ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪

ইলেকট্রনিক বর্জ্যের বিপদ ও উত্তরণের উপায়

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০২৪, ০৯:৩২ এএম

ইলেকট্রনিক বর্জ্যের বিপদ ও উত্তরণের উপায়

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

অলোক আচার্যগত কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার বিপরীতে পৃথিবী যেন ই-বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। ক্রমেই এই পরিবেশগত হুমকি পৃথিবীকে নতুন সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তি সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘ই-বর্জ্যরে কার্বন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ, কারণ ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা হয়। সেই আলোচনার সংবাদ থেকে যায়, প্রতিবছর দেশে সৃষ্টি হচ্ছে, ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য। যার মধ্যে শুধু স্মার্ট ডিভাইসেই সৃষ্টি হচ্ছে, সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। অন্তত ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২ ইউনিট নষ্ট টেলিভিশন থেকে সৃষ্টি হচ্ছে- ১.৭ লাখ টনের মতো ই-বর্জ্য। জাহাজভাঙা শিল্প থেকে আসছে ২৫ লাখ টনের বেশি। বছর ঘুরতেই এই বর্জ্য বাড়ছে ৩০ শতাংশ। সেই হিসাবে ২০২৫ সাল নাগাদ কোটি টনের ই-বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হবে বাংলাদেশ। ২০৩০ নাগাদ বছরে বিলিয়ন ইউনিট স্মার্ট পণ্য উৎপন্ন হবে।

মানবসভ্যতা এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। মানবজীবন সহজ হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। ডিজিটালাইজেশন হয়েছে দ্রুত গতিতে। পৃথিবী আজ একটি গ্লোবাল ভিলেজ। এসব সুবিধা যেমন মানুষকে আরাম-আয়েশ দিতে সক্ষম হয়েছে, বিপরীতে মানুষের সামনে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বর্জ্য সমস্যা। যা সমাধানের জন্য মানুষ প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা করছে। উন্নত দেশগুলো তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে লাগিয়ে বর্জ্য থেকে রিসাইকেলের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করছে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনো এ সমস্যা নিয়ে ভুগছে। শহরগুলোতে প্রতিদিন বর্জ্য বাড়ছে যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। তবে আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হলো, ই-বর্জ্য বা ইলেকট্রনিক বর্জ্য। কেন ই-বর্জ্য ঝুঁকিপূর্ণ বা দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলছে আমাদের কপালে? এর সহজ উত্তর হলো, এই সময় ও সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রসার ঘটছে ই-পণ্যের। নিত্যনতুন সুবিধাসম্পন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যগুলো প্রতিদিন আপডেট সুবিধা নিয়ে বাজারে আসছে। এক্ষেত্রে রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় যে যত বেশি সুবিধা দিতে পারবে তারাই অধিক গ্রাহক পাবে।  এমন ধারণা থেকেই ক্রেতা টানতে প্রতিযোগিতায় নামছে কোম্পানিগুলো। ফলে ক্রেতাই আজ একটা তো কাল অন্য আরেকটা পণ্য কিনছে। কিন্তু তার পরিত্যক্ত ইলেকট্রনিক্স পণ্যটি বর্জ্য হয়ে থেকে যাচ্ছে।

দিন দিন এই সমস্যা প্রকট হচ্ছে। ই-বর্জ্য কেবল আমাদের দেশের সমস্যা নয়, বরং গত কয়েক বছর ধরেই সারা বিশ্বেই এটি সমস্যার কারণ হয়ে বৈশ্বিক ‘ই-ওয়েস্ট মনিটর রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী দেশ। খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে প্রতিবছর যে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি করছে, এর মধ্যে শুধু মোবাইল সেট থেকেই তৈরি হচ্ছে সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। আর ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২ ইউনিট নষ্ট টেলিভিশন থেকে তৈরি হচ্ছে, ১ দশমিক ৭ লাখ টনের মতো ই-বর্জ্য। প্রতিবছরই এই বর্জ্যরে পরিমাণ ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও জানা যাচ্ছে, একটি মোবাইল ফোন রিসাইকেল করা গেলে এ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু দেশে রিসাইকেল কারখানা তেমন না থাকার কারণে উদ্যোক্তারা এগুলো সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেখানে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও দেশে ই-বর্জ্য রিসাইকেল করে তেমন অর্থ পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক সংখ্যা ১৯ কোটি ৩৬ লাখ। একটি মোবাইল সেটের ব্যবহার উপযোগিতা শেষ হওয়ার আগে এর মেয়াদকাল দুই থেকে তিন বছর ধরলেও কয়েক কোটি মোবাইল সেট প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে, দেশের ই-বর্জ্যরে ভান্ডারে।

দেশে ২০২১ সালে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা জারি করা হয়। ২০২০ সালে জাতিসংঘের প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, তার আগের বছর বিশ্বজুড়ে ৫২.৭ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয়েছিল। সেসব ই-বর্জ্যরে পাঁচ ভাগের এক ভাগ রিসাইকেল করা হয়। ২০১৯ সালে বিশ্বে যত ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য তৈরি হয়েছিল সেগুলোর ওজন ইউরোপের সব পূর্ণবয়স্ক মানুষের চেয়েও বেশি ছিল। আবার বর্জ্যগুলো এক সারিতে রাখলে তা ৭৫ মাইলের চেয়েও দীর্ঘ হয়ে যেত। জাতিসংঘ সতর্ক করে জানিয়েছে, ২০৩০ সালে বিশ্বে ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য হবে ৭২.৮ মিলিয়ন টন। মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই ই-বর্জ্য। কারণ পরিত্যক্ত ইলেকট্রনিক্স পরিবেশে ক্ষতিকর উপাদান ছড়িয়ে দেয়। বিশ্বে মোট ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় এশিয়ায়। ফলে সঠিক এবং বাস্তব পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। বলা যায়, ই-বর্জ্য নিয়ে এ রকম বিপদেই আছে এশিয়ার দেশগুলো। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী। মানুষের আয় বৃদ্ধি, নতুন নতুন ই-পণ্যের ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক তৈরি হওয়া এসব কারণে ই-পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। যত ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই ই-বর্জ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুঁকিও সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কোনো কোনো দেশ আইন মেনে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। উন্মুক্ত স্থানে ক্ষতিকর পদার্থ ছড়িয়ে মানুষের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রিসাইকেল প্রক্রিয়ার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে, এর মধ্যে থাকা ভারী ধাতুর সংস্পর্শে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, স্নায়ুরোগ, এমনকি ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিরও ঝুঁকি রয়েছে। ই-বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাব বহুমাত্রিক। এতে থাকা সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং পানির উৎসগুলো দূষিত করে। পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি ই-বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই বর্জ্যরে সরাসরি সংস্পর্শে আসা কর্মীরা ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।      

এশিয়ার ই-বর্জ্য নিয়ে ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটি গত বছর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে এশিয়ায় ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। ১২টি দেশের ওপর তারা গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, এই পাঁচ বছরে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন। এদের মধ্যে চীনের অবস্থা ভয়াবহ। এ সময় তাদের দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখ ৮১ হাজার টন। যা পুরো এশিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ বলা হচ্ছে। ই-বর্জ্য সমস্যায় তাহলে সমাধান কোথায়? সমাধান হলো- এর সঠিক ব্যবহার করা। ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান উপাদানগুলো আহরণ করে তা বাজারে কাজে লাগাতে পারলে তা হবে সাফল্যের বিষয়। এজন্য সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ই-বর্জ্যরে বড় অংশই যদি আমরা কাজে লাগাতে সক্ষম হই তাহলেই সমস্যার অনেকাংশে সমাধান সম্ভব। কারণ নিত্যনতুন ফ্যাশনকে রাতারাতি থামানো সম্ভব নয়।

রিসাইক্লিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি পণ্য দীর্ঘদিন ব্যবহারের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। আজকাল অন্যসব যন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তন হয় হাতে থাকা মোবাইলের। দাম কম আর ক্রয় ক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে একটু নষ্ট হলেই তা মেরামতের চেয়ে নতুন একটি কিনতেই আগ্রহী হচ্ছি আমরা। একই ঘটনা ঘটছে ল্যাপটপ, টেলিভিশন অথবা ফ্রিজের ক্ষেত্রেও। এখান থেকে বের হতে হলে আমাদের টেকসই পণ্য এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের অভ্যাস গড়া জরুরি। আর রিসাইক্লিং করার মাধ্যমে পরিত্যক্ত পণ্যগুলো পুনরায় বাজারে এলে তা আবার ব্যবহারের জন্য ভোক্তার হাতে পৌঁছে যাবে। এতে ই-বর্জ্যরে জঞ্জাল বৃদ্ধি একটু ধীরগতি হবে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো- ই-বর্জ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা। ভবিষ্যতে ই-বর্জ্য একটি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠবে এই প্রচেষ্টাই অব্যাহত রাখতে হবে।  

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আরবি/জেআই

Link copied!