ও অপচয় রোধ এবং মনিটরিং।
আপনার মতামত লিখুন :