ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

চির-উন্নত হোক শিক্ষাগুরুর শির

আলাউল কবীর

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৪, ০৯:৩৪ পিএম

চির-উন্নত হোক শিক্ষাগুরুর শির

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের অনুসন্ধিৎস্যু ধারায় চলমান বর্তমান। সময়ের হাত ধরে খুঁজে ফেরে প্রকৃত গণতন্ত্র। রাষ্ট্রপ্রধান কেবলই রাষ্ট্রচিন্তায় মত্ত থাকবেন এটাই গণতান্ত্রিক মূলধারা। রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য নীতির রাজা; রাজার নীতি নয়। প্রশ্ন জাগে সত্যিই কি আমরা গণতান্ত্রিক ধারায় চলছি? আমরা কি গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি? উত্তরে আমি বলব, না। মানসিক শক্তি, চিন্তার দৃঢ়তা আর লেখার বহির্প্রকাশ যতই ধারাল হোক মানবিক মূল্যবোধ যার মধ্যে নেই, সে আর যা-ই হোক মানুষ হয়নি। প্রকৃত মূল্যবোধের প্রখরতার আলো ছড়িয়ে পড়ুক মানুষের অন্তরে, সাহিত্য ও কর্মে।

যার দ্বারা জ্ঞানের সমৃদ্ধি বিকাশের আলোয় পরিপূর্ণ তিনিই শিক্ষাগুরু, একজন প্রকৃত শিক্ষক, যিনি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার দৃঢ়তা শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন কীভাবে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী ভাষা লেখা যায়। শূন্যতায় ভরা আমাদের জ্ঞানের পরিধি। মাঝে মধ্যে নিজেকে সঠিক চিন্তার পথে দাঁড় করিয়ে দেখেছি, প্রতিবাদীও হয়েছি; কিন্তু সফলতা সর্বক্ষেত্রে আশা করা যায় না। তবু যুদ্ধ করে যাই, চলমান জীবনের যুদ্ধ। ক্ষমতা দখলদারিদের হাতে ছিল, এখনো আছে; তারাই ঐশ্বর্যের মালিক। ক্ষমতা যার, ঐশ্বর্য তার। এত কিছু জেনেও আমি আমার সাহিত্যচর্চায় লিখে যাই নির্মম সব সত্য। নির্দ্বিধায় আমার ভেতরের যন্ত্রণার লাভা উৎক্ষেপণ করি। আমরা যা-ই করি অথবা ভাবি এসব কিছুর বহির্প্রকাশ বৃত্তের বাইরে থেকে আসে না। আসে মস্তিষ্কের কলাগুচ্ছ থেকে। যার ধারাল অনুরণন থেকে প্রকম্পিত হয়ে বেরিয়ে আসে ভালো কিছু। এসবই একজন প্রকৃত শিক্ষক থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান। কারণ শিক্ষকদের সংস্পর্শ মনোবল বাড়িয়ে দেয়, আর ভালো কিছু করার ইচ্ছায় তৎপর হয়ে ওঠে আত্মা। আমার সাহসী পদক্ষেপের প্রথম অভিভাবক হলেন, একজন প্রকৃত শিক্ষাগুরু।

একজন প্রকৃত শিক্ষক সব সময় খুঁজে ফেরেন মনুষত্ববোধের পরিধি। এক বিশাল জাগরণে জেগে উঠুক মানবিকতা তিনি তা চান। কেন্দ্রকে প্রসারিত করে বিশাল পরিধি আঁকার চেতনায় যারা মত্ত। তারা সময়ের কাঠামোগত স্থপতি আমি মনে করি। সেই সহাস্যে শিখেছি স্থাপত্য বিদ্যার কলা-কৌশল। যা প্রচার-প্রসার করা খুব প্রয়োজন একটি সুস্থ সমাজ গঠনে। কিন্তু সময়, পরিবেশ ও প্রকৃতি এক নির্মম বেড়াজালে কোথায় যেন বাঁধা পড়ে আছে সব ধারণকৃত সমৃদ্ধিগুলো। চলমান সময়ে আমাদের হাত-পা বাঁধা। তবু চলতে হয়। এটা নির্মম সত্য যে, ক্ষেত্রবিশেষে আমরা নির্বিকার; শুধু তাকিয়ে থাকা মানুষ। কারও জন্য কিছু করতে পারি না। না পারি নিজের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য। এখানে আত্মনির্ভরতাই গণতন্ত্র। পরনির্ভরতা বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। তাই বাংলাদেশ এখনো পরাধীন। স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের কার্য হাসিলের জন্য প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের দাবিয়ে রাখে। মানুষের চলমান ধারাকে দাবিয়ে রাখতে পারে; কিন্তু অভ্যন্তরীণ চেতনাকে দাবিয়ে রাখতে পারে না।

দুঃখ হয়, বড় দুঃখ। যখন দেখি কিছু শিক্ষক স্বৈরশাসকদের দোসর বনে গেছে। তারা এসব ক্ষমতাবানদের পা-চাটা গোলাম হয়ে নিজের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত ও সুবিন্যস্ত। তারা কীভাবে গড়বে একজন দেশপ্রেমিক, একজন নির্ভীক চেতনার প্রজন্ম। যারা অর্থের কাছে বিক্রি করে দেয় মেধা, তারা সমাজের নিকৃষ্টতম মানুষ। তারা বিকৃত মানসিকতার রূপক মাত্র। তারা শুধু চায় আর চায়, শোষণ করে চলাই তাদের লক্ষ্য। জ্ঞান আহরণ বা বিতরণ করতে জানে না, বুঝতেও চায় না। কারণ তারা নিজেদের পণ্ডিত ভাবে। সার্টিফিকেটধারী যোগ্য মানব বলে নিজেদের দাবি করে। ফারসি ভাষার কবি জালাল উদ্দিন রুমির একটি উক্তি মনে পড়ে গেল ‘সব কিছু জেনে ফেলায় জ্ঞান নয়, জ্ঞান হলো- কী কী এড়িয়ে যেতে হবে বা বর্জন করতে হবে।’

আমার প্রশ্ন এই সমাজ থেকে, রাষ্ট্র থেকে কি প্রকৃত শিক্ষক বিলুপ্ত? নিশ্চয় নয়! তবে কি প্রকৃত শিক্ষা বিলুপ্ত? এর উত্তরে বলব অবশ্যই কাঠামোগত শিক্ষার অবনতি ঘটেছে। যদি তাই না হতো; আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের এতটা অপমান, এতটা অবনতি কোনো মতেই ঘটত না। আজ বিবেকের কাছে প্রশ্ন শিক্ষকদের এই অবমূল্যায়নের জন্য দায়ী কে? সমাজ নাকি সমাজের অবক্ষয়? যে সমস্ত মানুষ সমাজের অবক্ষয় দূরীকরণের লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে চলেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার। কিন্তু তিনি এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তিনি প্রকৃত একজন শিক্ষক, একজন বাবা, একজন বুদ্ধিজীবী। আমি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে বিশ্লেষণ করে জেনেছি। যার প্রতিটি মুহূর্ত মানবতার স্বার্থে নিবেদিত তিনিই প্রকৃত মানুষ। রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার নায়ক। আমার দূরদর্শী চিন্তার শিক্ষাগুরু অভিভাবক। তিনি তার শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধে যা বলেছেন ‘অনবরত উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কাল। সমাজের অভ্যন্তরে ক্ষয়ের লক্ষণই প্রধান লক্ষণ। নতুন যেসব মূল্যবোধ ও পরিকল্পনা স্থায়িত্ব পাওয়ার কথা, সেগুলোর গড়ে ওঠার কিংবা বিকশিত হওয়ার আগেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের ক্ষয়ই অভিহিত হচ্ছে, অবক্ষয় বলে। মানুষের প্রবৃত্তির অধোগামিতা, প্রবৃত্তিবশ্যতা, বিচার-বিবেচনার অভাব, অপচয়, অপব্যয়, অব্যবহার ইত্যাদি অবক্ষয়ের সবচেয়ে মৌলিক কারণসমূহ অন্যতম।

সংস্কৃতি চেতনার সুস্থ বিকাশ এবং সাফল্যসম্ভব নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলন দ্বারা অবক্ষয়ের অবসান সূচিত হতে পারে। এজন্যই এ সমাজে আজ সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ সম্পর্কে ব্যাপক গভীর আলোচনা-সমালোচনা দরকার। জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জাতীয় আর্থিক অবস্থার সম্পর্ক নিয়েও চিন্তা করা দরকার।’

অথচ আমাদের চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের দেখেছি, অনেকেরই কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই। সমাজের কাঠামোগত বিনির্মাণ প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থাপনায় কখনোই অনুপ্রবেশকারী বহিরাগতদের প্রাধান্য যৌক্তিকগ্রাহ্য নয়। যদি তাই চলতে থাকে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেসব স্থানগুলোতে যোগ্য উত্তরসূরির অভাব হয়ে পড়বে। ক্ষেত্রবিশেষে তাই ঘটেছে। চেঁচানোর জন্য আমরা অনেকে আছি কিন্তু যোগ্য হয়ে উঠিনি। 

দুঃখ হয় সমাজের অবক্ষয়ের দিকে তাকালে, ছাত্ররা কি করে শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে; যত অপরাধই থাকুক। দল-মত নির্বিশেষে তিনি শিক্ষক। শিক্ষকদের অবহেলা আমার সহ্য হয় না। শুধু আমার কেন একজন সুস্থ নাগরিকের সহ্য হবে না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই কি স্বৈরশাসক দ্বারা পরিচালিত? সব ছাত্ররাই কি বিবেকহীন হয়ে পড়েছে? একটি নিকৃষ্টতম রাষ্ট্র হলে- বোধহয় এভাবে ছাত্রদের হাতে জোরপূর্বক লাঞ্ছিত হতে হয় শিক্ষকদের? এটা তারই উদাহরণ মাত্র। ফ্যাসিবাদী শাসকরা আমাদের এই উপহার দিয়ে গেল। যেমন-রাষ্ট্র, তেমন তার ফসল। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনের মূলধারা এত নিচে নেমে গেছে ভাবা যায় না। শিক্ষকদের চোখে যেমন-জেগে ওঠে দৃঢ় শাসন তেমনি অন্যদিকে ভালোবাসার কোমল হৃদয়ও ছাত্রের জন্য কেঁপে কেঁপে ওঠে। সেসব শিক্ষকদের এখন বড় বেশি প্রয়োজন।

আমরা জ্ঞানী ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের মর্যাদা বুঝি না। কারণ একটাই, আমরা জ্ঞান অর্জন সঠিকভাবে করি না বলেই তা ধারণও করতে শিখিনি। স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা পাশ্চাত্যের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারিনি। দেশ গঠনে সঠিক কাঠামো পরিবর্তনের খুব বেশি প্রয়োজন এখন। তাই যিনি পারেন; আমরা অন্তত তাকে প্রভাবক হিসেবে প্রভাবিত করতে পারি, তার চিন্তা ও মননে গতির সঞ্চার ঘটাতে পারি, তবু কিছু তো এগোবে? আমরা গুটিয়ে থাকা স্বভাবের মানুষ, আমরা কি সত্যিকারের মানুষ? সমস্যাসংকুুল জীবন থেকে কীভাবে বেরিয়ে সহজীকরণ জীবনের পথ তৈরি করা যায় তা ভাবতে হবে। সত্যিকারের স্বাধীনতার আস্বাদন পেতে চাইলে চিন্তার স্বাধীনতা প্রয়োজন।

বায়ান্ন বছর। দীর্ঘ সময়ের পথ। এত বছর পরেও শোষণ ও নিপীড়ন বন্ধ হয়নি এদেশ থেকে। কেউ হয়তো জীবনের ঘানি টেনে টেনে ক্লান্ত, কিন্তু আমরা তা দেখতে পাই না। কেউ হয়তো নিপীড়ন সহ্য করে করে নির্মম যাপিত জীবনের প্রহর গুনছে। সত্যিই এমন একটি পরিবর্তন খুব প্রয়োজন ছিল আরও আগেই। সামাজিক এই অবকাঠামোর পরিবর্তনে ছাত্রদের ভূমিকা অপরিহার্য। মানুষ সব কিছু করতে পারে; সাহসী মানুষেরা। কখনো কখনো বিবেক, পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষকে তার সব কিছু করার প্রবণতা ও উদ্যমতাকে যেমন, জাগিয়ে তোলে তেমনি ক্ষুণ্ন্নও করে। ফলে স্বেচ্ছায় যেকোনো কিছু করার ইচ্ছার ঘাটতি দেখা দেয়। দুর্বলতার বেড়াজালে দুর্বিষহ হয়ে পড়ে জীবিকার তাগিদ এর থেকে নিষ্কৃতি কোথায়? মানুষের এই নিজস্ব শক্তিকে জাগ্রত করার প্রয়াসে; ভয়কে দূর করার প্রয়াসে যে আয়োজন যে অন্দোলন যে স্পৃহা তার সবই নতুন প্রগতিশীল জাগরণী ছাত্রজনতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল। আবার নতুন করে জেগে উঠুক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান। প্রকৃত শিক্ষকরা তার প্রকৃত সম্মান পাক। জেগে উঠুক মনুষ্যত্ববোধ ও মূল্যবোধের চেতনা। আজ থেকে চির-উন্নত হোক শিক্ষাগুরুর শির।

 

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

 

আরবি/জেডআর

Link copied!