ঢাকা শুক্রবার, ০১ নভেম্বর, ২০২৪

সবার আগে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৪, ১০:৩৭ এএম

সবার আগে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

কৃষি এবং কৃষক এ দেশের মূল সম্পদ। কারণ দেশের খাদ্য উৎপাদন এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা নির্ভর করে কৃষির ওপর। যদিও প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিকে মূল্যায়ন করলেও কৃষক শ্রেণি সর্বদাই অবহেলিত। ঠিক এ কারণেই বর্তমান প্রজন্ম কৃষিতে সম্পূর্ণ অনাগ্রহ। বড় হয়ে কেউ কৃষক হতে চায় না। অথচ কৃষকের হাতেই প্রকৃত সোনা থাকে, বাজারে নয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্য এবং অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম হলো ধান, পাট, আখ, যব, তুলা ইত্যাদি। বিগত দশকে নতুন নতুন উন্নত জাতের ধানের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ আজ সম্ভব হয়েছে।

এই জাত উদ্ভাবন করেছেন যিনি তাকে কিন্তু সারা বাংলার মানুষ খুব কম চিনে বা তাকে চেনানোর চেষ্টাও নেই আবার যারা দিন রাত কাদা মাটি নিয়ে কাজ করে এই অসাধ্য সাধন করেছে তারা হলো কৃষক শ্রেণি। বাংলার প্রায় সবাই একসময় পেশা হিসেবে কৃষির ওপরই নির্ভর ছিল। এখনো কৃষিই অন্যতম প্রধান পেশা। প্রধান পেশা হলে কী হবে, ফসল উৎপাদনের মধুটুকু খায় কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী, সাধারণ প্রান্তিক কৃষক কোনোমতে লাভটুকু তোলে বা সেটুকুও ওঠে না। এই যে বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি এর ফলে কিন্তু কৃষক লাভবান হচ্ছে কমই। লাভের গুড় খাচ্ছে পিঁপড়ে মানে মজুতদার ব্যবসায়ী। তাহলে দাম বেশি কেন? এভাবে চলতে থাকলে একদিন বাধ্যতামূলকভাবে কৃষক হতে হবে প্রতিটি পরিবার থেকে। কারণ কাউকেই আর এ পেশায় পাওয়া যাবে না।

তাছাড়া প্রযুক্তির সঙ্গে দক্ষতা অর্জন করতে না পারাও এই পেশার একটি বড় দুর্বলতা। কৃষি খাতটাই এখন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। এসব কৃষকের মধ্যে প্রান্তিক কৃষকদের অবস্থাই বেশি খারাপ। যাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ কৃষি এবং যারা কৃষির ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকে লোকসানের বোঝা তাদের বেশ দুঃসহ। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক শ্রেণির কৃষক যাদের প্রচুর নিজস্ব জমি রয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে চুক্তিতে জমি নিয়ে চাষবাদ করছে। অন্য শ্রেণিতে রয়েছে খুব সামান্য পরিমাণ জমি এবং তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হলো সেই জমি থেকে উৎপাদিত ফসল।

প্রতি বছর কৃষিতে সমস্যা প্রকট হচ্ছে। বীজ, সার, কীটনাশকের খরচ  আছে। এই সমস্যা সমাধানে সমস্যার মূলে যেতে হবে এবং স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। ঠিক কী কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের দাম পায় না বা ফি বছর লোকসান দিতে হচ্ছে তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ উদ্ঘাটন ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার কারণ খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্যার টেকসই এবং স্থায়ী সমাধান করতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে উৎপাদন খরচের দিকে। কারণ বাজারে এ বছর ধান বিক্রি করে যে মূল্য পেয়েছে তাতে লোকসান হয়েছে। কিন্তু পরের বছর যে এর থেকে বেশি মূল্য পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। সুতরাং কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।

কৃষকের উৎপাদন খরচ যদি কমানো যায় তাহলে ফসলে লোকসান কমতে পারে। ফসল কাটার মৌসুমে ধান কাটতে শ্রমিকের মূল্য বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এ সমস্যা কমার কানো কারণ নেই। কারণ হিসেবে বলা যায়, আজকাল পেশার ক্ষেত্রে ভিন্নতা এসেছে। দিন দিন এই খাতে শ্রমিকের সংখ্যাও কমছে। একজন শ্রমিক সারাদিন ফসল কাটার পর যে অর্থ উপার্জন করে অন্য খাত থেকেও তুলনামূলক কম শ্রমে সেই পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারছে। ফলে শ্রমিক সংকট হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া বিশ্বায়নের যুগে বেশিরভাগই স্থায়ী শ্রমমূলক কোনো কাজেই বেশি আগ্রহ দেখায়। যেমন, কোনো কল-কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা অথবা অনেকেই আজকাল অটোরিকশা-ভ্যান চালাতেই বেশি আগ্রহ বোধ করছে। এসব কাজের যেমন স্থায়িত্ব রয়েছে তেমনি সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে। তাহলে এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় কী? এর সমাধান একটাই। উন্নত বিশ^কে অনুসরণ করা। বিশেষ করে যেসব জনবহুল দেশ আজ উন্নত হওয়ার কাতারে রয়েছে তারা কীভাবে কৃষিক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।

উন্নত বিশে^ কৃষি কাজের সর্বত্রই বিজ্ঞানের ছোঁয়া। যেখানে আমাদের দেশে আজও কৃষি খাতের সর্বত্র বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগেনি। ফসলের বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল মাড়াই পর্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগাতে হবে এবং সেই সুফল একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। এটা করতে পারলেই কমানো যাবে  প্রতি বছর লোকসানের বোঝা। কৃষকদের জন্য রাখা বরাদ্দ যেন মাঝপথেই না কমে সোজা কথায় কারও লোভের দৃষ্টিতে না পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। ধান, পাট বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে অন্যতম। সেই প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে এসব ফসল উৎপাদিত হয়ে আসছে। কৃষির ওপর দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো কৃষিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। কারণ কৃষির আধুনিকায়ন না করলে বাকি খাতগুলোর উন্নয়ন হুমকির মুখে পড়বে। যত উন্নয়নই হোক না কেন কৃষিকে পরিপূর্ণ রূপ দিতেই হবে।

সেক্ষেত্রে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে। কৃষিকে অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ পেশার মতো ধরে কৃষকদের মূল্যায়ন করতে হবে। একজন সরকারি চাকরিজীবী চাকরি শেষে পেনশন ভোগ করছেন। বিপরীতে একজন কৃষক বৃদ্ধ পর্যন্ত মাঠে ঘাম ঝরাচ্ছেন। তবু ন্যায্যমূল্য না পেয়ে। অথচ সেই ঘাম ঝরানো ফসল খেয়েই আমরা বেঁচে আছি। ফলে কৃষকদের জন্য টেকসই ব্যবস্থা করা জরুরি। ঘাম ঝরানো এ পেশার মূল্যায়ন করতেই হবে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার পর যদি সেই পরিশ্রমের মূল্য না পায় তাহলে তাদের দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? নিজে যখন সারাজীবন কৃষিকাজ করে বঞ্চনা ছাড়া আর কোনো সুবিধা পান না, ফলে তিনি চান তার সন্তানকে যেন তার মতো কষ্টকর এবং অবহেলার জীবন কাটাতে না হয়। একবার ভাবুন কৃষি কাজ যদি কেউ না করে তাহলে এই আমাদের মতো অন্য পেশার মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে? নিশ্চয়ই  কেউ কর্মস্থল সামলে মাঠে ফসল ফলাতে যাবে না। তাই যারা এই কাজটি করছে তাদের উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা, উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা আজ সময়ের দাবি।

কৃষিতে আগ্রহ কমার প্রবণতা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। কৃষিকে আজও সমাজের নিচু শ্রেণির কাজ বলেই ধরে নেওয়া হয়। বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বিদ্বান হয়ে সবাই চাকরির পেছনে ছোটে। তাদের লক্ষ্য থাকে চাকরি করা। কিন্তু এমন কেউ আছে কি যিনি কৃষি কাজ করে জীবন চালাতে চান? এ রকম খুঁজে পাওয়া ভার। একজন সফল কৃষক এ রকম বহু বড় বড় চাকরিজীবীর থেকে উত্তম বলে আমার মনে হয়।

সরকার এ বছর কৃষকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ধান কিনছে কেবল তাদের লোকসানের বোঝা কমানোর জন্য। কিন্তু এই সমস্যা কেবল নির্দিষ্ট বছরের নয়। প্রতি বছরই কোনো না কোনো ফসল চাষে কৃষকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। দালাল ও ফড়িয়ারা কৃষকদের বারোটা বাজাচ্ছে। ধানের দাম বাড়ুক বা কম হোক কৃষক যেন তার উৎপাদন খরচ তুলতে পারে সে বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। ফসল বোনা থেকে আরম্ভ করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রযুক্তির সাহায্যে করতে হবে। যেখানে ফসল বোনার সময় বা কাটার সময় অতিরিক্ত শ্রমিক প্রয়োজন হবে না। আধুনিককালে যখন ফসল বোনা ও কাটার জন্য আমাদের দেশের কৃষকরা শ্রমিক খুঁজতে ব্যস্ত তখন উন্নত বিশ্বে প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব কাজ সমাধান হচ্ছে। কৃষকের সমস্যার সমাধান করার মধ্যেই রয়েছে উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি। উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু কার অবদানে বেড়েছে বা তারা কেমন আছে তার খোঁজ নিতে হবে। কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন আনতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে কৃষি খাতকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুত্ব দিয়ে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।     
 

 

আরবি/জেআই

Link copied!