ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪

উচ্চশিক্ষায় সংস্কার দরকার

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৪, ০৫:০৫ পিএম

উচ্চশিক্ষায় সংস্কার দরকার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

এ কথা আজ অনেকেই স্বীকার করবেন যে, আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে তুলনায় গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার মান সেভাবে বৃদ্ধি তো পায়ইনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। এমনকি গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থারও আধুনিকায়ন হয়নি। এখনো সেই গতানুগতিক ধারার ক্লাস নোট তৈরি করা এবং সেগুলো বুঝে না বুঝে মুখস্থ করে পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা। পক্ষান্তরে উন্নত বিশ^ তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল বিশ্ব, যেমন- মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনের মতো দেশের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য আধুনিকায়ন ঘটেছে। এর ফলে তুলনামূলক বিচারে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার মান অনেক পিছিয়ে পড়েছে।

আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এই পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় চতুর্মুখী পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রথমত, গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের পদ্ধতি উন্নতি করা। দ্বিতীয়ত, এ পর্যায়ের শিক্ষার পাঠ্যসূচির মান উন্নত করা। তৃতীয়ত, গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট প্রযুক্তিনির্ভর করে তোলা। চতুর্থ, দেশের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা। পঞ্চমত, গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার একটি অংশ বাস্তব কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং ষষ্ঠত, এ পর্যায়ে শিক্ষাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের মান বা স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে একটা মিল থাকতে হবে বা সামঞ্জস্যতা নিশ্চিত করতে হবে।    

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে প্রযুক্তিনির্ভর, যেখান প্রতি বছর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট ছাত্র-ছাত্রী তৈরির প্রয়োজন হবে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। কেননা, তখন দেশে যে মানের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে তার অধিকাংশের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস শিক্ষিতরাই যথেষ্ট। ফলে দেশের গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের কাজের সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে যাবে। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত তৈরির সুযোগ থাকলে দেখা যাবে অনেক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত যুবক উপযুক্ত কাজের সুযোগ না পেয়ে এমন অনেক কাজ বেছে নিয়েছে যা সে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেই করতে পারত। এ রকম অবস্থায় অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমত, সেই গ্র্যাজুয়েট নিজে এবং তার পরিবারের যেমন অর্থের অপচয় হবে, অন্যদিকে তেমনি রাষ্ট্রেরও অর্থের অপচয় হবে। দ্বিতীয়ত, একজন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত যখন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কাজ করবে তখন তার মধ্যে হতাশা দেখা দেবে। তৃতীয়ত, সে তখন কাজের ভালো পরিবেশও পাবে না। কেননা, তার চারপাশে যারা কাজ করবে তারা সবাই থাকবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস। ফলে এক ধরনের অস্বস্তিকর কাজের পরিবেশ বিরাজ করবে সেই গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত যুবকের জন্য। তদুপুরি সে কাজের ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে থাকবে। কেননা, যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে এই কাজ শুরু করেছে তারা চার বছর আগে শুরু করে অনেকদূর এগিয়ে থাকবে। এসব কারণে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত যুবক কাজের স্থানে নিজেকে সেভাবে মানিয়ে নিতে পারবে না এবং ফলে সে সেই কাজটি ঠিকভাবে করতে পারবে না। ফলে সেই গ্র্যাজুয়েট তখন দেশের সম্পদ না হয়ে দায়ে পরিণত হতে বাধ্য।

মূলত গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে শিক্ষা লাভ করতে আগ্রহী হবে সেই সকল শিক্ষার্থী যারা আগামীতে চিকিৎসা, প্রকৌশলী, আইন, বিজনেস, হিসাব বিজ্ঞান, মার্কেটিংসহ পেশাগত বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। এর বাইরে যারা আগামীতে অধ্যাপনা বা শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত হতে চান, যারা গবেষণার কাজে নিয়োজিত হবেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে অধ্যয়ন করতে যাবেন এবং যারা দেশের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে কাজ করতে আগ্রহী শুধু তারাই গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষা নিতে পারে। এ কারণেই এই পর্যায়ের শিক্ষা কিছুটা ব্যয়বহুল হবে এটাই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে শিক্ষালাভে আগ্রহীদের যথেষ্ট মেধাবীও হতে হবে। এই মানের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা অর্জনের সক্ষমতা অনেকের থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। এখানে সক্ষমতা বলতে শুধু মেধাকে বোঝায় না। গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষালাভের মেধা নিশ্চয়ই প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষার্থীর আছে। কিন্তু শুধু মেধা থাকাই যথেষ্ট নয়। মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার জন্য মেধার পাশাপাশি আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। যেমন- উচ্চশিক্ষার অধ্যয়নের যে স্নায়ুচাপ থাকে সেটি নেওয়ার মতো ক্ষমতা অনেকের থাকে না। আবার অনেক শিক্ষার্থী সঠিকভাবে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে পারে না বা একসঙ্গে একাধিক কাজ সম্পন্ন করতে পারদর্শী হয় না, যাকে এক কথায় মাল্টি টাস্কিং বলা হয়ে থাকে। এ রকম অতিরিক্ত যোগ্যতা না থাকলে মানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম সফলভাবে করা সম্ভব হয় না। আধুনিক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার পাঠ্যসূচি এবং পাঠদান পদ্ধতি এমনভাবে সাজানো যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থেকে পড়াশোনা করতে হয় এবং যথেষ্ট সময় সংবেদনশীল অনেক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয় যা শিক্ষার্থী সহজে পেরে ওঠে না। এ কারণেই আধুনিক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার জন্য মেধার পাশাপাশি অন্যান্য গুণাবলি থাকা অপরিহার্য।

আমেরিকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বশর্ত হিসেবে স্যাট, অর্থাৎ স্কলাসটিক অ্যাপটিসিউড টেস্ট বা (এসএটি) স্কোর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই এসএটি-এর মাধ্যমে যত না মেধা যাচাই করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি যাচাই করা হয় আগ্রহী শিক্ষার্থীর অন্যান্য অত্যাবশ্যিক গুণাবলি। এই বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার সুযোগ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তুর জটিলতা এবং গভীরতা দুটোই বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। একজন গ্র্যাজুয়েট ব্যক্তির কাছ থেকে যে মাপের জ্ঞান এবং যোগ্যতা প্রত্যাশা করার কথা তা অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় না। অনেক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষিত যুবকের অর্জিত জ্ঞানের পরিধি এতটাই হাল্কা যে তারা অতি সাধারণ মানের কাজের জন্যও উপযুক্ত হতে পারে না। এর অর্থ এই নয় যে, গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা লাভ করে কেউই মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা অর্জন করছে না। অনেক গ্র্যাজুয়েট তাদের অর্জিত জ্ঞান আন্তর্জাতিক মানের এবং তারা বিভিন্ন দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পলান করছে। এমনকি আমাদের দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে যথেষ্ট দক্ষতা এবং সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পলান করছে। তাদের দক্ষতা এবং কাজের মান দেখে অবাক হতে হয়। তাদের এমন সফলতার জন্য আমরা অনেক গর্ববোধও করে থাকি। প্রশ্ন হচ্ছে এদের সংখ্যা অনেক কম। তাছাড়া একই শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে গ্র্যাজুয়েশন করে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের অর্জিত জ্ঞানের তারতম্য অনেক বেশি। হাতেগোনা কয়েকজন থাকে অসাধারণ জ্ঞানী, পক্ষান্তরে অধিকাংশের অর্জিত জ্ঞানের মানই খুবই সাধারণ। আর এখানেই আমাদের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার চরম দুর্বলতা। এই দুর্বলতা দূর করতে হলে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার পাঠ্যসূচির আমূল পরিবর্তন এনে একে জটিল এবং বিস্তৃত করতে হবে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মানের পাঠ্যসূচি গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় রাখা হয় তার সঙ্গে মিল রেখেই আমাদের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করতে হবে। এতে যুগপৎ দুটো লাভ হবে। প্রথমত, আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার মান উন্নত হবে। দ্বিতীয়ত, উন্নত বিশ্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এমনকি চাকরির বাজারে আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে উচ্চশিক্ষায়, বিশেষ করে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষায় পরিবর্তন আনার কাজটা মোটেই সহজ নয়। এ রকম কোনো উদ্যোগ নিতে গেলে প্রথমেই দেখা দেবে চরম বিরোধিতা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আজ হোক আর কাল হোক এই কাজটি করতেই হবে। আর যেটি করতে হবে, তা যত দ্রুত শুরু করা যায় ততই ভালো। তবে এই পরিবর্তনের কাজে হাত দেওয়ার আগে প্রথমেই এ ব্যাপারে জনমত তৈরি করা প্রয়োজন। প্রথমেই ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে তাদেরকে সম্মত করাতে হবে। তারপর শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সম্মতি নিতে হবে এবং তাদের মাধ্যমেই কাজটা করতে হবে। তারপর ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক এবং নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে তাদেরকেও সম্মত করাতে হবে। সমাজের সকল অংশীজনদের সঙ্গে আগে থেকে আলোচনা করে তাদের সম্মতি নিয়ে শুরু করতে পারলে, কাজটি মোটেই কঠিন হবে না বলে আমার বিশ্বাস।

আরবি/এফআই

Link copied!