ইলিশ, দেশের জাতীয় মাছ। জুলাই থেকে অক্টোবর এর ভরা মৌসুম। এ সময়ে দেশের কয়েকটি নদী ও বঙ্গোপসাগরে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে রুপালি ইলিশ। হাট-বাজার ও মৎস্যঘাটে বসে ইলিশের মেলা। আর এই ইলিশ দেশের জাতীয় মাছ হলেও দেশের অর্ধেক মানুষ তা ছুঁয়ে দেখতে পারে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কাছে ইলিশ যেন সোনার হরিণ। যেমন- একজন গরিব কৃষকের এক সের (এক কেজি) ওজনের (বড়) একটি ইলিশ কিনতে হলে আট আড়ি (এক আড়িতে ১০ কেজি- আট আড়িতে দুই মণ) ধান বিক্রি করতে হয়। কারণ বড় ডিমওয়ালা ইলিশ যে কেজিতে বিক্রি হয় ২২ থেকে ২৮শ’ টাকায়। আর কৃষকরা দুই মণ ধান (আড়ি ৩০০ টাকা দামে) বিক্রি করে পায় ২১ থেকে ২৪ শ’ টাকা। এদেশের কৃষক-শ্রমিক যেন জাতীয় মাছ ইলিশ খেতে ভুলে গেছে। তবে কালে-ভদ্রে মধ্যবিত্তের পাতে ওঠে ইলিশ। অথচ এক সময় ভরা বর্ষায় ইলিশ বাঙালি ধনী-গরিব সবার পাতেই উঠত। অথচ সেই কালে ইলিশকে মাছের রাজা-রানী দুটোই বলেছিলেন জেলেকন্যা কমলা দেবী। আর সেই কমলা দেবীর স্বাদে ও ঘ্রাণে অনন্য রাজা-রানী ইলিশ যেন গরিবের নাগালের বাইরে। এই ইলিশ বাঙালি সমাজে ‘মাছের রাজা-রানী’ হলেও তা যেন টাকার ভয়ে নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত কারও পাতেই উঠছে না।
অথচ গ্রামাঞ্চলের বাঙালিবধূ স্বামীর পথ চেয়ে থাকে কবে যে ‘এক্কান এক সের’ (বড়) ইলিশ নিয়ে বাড়ি আসবেন। কিন্তু ইলিশ যে বড়লোকের খাবার তা হয়তো ভুলে গেছে বাঙালি বধূ। ইলিশ মাছ কতই না যত্ন করে রান্না করে বাঙালিরা। এ ইলিশ রান্নায় সরিষা না দিলে যেন চলেই না এদেশের মানুষের। সৃষ্টিকর্তা সাগরে ইলিশকে ফ্রি করে দিয়েছেন। যা ধরতে কাউকে কোনো বাধা নেই বা টাকা দেওয়া লাগে না। অথচ সেই ইলিশ সমতলে এলেই হয়ে যায় সোনার হরিণ। আর স্বাদে ও ঘ্রাণে অনন্য ইলিশ যেন জাতীয় মাছ হয়ে জাতির নাগালের বাইরে। সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশে ইলিশ নিয়ে এত হৈচৈ হয়েছে, অতীতে তা আর কোনো মাছ নিয়ে হয়েছে কি-না, সন্দেহ। যে টুনা মাছ জাপানের গর্ব। অথচ সেই সভ্য জাপানিরাও এ দেশের ইলিশ নিয়ে বাঙালির আবেগের কাছে ম্লান হয়ে যাবে। তবুও সেই ইলিশ বাঙালি কৃষক-শ্রমিকের পাতে ওঠে না। বর্তমান বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম এখন ১৮০০ টাকা, দেড় কেজি ২৪০০ থেকে ২৯০০ টাকা। ছোট ইলিশের মধ্যে ৮০০ গ্রামের ইলিশের দাম ১৪০০ টাকা, ৭০০ গ্রাম ১২০০ এবং ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর কৃষকের এক আড়ি ধান বিক্রি হয় ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। একজন কৃষক ৮ আড়ি (দুই মণ) ধান বিক্রি করেও একটি বড় ইলিশ কিনতে পারে না। এখন ইলিশের ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ ইলিশই উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। গত এক যুগে মাছটির উৎপাদন বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়েছে ইলিশ মাছের উৎপাদন। মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, ‘২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। এরপর এক দশক পেরোনোর আগেই ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মধ্যে উৎপাদন উন্নীত হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে। এ অনুযায়ী নয় অর্থবছরে দেশে মাছটির উৎপাদন বেড়েছে ৭৩ শতাংশের বেশি। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। অর্থাৎ পরের ছয় বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১০ শতাংশ। সর্বশেষ দুই অর্থবছর ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩-এ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে দশমিক ৩৫ ও দশমিক ৭ শতাংশ। গত কয়েক বছরে ইলিশের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, আকার ভেদে বর্তমানে দেশে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে- ১০০০-২৭০০ টাকায়। গত বছরের একই সময়ে এ দাম ছিল ৮০০-১৭০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ইলিশের দাম প্রায় ৫৬ শতাংশ বেড়েছে।
অথচ Generation Z-এর নতুন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে পরে বিদেশে ইলিশ রপ্তানি হবে- এমন খবরে স্বস্তি মিলেছিল নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের মধ্যে। তাতে ইলিশ খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল এদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা। দেশের মানুষের আশা ছিল সাধ্যের মধ্যে আসবে দাম, পাতে উঠবে সুস্বাদু ইলিশ মাছ। কিন্তু সেই আশা নিয়ে বাজারে গিয়ে মানুষ দেখতে পায় তারই উল্টো চিত্র। কারণ যে লাউ সেই কদু। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ইলিশ যে দেশের জাতীয় মাছ, সে দেশের মানুষ যদি ইলিশের স্বাদ নিতে না পারে তাহলে তা হতাশাজনক।
আমাদের অন্যতম জিআই পণ্য ইলিশ। স্বত্ব পাওয়ায় সারা বিশে^ এখন ইলিশ বলতে বাংলাদেশকেই বোঝায়। যে দেশকে ইলিশের দেশ বলা হয় সেই দেশের মানুষ ইলিশ খেতে পারে না। সেই দেশে নেই ইলিশ নিয়ে গবেষণা। এছাড়া আরও বেশি পরিমাণে ইলিশ উৎপাদনে সমন্বিত কোনো পদক্ষেপ নেই বললেও চলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের সব নদীতে ইলিশ একই সময়ে ডিম পাড়ে না। ফলে যখন ইলিশ যে নদীতে ডিম পাড়ে, সেই নদীতে তখন তা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। অথচ দেশে ঢালাওভাবে এক সময় নির্ধারিত করা হচ্ছে। ইলিশ সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য এর মজুদ ও দ্রুত বৃদ্ধি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের। যেসব নদী ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশগত কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোয় মাছের বিচরণ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পুষ্টিবিদরা বলছেন, প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশ মাছে ২১.৮ গ্রাম প্রোটিন, ২৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৩.৩৯ গ্রাম শর্করা, ২.২ গ্রাম খনিজ ও ১৯.৪ গ্রাম চর্বি, ১৮০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও বিভিন্ন খনিজ, খনিজ লবণ, আয়োডিন এবং লিপিড রয়েছে, যা অন্যান্য মাছ ও মাংসের তুলনায় অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড ফিশের হিসাবে ওমেগা-৩ পুষ্টিগুণের দিক থেকে স্যামন মাছের পরেই রয়েছে ইলিশ। জনপ্রিয়তায় স্যামন ও টুনা মাছের পরই ইলিশের অবস্থান।
দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও উৎপাদিত ৫ লাখ ৭১ হাজার টন ইলিশ থেকে রপ্তানির অনুমতিপ্রাপ্ত পরিমাণ মোট উৎপাদনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশেরও কম। তার মানে, আহরিত ৯৯.৫ শতাংশ ইলিশ দেশেই থেকে যাচ্ছে। তবুও কেন ইলিশের দাম কমে না? জেলেদের কাছ থেকে যে দামে নিয়ে দাদনদাতা তাদের আড়তদারের কাছে ইলিশ বিক্রি করে, খুচরা বাজারে সেটা অন্তত দ্বিগুণ দর হবে কেন?। কিন্তু এরপরও কখনো সরকার বা ভোক্তা অধিকারের কোনো অভিযান চোখে পড়ে না। কেউ ইলিশের দাম নিয়ে কথা বলে না। অথচ ৫০ টাকার সবজি ৬০ টাকা হলে পত্রিকার পাতা দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি বলে লাল-কালো হয়ে যায়। যেসব গরিব জেলে চাঁদা ও দাদনের চাঁই ভরাতে পারে না, তাদের ওপর চলে জুলুম। তাদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকায় নেওয়া ইলিশ বাজারে এসে হয়ে যায় ২ হাজার টাকা। তাই এ দেশের কৃষক-শ্রমিকের নাগালের বাইরে থাকা সনদ পাওয়া ইলিশ কি বড়লোকের জিআই হয়ে থাকবে?
লেখক
রিয়াদুল ইসলাম রিয়াদ
গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :