বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার মর্মমূলে জেগে আছে এমন এক গৌরবের ইতিহাস, যার কোনো তুলনা হয় না। অতুলনীয় এই গৌরবের পাশেই উজ্জ্বল সূর্যের মতো স্বমহিমায় ভাস্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আমাদের স্মৃতির দুয়ার খুলে দেয়। খুলে যায় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতাও। সমগ্র জাতির অতুলনীয় আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস, অনন্য ঐক্যে গভীর দেশপ্রেমে একবারই বাঙালির জাগরণ ঘটেছিল ১৯৭১ সালে।
১৯৭১, একদিকে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বোরোচিত নির্যাতন, অন্যদিকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বাংলার সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে চলা মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত দিনরাত্রি। ৯ মাসের সেই অবিস্মরণীয় দিনরাত্রির প্রতীক্ষার উৎকণ্ঠায়, অর্জনের মহিমায়, আত্মত্যাগের প্রোজ্জ্বল সাহসে গরীয়ান সেই ইতিহাস; যা বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথের প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য দেশমাতৃকার লাখ লাখ বীর সন্তান কী অনায়াসে হাসিমুখে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে, সেই ইতিহাস বার বার তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ একাত্তরের সেই অনন্য ঐক্যের অবস্থানে আজ আর নেই।
সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যাওয়া সমাজ-বাস্তবতায় শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবারই উদগ্র ভোগস্পৃহা যুব সমাজের কাছে কোনো মহৎ আদর্শ তুলে ধরে না। ফলে তারাও ভোগবাদী আর নীতি-নৈতিকতা-বর্জিত জীবনের পঙ্কিল পথে এগিয়ে চলেছে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমাদের যে অর্জন কোনো অংশে কম নয়। সমগ্র এশিয়াতে দেশের আসন অনেক উচ্চে। কৃষি উৎপাদনে, মাছ, শাক-সবজি ডিম, মাংস, উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বিশিষ্ট অবস্থানে। গার্মেন্টস শিল্পে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গৌরবের। নারীশিক্ষা-গণশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বহু ক্ষেত্রে জীবনমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। মাতৃমৃত্যুর হার বিস্ময়করভাবে কমানো সম্ভব হয়েছে। এর আগে এ জন্য জাতিসংঘের পুরস্কার লাভ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ৮ গুণ বড় রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় আর পাকিস্তান কোথায়!
অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তা বিস্ময়কর! যুদ্ধবিধ্বস্ত যে বাংলাদেশের ১০০টি ডলারও ছিল না ১৯৭২ সালে, সেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েক বছর আগে ছিল বিলিয়ন ডলারের অধিক। বাংলাদেশ সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত হয়নি এটা ঠিক, কিন্তু এদেশে কেউ অতীতের মতো অনাহারে মরে না।
পুঁজিবাদী বিশ্ব বাস্তবতায় ধনী-গরিবের বৈষম্য উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এ কথা সত্য, বৈষম্যটা কমিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সাফল্যের তাৎপর্য আরও প্রসারিত হতো বৈকি, গণমানুষের মঙ্গলে অধিক কার্যকর হতো।
বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই বাংলা বাস্তবায়নের অনুকূল ছিল তখন বিশ্বব্যবস্থা। একদিকে শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক পৃথিবী অন্যদিকে পুঁজিবাদী দুনিয়া। ফলে সামরিক ক্ষেত্রে যেমন একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স পরিস্থিতিতে অর্থব্যবস্থারও একটা ভারসাম্য ছিল। বঙ্গবন্ধু মাত্র তিনটি অর্থবছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ওই তিনটি অর্থবছরের বাজেট দিয়েছিলেন সেদিনের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। সেই বাজেটগুলো দেখলে বা পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে ছোট পুঁজির বাজেটও কতটা গণমুখী হতে পারে। আরও সহজ করে বললে বৃহত্তর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ কতটা গুরুত্ব পেতে পারে। সেই বাজেট ধনীকে আরও ধনী হতে এবং গরিবকে আরও গরিব হওয়ার পথ রুদ্ধ করেছিল। ওই রকম বাজেট এই বাংলাদেশ আর কখনো পায়নি আর হবে কিনা তা বলা সম্ভব নয়। কারণ এখন পরিবর্তিত বাংলাদেশ গভীর দেশপ্রেম থাকলেও অনেক কিছুর সঙ্গে আপস করে যেতে হয়। জেনে শুনে বিষ পান করার মতোই এসব গরল গিলেই ক্ষমতায় থাকতে হয়। এমনকি ধর্মান্ধতা মৌলবাদ অপছন্দ হলেও অনেক ক্ষেত্রে মেনে নিতেই হচ্ছে!
ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন, দেশকে সমৃদ্ধশালী করবেন, নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাবেন, কিন্তু তাদের যে পুঁজি সেই পুঁজি রাষ্ট্রের সম্পদ লুটপাট করা হবে কেন? বহু ব্যবসায়ী-শিল্পপতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং বেসরকারি বহু ব্যাংকের ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করেননি! অথচ তারা সেই টাকা নিয়েই বিদেশে ব্যবসা করছেন কেউ কেউ বিশ্বের ধনী দেশগুলোতে বাড়ি কিনে বিলাসী জীবন-যাপন করছেন। বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই অপসংস্কৃতি, লুটপাটের অর্থনীতির এই ভয়াবহ অনেক চিত্রই বেরিয়ে আসবে।
মনে রাখা দরকার, কোনো রাষ্ট্র তা যতই ধনী হোক, অর্থনৈতিকভাবে যত সমৃদ্ধির অধিকারীই হোক, সে দেশ কখনো উন্নত দেশ নয়, যতদিন না তার উন্নত মানবসম্পদ আর সুশিক্ষা ও সভ্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে, সন্দেহ নেই। বিস্ময়করভাবে বদলে গেছে মানুষের জীবনমান। গ্রাম-শহরের বৈষম্য ধীরে ধীরে কমে আসছে। কিন্তু যা হয়নি, তা হচ্ছে মানবিক ইতিবাচক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের সেই ঐতিহ্যÑ যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেখে গেছেন। এখন যে নৈতিকতাহীন ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা, অনুপার্জিত অর্থের মালিক হওয়ার উদগ্র বাসনা, এমনকি সমাজের সব ক্ষেত্রে ভয়াবহ স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রিকতার যে চরম বহির্প্রকাশ ঘটছে, তা দেখে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। শিশুদের যদি শেখানো হয় একা একা খাও, (চিপসের বিজ্ঞাপন) দরজা বন্ধ করে খাও, সেই সমাজ কী ভয়ংকর স্বার্থপরতা বহন করে তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।
একটা বিষয় মনে পড়ে গেল, এটাকে উদাহরণও বলা যেতে পারে। ১৯৯২ সালে একটি ছোট গার্মেন্টস নিয়ে ব্যবসা শুরু করা এক গার্মেন্টস মালিক গত প্রায় ৪০ বছরে কম করে হলেও সহস্রাধিক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সেই একটি ছোট গার্মেন্টস এখন অন্তত ৯টি গার্মেন্টসে উন্নীত। কিন্তু তার কারখানায় শ্রমিকটি কাজ করে, সে ঢাকায় মাথাগোঁজার মতো একটি বাসস্থান তৈরি করার কথা তো চিন্তাই করতে পারছে না। এক শ্রমিকের বছরের পর বছর চাকরি করে জীবনমানের কোনো উন্নতি হয় না, তার মাথাগোঁজার ঠিকানা ঠিক হয় না সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করার মতো অর্থের সংস্থান হয় না। চিকিৎসা-বাসস্থান তো পরের কথা। গার্মেন্ট-শিল্প শুধু নয়, সব শিল্প-কারখানাতেই শ্রমিককে যত কম দেওয়া যায় আর যত বেশি শ্রম আদায় করা যায়- এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চলমান ধর্ম। এই ভয়ংকর অমানবকিতা আমরা দেখি প্রত্যেকটি ঈদ এলেই ঈদের বেতন-বোনাসের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে হয় শ্রমিকদের।
এই নিষ্ঠুরতার অর্থনীতি, এই শোষণের অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারকে ব্যবসায়ীদের কাছে কিছুটা হলেও অপ্রিয় হতেই হবে। সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু পুঁজিপতি, চোরাকারবারি, ভোগবিলাসী সরকারি আমলাদের কারো কাছেই প্রিয় ছিলেন না। এদের তীব্র সমালোচনা তিনি নিয়মিত করতেন। আজকের সরকার-ব্যবস্থায় যা কল্পনাও করা যায় না। আজ মনে হয় সব আমলাতন্ত্রের কাছেই জিম্মি!
যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে সম্পদ আহরণ করছেন, যারা সরকারের চাকরি করে অনৈতিক পথে ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার উদয় হবে, এমনটাও আশা করা যায় না। অপ্রিয় হয়ে সরকারকে নীতিকৌশল করে এই শোষণের অর্থনীতির যাত্রা সংকুচিত করতে হয়। তাহলেই স্বাধীনতা অর্জন সত্যিকারের অর্জনে রূপান্তরিত হবে।
আপনার মতামত লিখুন :