বিশ্ব আধিপত্যবাদ কৌশলে পরিবর্তন আসছে। অতীতেও পরিবর্তন এসেছে। প্রায় অর্ধশত বছর আগে ইউরোপ বা পশ্চিমা দেশগুলো এশিয়া নিয়ে যে ধরনের পরিকল্পনা সাজিয়েছে, এখন তার ধরন বদলে গেছে। আবার আফ্রিকা নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। একসময় কোনো দেশে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম ছিল সামরিক শক্তি। দেশটিকে তৈরি করা হতো উপনিবেশ। কালক্রমে সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। এখন কৌশল মিত্রতার। বিভিন্ন কৌশলগত চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়, সেটি বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক। ধারণা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনার ধারা যেমন কূটনীতি এবং সমরনীতি পাল্টেছে। কারণ, একাধিক বলয়ে বিভক্ত বিশ্বে সম্পর্কোন্নয়ন এবং ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এ ধারাবাহিকতায় সম্পদে পূর্ণ আফ্রিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভূ-রাজনৈতিক কার্যক্রম এখন পরিচালিত হচ্ছে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে এবং স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে। এ ভূ-রাজনীতি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া এবং এখান থেকে আরও কয়েকটি শক্তি একত্রিত হয়ে বিভক্ত হয়েছে। নাম হয়েছে পশ্চিমা শক্তি বনাম রাশিয়া-ইরান-চীন। সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যা উসকে দেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এভাবে সারা বিশ্ব একটি বড় ধরনের সমস্যার ভেতর প্রবেশ করছে। একের পর এক জোট গঠনের প্রবণতা গঠন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর অর্থ নতুন সমীকরণ তৈরি এবং বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণ। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনেও এলো নতুন হিসাব-নিকাশের পালা। সেই সঙ্গে শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করাও একটি উদ্দেশ্য।
এরই ধারাবাহিকতায় নতুন এক শক্তির আবির্ভাব দেখতে যাচ্ছে পুরো বিশ্ব। জানা গেছে, এর আগে এক টেবিলে বসছে রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়া। আঙ্কারা এবং দামেস্কের সম্পর্ক মেরামতের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সম্মেলনের পরিকল্পনা করছে দেশগুলো। এ সম্মেলনে কী ধরনের সিদ্ধান্ত আসবে, তা এখনো জানা না গেলেও রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়া যে এক হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির বিপক্ষে কঠিন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে এ চার শক্তি। এ ছাড়া সামরিক দিক থেকে সহযোগিতা জোরদার করতে যাচ্ছে দেশ চারটি। পালাবদলের গান শোনাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সিংহ ইরান। সঙ্গে আছে ইসলামি প্রতিরোধ শক্তি হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতি। অন্যদিকে রাশিয়া।
ভøাদিমির পুতিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে। আরেক দিকে তুরস্কের নতুন সুলতান এরদোয়ান, যিনি সব সময়ই মুসলিম এবং নিপীড়িত শক্তির পক্ষে কথা বলে যান ক্রমাগত। পশ্চিমা প্রভাব ঠেকাতে সব সময়ই তৎপর রাশিয়া-ইরান-চীন। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ও সামরিক ক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকার ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় দেশগুলো। একইভাবে পিছিয়ে নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এটা মূলত এক ধরনের প্রতিযোগিতা, যা বিশ্বের ভৌগোলিক কাঠামোকে একদিকে শক্তিশালী করছে অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
ভূ-রাজনীতি দ্বারা কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো এলাকার গুরুত্ব বিশ্লেষণের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বোঝায়। এই সংক্ষিপ্ত অর্থ বাদ দিলে ভূ-রাজনীতি বিশ্ব প্রচলনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্বনেতারা যখন একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব গড়ার ডাক দেন, তখন এই অমানবিক পরিস্থিতি তাদের লজ্জায় ফেলে দেওয়ার কথা। যত দিন অস্ত্র আছে, তত দিন এ যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অন্য দেশের প্রভাবের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো- ঋণ প্রদান, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহযোগিতা করা এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকারের খাতগুলোয় অর্থায়ন। এভাবে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তা বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। এটাকে বলা হয় সক্ষমতা। এ সক্ষমতা অর্জনের পেছনে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো ছুটছে। এ প্রভাব বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় চীন পৌঁছে যাচ্ছে আফ্রিকায়। সম্পদে পরিপূর্ণ কিন্তু এখনো সেখানকার অনেক দেশ দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
সম্প্রতি আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা জোরদার করছে এশিয়ার পরাশক্তি চীন। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ফোরাম অন চীন-আফ্রিকা কো-অপারেশনের সম্মেলন। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ৫০টির বেশি দেশের নেতাসহ ৩ হাজার ২০০ জনের অধিক প্রতিনিধি। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও অবকাঠামো, কৃষি, খনি, জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর ঘোষণা আসে।
চীন নতুন করে আফ্রিকায় আরও ৫১ বিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা ও অন্তত ১০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সেই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে আফ্রিকা মহাদেশের সবুজ জ¦ালানি শক্তি নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ করবে চীন। এটিকে বিশ্বে পরাশক্তি হিসেবে চীনের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়াস হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। ২০০০ সালে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফোরাম অন চীন-আফ্রিকা কো-অপারেশন সংস্থাটি। এরপর থেকেই প্রতি তিন বছর পরপর এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারের সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বেইজিংয়ের প্রধান মিত্র রাশিয়ার সহযোগিতা ছাড়াই আফ্রিকা মহাদেশে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে বেইজিং। সেই সঙ্গে চীনের প্রবল জনসংখ্যা-সংকট এবং অর্থনীতির ধীরগতি আফ্রিকা মহাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তারের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বশক্তি হিসেবে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে চীন তার কূটনৈতিক তৎপরতাও বৃদ্ধি করেছে। এত কিছুর পেছনে রয়েছে, নিজের প্রভাব বৃদ্ধি এবং একটি কার্যকর পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং নিজের অবস্থান ধরে রাখা। বলাবাহুল্য, যদি চীন তার লক্ষ্য ঠিকঠাক পূরণ করতে সক্ষম হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। এতে ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছাবে দেশটি। কারণ, এই অঞ্চলে প্রধানত ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা রয়েছে চীনের। এটি নিঃসন্দেহে চীনকে এগিয়ে রাখবে।
আফ্রিকার দেশগুলোয় চীনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশটির অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। ভারী অবকাঠামো নির্মাণের কাঁচামালসহ চীনের অর্থনীতির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য আফ্রিকার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে বেইজিংয়ের। এসব বিনিয়োগের ফলে আফ্রিকা মহাদেশের বড় অংশের বাজার চীনের দখলে চলে যাবে। এরই মধ্যে মহাদেশটির নির্মাণ আফ্রিকার দেশ গিনির উপকূলীয় অঞ্চলে ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণে কাজ করছে চীন। পশ্চিম আফ্রিকার নাইজার থেকে তেল রপ্তানির লক্ষ্যে ২ হাজার কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইনের কাজও করছে বেইজিং। নতুন বিনিয়োগের ফলে সে পথ আরও বিস্তৃত হলো বেইজিংয়ের। পশ্চাৎপদ আফ্রিকার দেশগুলোর অর্থনীতির পরিবর্তনে এটি মাইলফলক হতে পারে বলে আশাবাদী আফ্রিকার নেতারা। যদিও এখনো অনেক দেশের নেতাদেরই চীনের এসব ঋণ গ্রহণে আপত্তি রয়েছে। এমনকি অতিরিক্ত ঋণের কারণে অনেক দেশই নতুন ঋণের প্রস্তাব ফিরিয়েও দিচ্ছেন। তবু মহাদেশটিতে দিনের পর দিন চীনের আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখছে বেইজিং।
এই অঞ্চলে চীন-ভারত দুদেশই প্রতিযোগিতায় রয়েছে। এই যে প্রতিযোগিতামূলক কৌশলের একটি বড় সুবিধা রয়েছে। সেটি হলো উন্নয়ন। যে দেশটি উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে এবং বিপরীতে রয়েছে বিপুল সম্পদ এবং সেই সম্পদকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা থাকে না তখন সক্ষম উন্নত দেশ সে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে তা উন্নয়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। আমরা এটাকে কৌশল বললেও আধুনিক বিশ্ব বিনির্মাণে এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এ কথা সত্যি, এই কৌশলে সব সময় যে লাভবান হওয়া যায় এমনও না, তবে এর কারণ রাজনৈতিক সততা এবং দূরদর্শিতার অভাব, অন্যকিছু না। কারও কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তা কাজে লাগানোর ক্ষমতা না থাকলে ফলাফল ব্যর্থ হবেই। আর যদি সে সুযোগ কাজে লাগানো যায় তাহলে তা মঙ্গলজনক। অতএব এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা পৃথিবীর জন্য একেবারে খারাপ কিছু না।
আপনার মতামত লিখুন :