ঢাকা শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

ন্যায্য আয়ে অন্যায্য বাজার

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৪, ০৪:০৪ পিএম

ন্যায্য আয়ে অন্যায্য বাজার

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

অন্যায্য বাজারব্যবস্থা আজ নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বাজারে গরিব প্রবেশ করতে পারেন কিন্তু পছন্দমতো কিছুই কিনতে পারেন না। নিয়ন্ত্রণমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নিচে বাজার হয়ে উঠছে নাগরিকদের প্রত্যাখ্যানের বড় ক্ষেত্র। বাজারের আয়নায় রাষ্ট্রের চরিত্র সহজেই ধরা পড়ছে। জনগণ বাজার থেকে যখন সামর্থ্য অনুযায়ী চাহিদামাফিক পণ্য কিনতে ব্যর্থ হন এর চেয়ে নির্মম ব্যাপার তো আর হতে পারে না।

বাজার হলো ভোক্তার ভোগ ও রুচিপণ্যের প্রধান সরবরাহকারী সংস্থা। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে ব্যক্তির খাদ্য অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় জেতা মানুষের সংখ্যা কম কিন্তু পরাজিত মানুষের সংখ্যা অনেক। জনসংখ্যার সিংহভাগ সকালবেলায় বাজারে গিয়ে বঞ্চিত, প্রতারিত ও প্রত্যাখ্যাত হন। বিদ্যমান বাজার হলো অন্যায্য বাজারের উৎকৃষ্ট নমুনা, যা বঞ্চনাবোধের জন্ম দিচ্ছে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বাজারের কাছে হেরে যাওয়া মানুষ কমমূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে খোলা ট্রাকের নিচে লাইন দেয়। টিসিবি খুলে বসে এক অস্থায়ী ট্রাকপয়েন্ট। এ ট্রাকপয়েন্টগুলোর নিচে দাঁড়াচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু, কমবয়স্ক-প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকে পণ্য পান আবার কেউ তা পান না। মহল্লায় মহল্লায় বিক্রয়কেন্দ্রের কথাও উল্লেখ করা হয়; তবে তা নিশ্চিত নয়।
প্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্য কিনতে ট্রাকের নিচে দাঁড়াতে বাধ্য হওয়া একটি অমানবিক ও অমর্যাদাকর ব্যাপার। এতে দরিদ্রদের ব্যক্তিমর্যাদা ও পরিচয় গোপন রাখার অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দরিদ্রদের গোপনীয় বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে না।

ক্ষুধার্ত মানুষের সারি ও দিশাহীন চোখ আজ কাউকে উদ্বিগ্ন করে না। অন্যকে অমর্যাদাকর অবস্থায় দেখতে এ সমাজ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, ভেতরে নিষ্ঠুরতা কিন্তু বহিরঙ্গে তার দয়াভাব। অন্যকে করুণা বা বিনয়ের চোখে দেখাও যে একধরনের অসুস্থতা।

ব্যক্তি গরিব হতে পারে কিন্তু তার পরিচয় গোপন রাখার অধিকার রয়েছে। দারিদ্র্য সম্পর্কিত একান্ত গোপন বিষয়টি জনসম্মুখে তুলে ধরতে চলছে বিশেষ আয়োজন। পরিতাপের বিষয় হলো- দেশের অনেক স্থানে ট্রাকে টিসিবি পণ্য বিক্রি উদ্বোধন করা হয়েছে। রোদের মধ্যে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কমমূল্যে পণ্য কেনা গরিবের প্রতি বিশেষ আনুকূল্য দেখানোর চেষ্টা চলছে। দয়া ও দাক্ষিণ্যের যেন উৎসব।

টিসিবির বিক্রয়কেন্দ্রে গরিব মানুষদের শারীরিক উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে- দেখ এরা কত গরিব, কত অসহায়, কত সামান্যতেই এদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়! উন্নয়ন উৎপাদনে পারঙ্গম রাষ্ট্রের কাছে গরিব মানুষ সত্যিই একটি বিরক্তির ব্যাপার, একটা উটকো ঝামেলা। দরিদ্রের ঝাঁক ম্যানেজ করা লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক সরকারগুলোর কাছে বড় এক ঝামেলার বিষয়। রাষ্ট্র তার নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার সংরক্ষণে আজ সীমাহীন উদাসীনতা দেখাচ্ছে কি না ভেবে দেখা দরকার।

সহজেই লক্ষ্য করা যায়- টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে অনেকে মাথা নিচু করে থাকেন। এ মাথা নিচু করে থাকা দুটি অর্থ তৈরি করে- এক. নিজের পরিচয় আড়াল করতে চাওয়া, দুই. মাথা নিচু করে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য গ্রহণ করা। জনগণকে সকালে ট্রাকের নিচে লাইন ধরে পণ্য কিনতে বাধ্য করা এক অমানবিক ও মর্যাদাহীন ব্যবস্থা।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, গত রাজনৈতিক সরকারের আমলে ভাতাভোগীদের সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ের আরও ৫৭ লাখ নিম্ন-আয়ের মানুষ পেয়েছেন ‘ফ্যামিলি কার্ড’; যারা রোজা উপলক্ষে এটি দিয়ে কিনতে পারবেন কম দামের টিসিবির পণ্য। ‘এক কোটি পরিবারের’ এসব মানুষের কাছে কম দামে পণ্য বিক্রি করবে ট্রেডিং করপোরশেন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।

এটি তো আপৎকালীন ব্যবস্থা। কিন্তু সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রকে ন্যায্যবাজার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে জনগণের ওপর। পুঁজি, মুনাফা ও ভোক্তা অধিকারগুলো নৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে পারাই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি।

বাজার কেবল মুনাফা তৈরির ইন্ডাস্ট্রি নয়, বাজার হলো- ভারসাম্যপূর্ণ বিনিময়ক্ষেত্র। যেখানে ব্যক্তি তার সামর্থ্য নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে এবং উইন-উইন মনোভঙ্গি নিয়ে বাজার থেকে ফিরতে পারবে।

এখনকার বাজারে কেবল বিক্রেতা জিতে, ক্রেতা-ভোক্তা ফেরে অতৃপ্তি ও হতাশা নিয়ে। এমন অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতিতে তাকে বাজারে যেতে হয় কেনাকাটা করতে হয়, কারণ এ ছাড়া তো তার জীবন চলে না।

পরিবারের কর্তাব্যক্তি পরিবারের সদস্যদের চয়েস অনুসারে বাজার থেকে পণ্য কিনতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আস্ত ডিমের পরিবর্তে, খোসা ভাঙা ডিম কিনতে বাধ্য হন। বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে, চাহিদামাফিক পণ্য কিনতে না পারায় ছোট হয়ে যাচ্ছেন পরিবারের সদস্যদের কাছে। ভাবা যায় অন্যায্য বাজারের অভিঘাত কত গভীরে!

আজকের বাজার কেবল ব্যক্তি চয়েস হত্যার পরিক্ষেত্র নয়, এটি পারিবারিক ও সামাজিক চয়েস খুনের অন্যতম উৎস। যে রাষ্ট্রে বাজার প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের পছন্দ ও আকাক্সক্ষাকে হত্যা করে সেই বাজারব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না।

১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনটি আকাক্সক্ষার কথা বিবৃত হয়েছিল: সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এ ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনটি গাইডিং প্রিন্সিপাল।

স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীতে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স আয়োজিত আলোচনায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছিলেন- সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। কিন্তু সে স্বপ্ন থেকে বাংলাদেশ আজ অনেক দূরে। সামাজিক বৈষম্য তো বাড়ছে হু হু করে। আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন বিত্তশালী মানুষের ঘন অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বৈধ উৎস ছাড়া বিত্তবৈভব বাড়াতে দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী নেক্সাস। এ নেক্সাস নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।

এ নেক্সাসের একটি বড় অংশ বাজার নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় নেমেছে। সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকে ‘তুলা বা চাঁদা’ তুলে পুঁজি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলতে একাগ্র তারা। বাজার-ঘাট, পাবলিক স্পেস যেখানেই ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলুক না কেন তার কোনো অংশই আজ রেন্ট সিকিং ইকোনমির বাইরে নয়।

এ নেক্সাসের সঙ্গে জড়িত মূলত স্থানীয় দালাল বা ফড়িয়া, পুলিশ ও রাজনৈতিক দৃর্বৃত্ত। মহানগরের সড়কের পাশে এক চিলতে খোলা জায়গায় ভ্যান গাড়িতে ৫০টি আনারস নিয়ে যিনি বসেন তাকেও বিকেল দুটা থেকে রাত আট পর্যন্ত ছয় ঘণ্টার জন্য এ নেক্সাসকে দিতে হয় একশ’ টাকা। একজন ক্ষুদ্র ডিম বিক্রেতাকেও দিতে হয় চাঁদা। চাঁদাহীন কোনো পাবলিক পরিসর নেই আজ এদেশে।

প্রান্তিক উৎপাদন, সরবরাহকারী, পাইকারি বাজার ও খুচরা বিক্রেতা এ সহজ সমীকরণের মধ্যে এ দেশের বাজারব্যবস্থা সীমাবদ্ধ নেই। এর ভেতরে খুব শক্ত অবস্থান নিয়েছে রেন্ট সিকার বা চাঁদা তোলা শ্রেণি। এ শ্রেণির বাড়তি চাপ পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনুমান করা যায়, সেই মূল্যবৃদ্ধি দশ ভাগের কম নয়।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই সংবাদপত্রের রাজশাহীর প্রতিনিধি পবা বাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে একটি সবজির ট্রাকে ওঠেন। পথে ট্রাকড্রাইভারকে কত টাকা চাঁদা দিতে হয় তা অনুসন্ধানের জন্য। মজার বিষয় হলো- পথে ট্রাকড্রাইভারকে চাঁদার জন্য কেউ আটকায়নি। সর্বশেষ জানা গেছে, চাঁদাবাজ নেক্সাসের সঙ্গে ট্রাকওয়ালার মাসিকভিত্তিতে চাঁদা নির্ধারিত হয়েছে।
এ অলিখিত চুক্তির বিনিময়ে এ নেক্সাস ট্রাকড্রাইভারকে একটি স্লিপ দিয়েছে। এ স্লিপ দেখালে ট্রাকড্রাইভারকে আর কোনো বাড়তি চাঁদা দিতে হয় না। এরপরও মাঝে মাঝে তাকে দুয়েকশ’ টাকা চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য দিতে বিভিন্ন স্পটে গুনতে হয়।

এ উচ্ছিষ্টভোগী শ্রেণি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি প্রান্তিক উৎপাদকদের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, সরবরাহকারী, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতাদের অতিমুনাফার লোভ বাজারকে অসহনীয় করে তুলেছে। সঙ্গে রয়েছে আমদানি-রপ্তানি রাজনৈতিক অর্থনীতি। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো- গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা পড়ে যাওয়া। অর্থনীতির বাড়তি চাপ নিতে না পেরে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে ছদ্মবেশী দরিদ্র শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে।

এমন পরিস্থিতিতে গরিবদের বাজারে গিয়ে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থবিত্তের মালিক হোমরাচোমরাদের দাপট দেখতে হচ্ছে। তারা অনায়াসে মাংসের দোকানে গিয়ে ১০-১৫ কেজি গরুর মাংসের অর্ডার দিচ্ছে বা ৮ কেজি বা ১০ কেজি ওজনের রুই-কাতলা মাছ কিনে ফেলছে। পাশে দাঁড়িয়ে গরিব মানুষটির তখন হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। কারণ এ রকম বাজারে একজন ঘুষখোর আমলা বা অন্য পেশাজীবীর সঙ্গে বাসাবাড়ির নিরাপত্তা প্রহরীকেও কেনাকাটা করতে হয়। আজকের বাস্তবতায় বাজার যাচ্ছে বিত্তশালীদের অনুকূলে। অন্যায্য বাজার আজ জনস্বপ্ন ভঙ্গের বড় পরিক্ষেত্র। এমন বাজারব্যবস্থা নিশ্চয় কোনো বিবেকমান মানুষের কাম্য হতে পারে না।
 

আরবি/জেআই

Link copied!